• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শহীদ সাবের : আধুনিকতার বেদনা ও মহিমা


মনির ইউসুফ
প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৪, ০৪:৫৩ পিএম
শহীদ সাবের : আধুনিকতার বেদনা ও মহিমা
শহীদ সাবের। জন্ম: ১৮ ডিসেম্বর ১৯৩০, মৃত্যু: ৩১ মার্চ-১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ

সময়ের পাখা কোথায় কিভাবে উড়ে যায়
সে সম্পর্কে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না।
নিয়তি দ্রুত ধেয়ে চলে, কোনো প্রতিশ্রুতি
রক্ষা করে না সে। এই যে মানুষটা,
তপস্যার রাজ্যে ভ্রমণ শেষে ফিরে এসেছিল কৃতজ্ঞচিত্তে,
আকাশের পানে চোখ তুলে চাইবে,
কি বিষাদ অভ্যর্থনা সে পেল ঘরে ফিরে।
(ফ্রেইডা অথবা হিপলিটাস-মূল: সেনেকা, অনুবাদ, ভূমিকা ও টীকাভাষ্য- কবীর চৌধুরী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, পৃ. ৮১)

শহীদ সাবেরের মৃত্যু অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি ও মেধার ক্ষয়ক্ষতি বটে। ওই ঘটনা একটি নয়, অনেক ঘটেছে। সেসব ঘটনার প্রতিনিধি তিনি, প্রতীকও বলা যাবে। ব্যর্থতার বোধটা ব্যক্তিগত ছিল। কিন্তু পেছনে প্রধান কারণটা ছিল সমষ্টিগত। রাষ্ট্র তাকে উত্ত্যক্ত করেছে, সমাজ তাকে আশ্রয় দেয়নি। (শহীদ সাবেরকে স্মরণ করে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রথম আলো, প্রকাশ: ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১) 

