• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

কতিপয় যতিচিহ্ন : যতিচিহ্নে আবদ্ধ কালোত্তীর্ণদের নিয়ে বোঝাপড়া


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩, ০২:৩৭ পিএম
কতিপয় যতিচিহ্ন : যতিচিহ্নে আবদ্ধ কালোত্তীর্ণদের নিয়ে বোঝাপড়া

আহমাদ মোস্তফা কামাল অনেক দিন ধরেই সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। শুধু পুরস্কারপ্রাপ্তি ও সমালোচকদের স্বীকৃতির বাইরেও তার রয়েছে একটি নিবেদিত পাঠকগোষ্ঠী। যারা সংখ্যায় কম হলেও নিয়মিত তার বই পাঠ করেন এবং অপেক্ষায় থাকেন নতুন বইয়ের। অনেক দিন ধরেই সেই পাঠকদের একটা চাওয়া ছিল, গত দশকে বের হওয়া, ‘বাংলা গল্পের উত্তরাধিকার’-এর মতো পাঠকপ্রিয় আরেকটা বই আসুক। অবশেষে এলো এবারের মেলায়, ‘কতিপয় যতিচিহ্ন’।

বলা বাহুল্য, কতিপয় যতিচিহ্ন নাম হলেও এটা কোনো বাংলা ব্যাকরণের বই নয়। এখানে মূলত নির্দেশ করা হচ্ছে, যতিচিহ্ন দিয়ে ঢাকা কিছু কালজয়ী বাংলা সাহিত্যিককে নিয়ে লেখকের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা। আহমাদ মোস্তফা কামাল দেখাতে চেয়েছেন, কেন এই বরেণ্য লেখকদের লেখা সমকালকে ছাড়িয়ে কালজয়ী হওয়ার বাসনায় আছে। কোন কোন উপাদানের কারণে তারা এখনো বিপুল প্রাসঙ্গিক।

প্রথম কথা হলো, আহমাদ মোস্তফা কামাল কথাশিল্পী ও সাহিত্যিক হওয়ার আগে একজন প্রাপ্তমনস্ক পাঠক। তিনি তুমুল বই পড়তেন একটা সময় বা এখনো পড়েন, এটা তার এসব লেখায় প্রতীয়মান হয়। যেমন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আমিও পড়েছি। কিন্তু ওয়ালীউল্লাহকে এত নিবিড় পর্যবেক্ষণ সীমিত পরিসরে আর দেখিনি। দীর্ঘ একটা প্রবাসজীবনে থেকেও বাংলার গ্রাম ও মানুষকে নিয়ে আধুনিকভাবে লেখার যে প্রচেষ্টা, তার সুলুক সন্ধানের চেষ্টা আছে লেখকের। তার বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম ও দিনলিপি কিংবা চিঠি দিয়েও বুঝতে চেষ্টা করেছেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রবণতা। নিজের ফেলে আসা গ্রাম ও ইউরোপের আধুনিকতা—এর ভেতরে তিনি কোথাও একটা মানসিক আখ্যানে নিজের কথাসাহিত্যকে পৌঁছাতে চেয়েছেন।

এ রকম আরেকটা লেখা আবু ইসহাককে নিয়েও। এই খ্যাতিমান সাহিত্যিককে নিয়ে আমাদের জানা-বোঝা একেবারেই কম। আহমাদ মোস্তফা কামাল ব্যাখ্যা করেছেন, এর জন্য আবু ইসহাকের অবদানও কম না। তিনি চেয়েছেনই বিস্মৃতি, বড় সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার পরেও তিনি এড়িয়ে গেছেন সব সাহিত্যিক সংযোগ। আহমাদ মোস্তফা কামাল জানাচ্ছেন, আবু ইসহাকের লেখার শুরুর জীবনের স্ট্রাগলের গল্প। কীভাবে কবি জসীমউদ্‌দীন থেকে শুরু করে কতিপয় বড় সাহিত্যিক তাকে মূল্য দেননি, এমনকি তার পাণ্ডুলিপি পড়ারও প্রয়োজনবোধ করেননি। তারপর যখন ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ বের হলো, সবাই অবাক হয়ে গেল। ব্যক্তিগত আড্ডায় আবু ইসহাক তার বিস্তৃত জীবনীও বলেছেন। তারুণ্যেই তিনি তার সেরা লেখাগুলো লিখে শেষ করে বসেছিলেন প্রকাশ হওয়ার বাসনায়। বইটায় আছে আবু ইসহাকের গল্প ও উপন্যাস নিয়ে একটা সামগ্রিক ধারণাও।