‘আমাদের সকল ইন্দ্রিয়ের মধ্যে দৃষ্টি সবচাইতে স্বচ্ছ, লিখেছেন প্লাটিনাস, কিন্তু এরপরও সেটি আত্মাকে দেখতে পায় না। এবং এটা এই জন্য যে তিনি সংযোগ করেছিলেন, যদি আমরা আত্মাকে দেখতে পাই, তবে তা আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলবে এক ভয়ংকর প্রেম, এক অসহনীয় ভালোবাসা। একমাত্র সৌন্দর্যের রয়েছে অন্ধ না হয়ে আত্মাকে দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য’। (ফ্রিদা কাহ্লো, কিছু কথা ও ডায়েরির পাতা, ভূমিকা কার্লোস ফুয়েন্তেস, রচনা অংশ অনুবাদ: জাকিয়া রহমান ঋতা, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর-২০১৭, পৃ. ২৭)
শহীদ সাবেরকে আমি দেখিনি, কিন্তু তাঁকে শুনেছি অনেক। বঙ্গোপসাগরের তীরের একই উপত্যকায় আমাদের জন্ম। কক্সবাজারের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও লৌকিক অঞ্চল ঈদগাঁওয়ে। আমি সবে আমাদের অঞ্চলের গিলগামেশের বংশধর মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এই পরিচিতি পর্বের শুরুতে যিনি আমাদেরকে শহীদ সাবেরের নাম শুনিয়েছেন, তিনি মহাত্মা মালিক সোবহান। তিনি এখন প্রয়াত, কী দুর্ভাগ্য আমাদের! এই মৃত্যু হৃদয়কে ভেঙেচুরে দিয়েছে। আবার শহীদ সাবেরের বেদনাদায়ক জীবন ও মৃত্যুর কথা শুনে আমাদের সংবেদনশীল মন এত নাকাল হয়েছে, কীভাবে এই ধাক্কা সামলিয়েছি জানি না। মহাকবি আলাওল, মাগন ঠাকুর, নসরুল্লাহ খন্দকার, আধুনিক যুগের লোককবি বরকেতা গাইন, বংশী গাইন আর আজগর আলী গাইনের দেশে শহীদ সাবেরের নামে পালকযুক্ত হয়েছে অক্ষয় অব্যয়রূপে। জন-কোলাহল, পণ্যদ্রব্য বিক্রির স্থান, ফসলের মৌসুমে বাজারে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা কামলা শ্রেণি, সামন্তীয় জমিদারির রাজত্বে ঈদগাঁও বাজারটি সম্প্রসারিত হয়েছে—মাছবাজার, চালবাজার, পুরান হাটখলা, ফাইক বাজার। তখন আমরা একদল তরুণ মিলে আড্ডা জমাচ্ছি- জাহাঙ্গীর মোহাম্মদের কম্পিউটারের অফিসে, মিলেনিয়াম স্মৃতির খুঁজে হাতড়ে বেড়াচ্ছি জীবন-বাস্তবতা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, লোকসাহিত্য, দর্শনসহ আমাদের সৃষ্টি ও চৈতন্যের প্রবাহ থামায় কে? আমাদের অঞ্চল আধুনিকতার মোহে বেড়ে ওঠে, আধুনিকতার ফাঁদে পড়ে যায়, যেমন সারা পৃথিবী বুর্জোয়া ফাঁদে আটকে আছে। পৃথিবীর অন্যান্য বুর্জোয়া উন্নয়নের ডামাডোলে আমাদের অঞ্চলের মানুষও ডুবে যায়, ওই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উন্নয়নকে তারা গ্রহণ করে। শহীদ সাবের ও রাষ্ট্রকে যদি একদিকে রাখি তাহলে দেখব—রাষ্ট্রের চরিত্রের সঙ্গে শহীদ সাবেরের কতটা দ্বন্দ্ব, কত অমিল। সে ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, ‘যে প্রক্রিয়ায় আমার আধুনিক হয়েছি সে প্রক্রিয়ায় আমরা আধুনিকতার শিকার হয়েছি। উপনিবেশের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের আধুনিকতার ইতিহাস যেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে, তাতে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে অবারিত মুক্তচিন্তার নন্দনকাননের প্রতিশ্রুতি আমরা সেভাবে কখনো বিশ্বাস করতে পারিনি। প্রায় গোড়া থেকে আমরা আঁচ করেছিলাম, জ্ঞানচর্চার সঙ্গে ক্ষমতা বিস্তারের যে আধুনিক প্রক্রিয়া, তাতে বিশ্বজনীন আধুনিকতার আমরা কেবল গ্রহীতাই হতে পারব, স্রষ্টা হওয়ার সুযোগ আমাদের কেউ দেবে না।‘ জর্জ লুকাচ চিৎকার করে ওঠেন—‘পশ্চিমি গণতন্ত্র থেকে আমাদের কে বাঁচবে?’ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লুকাচ একটি গভীর পর্যবেক্ষ দেন যে ‘পুঁজিবাদীদের সমগ্র অস্তিত্ব এবং তাদের সংস্কৃতি একটা গভীর সংকটে। একদিকে আমরা দেখি একটা ভাবাদর্শ যা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। তার শূন্যতা, যা কমবেশি একধরনের জালিয়াতি মনে হয়। অন্যদিকে একটা গভীর হতাশা দেখা দেয়, যা স্পষ্ট তা নিজের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক অপ্রাসঙ্গিকতায় এবং শূন্যতায় বাস করে। এবং তা শুধু সেই অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে, যা নিজের নগ্ন স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এইভাবে যা মনে হয় ভাবাদর্শের সংকট ধ্বংসের অব্যর্থ লক্ষণ। বুর্জোয়া নিজেকে রক্ষার দিকে আগেই এগিয়ে গেছে তার অস্ত্রশস্ত্র যতই ধ্বংসকারী হোক না কেন, তা নিজের আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করছে। শহীদ সাবের এসব বিষয় কত আগেই না বুঝেছিলেন, কত অল্প বয়সে। এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিতে কোনো ভুল করেননি। শ্রেণির মুক্তিই তার একমাত্র আরাধ্য ছিল। 