এরপর আছে বাংলা ভাষার তিন কালজয়ী ‘হক’কে নিয়ে তিনটা লেখা। সৈয়দ শামসুল হক, মাহমুদুল হক এবং হাসান আজিজুল হক। ক্ষুরধার বিশ্লেষণী কায়দায় তিনি দেখিয়েছেন আসলে তাঁদের সাহিত্য-কীর্তির জায়গাটা। মাহমুদুল হককে নিয়ে আহমাদ মোস্তফা কামাল বরাবরই দারুণ লেখেন। আপনি যদি আহমাদ মোস্তফা কামালকে আজকেও মাহমুদুল হককে নিয়ে লিখতে বলেন, তিনি এমন সুন্দর করে লিখে দেবেন, যার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে না আগের লেখাগুলোর। সৈয়দ হকও একই। আহমাদ মোস্তফা কামালের সৈয়দ শামসুল হক বিশ্লেষণ একদম আলাদা। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, তিনি একটি বড় সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, সৈয়দ হকের। এত ভালো ইন্টারভিউ খুব কম নেওয়া হয়েছে হক সাহেবের। বাকি থাকল হাসান আজিজুল হক। কয়েক মাস আগেই আহমাদ মোস্তফা কামালের হাসান আজিজুল হককে নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম কোনো এক লিটলম্যাগে। কন্টেন্টের দিক থেকে এটাও ভিন্ন। হাসান আজিজুল হকের লেখায় প্রবণতা ও নিম্নবিত্ত মানুষের গল্প বলার যে ভঙ্গি ও ভাষা তাঁর অনুপমনীয় একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তিনি।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শহীদুল জহির নিয়ে লেখা দুটোয় আমি বেশি মুগ্ধ হইনি। হয়তো তাদের নিয়ে আমার পড়াশোনা কিছু আগে থেকেই করা আছে বলে। তবে সেখানেও আছে মজার গল্প, শহীদুল জহিরকে ফোন করে পেয়েও না পাওয়া এবং শহীদুল জহিরের একাকিত্ব কীভাবে তাকে সমাজটা রহস্য ও স্যাটায়ারে দেখতে সুবিধা করেছে এসব বয়ান। মইনুল আহসান সাবেরের অনেক গল্প ও উপন্যাস, যেহেতু আমি পড়িনি তাই ধরতে পারিনি। তবে সাবেরের মুন্সীয়ানার বয়ান আহমাদ মোস্তফা কামালের লেখায় পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, আমাদের সবার মইনুল আহসান সাবের পড়া উচিত। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যে লেখাটা আছে, আমি আগেই পড়েছি। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এত ভালো লেখা কেন সর্বজন পঠিত হয় না, এটা নিয়ে আক্ষেপ আছে আমার। প্রতিবছর মেলায় ওনাকে নিয়ে কত বই বের হয়, কিন্তু এ রকম ক্লাসিক লেখা থাকে না। হুমায়ূন আহমেদের একটা অসাধারণ উপন্যাসকে নিয়ে বলতে বলতে কেন হুমায়ূন আহমেদ এতটা জনপ্রিয় হয়েছেন, সেই ধারণাও দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে আছে বিপুল প্রতিভা থাকার পরেও হুমায়ূন আহমেদের মেধার অপচয় কীভাবে এই বাংলাবাজারের বই ব্যবসায়ীদের হাতে হয়েছে সেই আপসোসটুকুও।

বইটা শেষ হয়েছে কবি শামসুর রাহমানের কথা দিয়েই। প্রিয় কবি বলেই হয়তো, এই লেখাটাও আমার ভীষণ প্রিয়। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের একজন বড় কবির বিনয় ও মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা, মুগ্ধ করেছে আমায়। এত খ্যাতি ও মানুষের ভিড়েও শামসুর রাহমানের কি রকমের ‘ডাউন টু আর্থ’ মানুষ ছিলেন সেই গল্প আছে। আর শামসুর রাহমানের কবিতা কীভাবে আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকলো সেই গল্পটাও। এত মমতা দিয়ে আহমাদ মোস্তফা কামাল শামসুর রহমানকে পড়েছেন, লেখাটার ভেতর আছে একটা মায়া। এই মায়া নিয়েই বইটা শেষ হয়। আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্য বুঝতে চাওয়া মানুষদের জন্য প্রবন্ধের উচ্চমার্গ আলাপ বাদ দিয়ে আড্ডার ভঙ্গিতে অসাধারণ কিছু কথা বলা হয়েছে এই বইটায়। মনোযোগী পাঠকরা আশা করি বঞ্চিত হবেন না এই গ্রন্থ থেকে।

বইয়ের নাম : কতিপয় যতিচিহ্ন
লেখক : আহমাদ মোস্তফা কামাল
প্রকাশক : পাঠক সমাবেশ
মূল্য : ৪৯৫ টাকা।

Link copied!