ঈদগাঁওয়ের প্রাচীন পাহাড়, সমতল, নদী, খাল, নাশী, লবণমাঠ, ঘোনা, প্যারা, ঘনজঙ্গল, ডিঙিনৌকা, শবরী বালিকা ও লবণকন্যা, মিঠাপানির নদীসহ তখনো আমরা তারুণ্যের চঞ্চলতায় ডুবে থাকি আর বঙ্গোপসাগরের বিশালতার কাছে দিগন্তের খোসা ভেঙে হারিয়ে যাই। মৎস্য ও পানকৌড়ি, হাজারবরণ পাখির ওড়াউড়ি, হাজারবরণ মাছের ঝাঁক ঝাঁক সাঁতার, চারণ ভূমিজুড়ে মহিষ, গরু, ছাগল, ভেড়ার পাল আমাদের আন্দোলিত করে রাখে। আমাদের বাড়ির উত্তর পাশে শহীদ সাবেরের জন্মবাড়ি, নানাবাড়ি। পূর্বে আঞ্চলিকতার সমস্ত উপাদান নিয়ে ঈদগাঁও বাজার-জংশন, পশ্চিমে দিগন্তবিস্তারী বঙ্গোপসাগরের অসীম আকাশ পোকখালী, চৌফলদণ্ডী-মহেশখালী। এই টোটাল ভূমি আমরা চষে বেড়াচ্ছি। মানুষের কোলাহলে যেটি মুখরিত। ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, জাহানারা ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতন, আল-মাছিয়া ফাজিল মাদ্রাসা। এই সমতলীয় অঞ্চলটি বিকশিত হতে উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। তার ফসল শহীদ সাবের, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, মালিক সোবহানসহ অনেকে। পুরো অঞ্চলটি নিজেই যেন একটি কবিতা—আবৃত্ত হচ্ছিল বেদনার সুরে আর জিকির করছিল শহীদ সাবের শহীদ সাবের, মোক্তার পাগলা, মোক্তার পাগলা, ডুলা ফকির, ডুলা ফকির বলে। আমার দরবেশি কবি মন সে জিকিরে ডুবে যেত, আমিও সেই সুরের প্রবাহে মন মেলাতাম। মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘আদিষ্ট হয়েছি আমি দীর্ঘ জাগরণে’ এই কবিতা জপ করেছি কত। যেমন:
‘আমি এই বিশ্বসৃষ্টি
এই বিশ্ব আমার সৃষ্টি
আমি আমাকে চাই
আমার বিনাশ নাই।’

শহীদ সাবের সাহসী, বেদনাদগ্ধ, সংবেদনশীল, সরল সুন্দর, গভীর চোখে-ধ্যানে এই ভূমিকে আত্মস্থ করেছেন। তিনি এই অঞ্চলে প্রাচীন গ্রিসের সক্রেটিসের মতো আমাদের বুকে জ্বালিয়ে দিয়েছেন জ্ঞানের তৃষ্ণা, শ্রেণি বুঝতে পারার ক্ষমতা। যে সামন্তীয় শ্রেণি হাজার বছর ধরে শোষণ করে যাচ্ছে তার অধীনস্থ শ্রেণিকে, কৃষক, কামার, জেলে, জোলা, কাঠুরে, কামলাদের। যারা চাষ করে, শ্রম দেয় তারা তুলতে পারে না শ্রমের ফসল, সামন্ত জমিদারদের গোলা ভরিয়ে দিতে হয় তাদের নিজের শ্রম দিয়ে। এই যে শ্রেণি বুঝেছি, শহীদ সাবের না হলে এটি কখনো আমরা বুঝতে পারতাম না। আমি মনে করি, আমরা যারা এই অঞ্চলে শিল্প চর্চা করি, তাদের জন্য এটি সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। শ্রেণিসম্পর্ক বুঝতে পারা। এ ক্ষেত্রে শহীদ সাবের প্রাচীন ঋষি-মুনির মতোই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ গুরু। কেননা, বেঁচে থাকলে কী হতো বা রাষ্ট্র টিকলে কী হতো, সে ভবিষ্যৎ আমার দেখার দরকার নেই। তাঁর সময়ে তিনি লড়াইটা করেছেন। আমি শুধু সেটি দেখব। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সে লড়াই নিজের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির মুক্তির প্রশ্নে। তারপর, তার সময়ের কমরেডরা সবাই নিজ নিজ বিষয়ের ষোলোআনা বুঝে নিয়েছিলেন। তিনিই শুধু রয়ে গেলেন একা, অকৃতদার। শহীদ সাবের মানব মহত্ত্ব ও মানুষের মুক্তির প্রশ্নে কোনো আপস করতে পারলেন না। তিনি তখন নিজ গ্রাম ছেড়ে কলকাতা, চট্টগ্রাম হয়ে তার সময় ও বিশ্বকে ধরতে চেষ্টা করেছেন। তিনি তখন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কমরেড। 

আমাদের অঞ্চল ছিল মাছ শিকার, চাষ, লবণ উৎপাদন, বৃক্ষ, কাঠ এই সবে উৎসারিত। দরিদ্র, অভাব, ঝড়, তুফান, রোগে-শোকে জীর্ণ, শীত ও গরম সামলাতে না পারা ইত্যাদি প্রাচীন, আধুনিক-উত্তর ঔপনিবেশিক বেদনায় দগ্ধ, কোনো গতি ছিল না। বিকাশের ধারা ছিল স্থবির। মার্কস ভারতবর্ষের গ্রাম সম্পর্কে যা লিখেছেন ঠিক তাই। এই টার্মগুলো বুঝতেও আমাদের সময় লেগেছে অনেক। এই অঞ্চলের লোকমানুষের প্রাচীন প্রতিবাদের ভাষা শ্রেণির প্রশ্নে বুঝে শহীদ সাবের গড়ে উঠেছিলেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তা নাহলে এত কম বয়সে কীভাবে তিনি মার্কসবাদকে বুঝেছিলেন। তিনি তার বাবাকে বলেছিলেন, ‘আমি শুধু আপনার ছেলে নয়, দেশেরও। সে সময় এই বোধে পৌঁছাতে পারা কতটা পড়াশোনার ব্যাপার, এখন আমরা বুঝতে পারি। মাত্র ১৬ বছরের তরুণ শহীদুল্লাহ সাবের।

সাতচল্লিশের দেশভাগ, একাত্তরের বাংলাদেশের স্বাধীনতাসহ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও কত পরিবর্তন হয়ে গেল। আমার বাবার জন্ম পাকিস্তানে, দাদার জন্ম ব্রিটিশ ভারতে, আমার জন্ম বাংলাদেশে। শহীদ সাবেরের জন্মও পাকিস্তানে। পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রীয় কোনো কিছুই মীমাংসা হয়নি তখনো। অথচ পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। এই অমীমাংসিত রাজনীতির শিকার হলেন শহীদ সাবের। বিনা বিচারে তাকে জেল খাটতে হয়। এই বেদনা সারা জীবন বহন করেছেন শহীদ সাবের। রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সমাজ ও পরিবারে কোনো কিছুই ভালো শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল। শহীদ সাবের সামন্তীয় এই রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রথম শিকার হলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামন্তীয় অবশেষ থেকে যাওয়া—এই সব লোক পুঁজির ঘনায়মান বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে লুফে নিলেন। করপোরেট ডেভেলপ করল। ব্র্যান্ড ও বেদনায় ভরে গেল দেশ। বিপ্লবীরাও ছিটকে পড়ল। এই মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে যারা বেড়ে উঠেছিল—অভাব, দারিদ্র্য, শঙ্কা, ভবিষ্যৎ আশঙ্কা- তারা ব্যাংকে ডিপিএস, ব্যবসায় লগ্নি করল। তাদের হাতে নগদ টাকা এলো। টাকা আসার পর মানুষের জীবন আগের মতো থাকল না। টাকার দাপটে যে মূল্যবোধ জন্ম নিল, তাই প্রতিষ্ঠিত হলো সমাজে। পরবর্তী সময়ের প্রজন্মও টাকার পেছনে ছুটতে লাগল। তারা জানেই না, আদর্শবাদী, কল্যাণকামী, মার্কসীয় দর্শন ও রাজনীতি কী? সময় ও রাষ্ট্র মানুষের মুক্তির প্রশ্নে প্রতারণা করল। 

ভারতের প্রাচীন আর্য ঔপনিবেশিক থেকে শুরু করে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমল পর্যন্ত বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে একটি বহুবর্গীয় সমাজ। যা শ্রেণি প্রশ্নে কোনো ছাড় দেয়নি। গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান এ ছিল শুধুই একটি শ্রেণির, সমগ্র শ্রেণির নয়। তাই বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে তৈরি হয়েছে শঙ্কর সংস্কৃতি, রয়ে গেছে অভাব, দারিদ্র্য, জীর্ণ-শীর্ণ জীবন, ভিক্ষুকে ভরা, বিভক্ত; যা মানসিকভাবেও ছিন্নভিন্ন, আঘাতপ্রাপ্ত, দহনে দগ্ধ, ক্ষরণে বিমর্ষ, রক্তাক্ত। অনেক যুদ্ধ, লড়াই, ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র রক্তপাত সইতে হয়েছে এ দেশকে। শহীদ সাবের এসব বুঝতে পেরেছিলেন খুব অল্প বয়সে, তাই তিনি দর্শনের প্রশ্নে কোনো আপসকেই মেনে নিতে পারেননি। সমাজ তাকে পাগল বানিয়েছে, পাগল বলেছে। কিন্তু ওই সমাজের জন্যই পাগলের বেশ ধারণ করেছিলেন তিনি। যেহেতু সমাজে তিনি অচ্যুত হয়ে উঠেছেন, তাই প্রকৃতি তাকে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুক্তি দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা একদিকে শহীদ সাবেরের মতো কমরেডদের বন্দিজীবনের আখ্যান, আরেক দিকে শহীদ সাবের মুক্তি ও মর্যাদার স্বাগত উত্থানও। দাসজীবনের চেয়ে স্বাধীন মৃত্যু অনেক শ্রেয়। যেহেতু কায়েমি স্বার্থবাদী কমরেডদের দ্বারা বিপ্লব সম্পন্ন হলো না, যে যার অবস্থান থেকে আপস করে ফেলল, শহীদ সাবের জেলখানা থেকে বের হয়ে এসব দেখে পাগল হয়ে গেলেন। ব্যক্তি সম্পদের মোহে নিমজ্জিত সংসারী কমরেডগণ বিষয়টি বুঝতেই পারেনি। তাঁকে চিকিৎসা না করে পাঠিয়ে দিলেন পাগলা গারদে। এ হচ্ছে এক বড় ট্র্যাজেডি। ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ সিনেমা থেকে সহকারী পরিচালক হিসেবেও তার নাম বাদ দিয়ে দিলেন। অথচ তিনি ছিলেন ওই টিমের একজন সক্রিয় সদস্য। শহীদ সাবের অনেক অবহেলার শিকার হলেন। তবু তিনি আঁকড়ে রইলেন মানব-মুক্তির পথ, মার্কসীয় অভীজ্ঞা, প্রগতি, সৌন্দর্য চেতনা। শিল্পের সাধনায় উৎসর্গ করলেন নিজের জীবন। ‘মিলান কুন্ডেরা (চেক শিক্ষায় শিক্ষিত বলে) প্রথম লেখেন, যিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে সব স্থানেই তরুণদের ওপর সাম্যবাদ একধরনের প্রবল আকর্ষণ প্রয়োগ করে, যার কারণে তার দুর্বোধ্য বস্তুবাদী দর্শন নয়, কিংবা অর্থনীতির ওপর মার্কসের গভীর ও স্থায়ী পর্যালোচনাও নয় বরং এই কারণে যে তা প্রদান করে সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কগুলোর শুদ্ধতা, মানবজাতির মৌলিক উৎসে প্রত্যাবর্তন। তরুণ হিসেবে শহীদ সাবেরকেও এই উৎসে ফিরতে প্রেরণা দিয়েছিল মার্কসবাদ। (ফ্রিদা কাহ্লো, কিছু কথা ও ডায়েরির পাতা, ভূমিকা কার্লোস ফুয়েন্তেস, রচনা অংশ অনুবাদ: জাকিয়া রহমান ঋতা, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর-২০১৭, পৃ. ৩০)


শহীদ সাবেরের জীবন একটি বেদনার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, সামাজিক মুক্তি, সামাজিক সাম্য, শ্রেণির মুক্তিসহ তিনি প্রবলভাবে চেয়েছেন; একটি মানবিক রাষ্ট্রের বিকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সৌন্দর্যের মহিমা। সেই মহিমা, যা মানবজাতিকে মহিমান্বিত করবে মহত্ত্বের সংবেদনে, মুনাফা নয়, লাভ নয়, সহযোগিতা আর দায়িত্ব হয়ে উঠবে মানবসমাজের প্রধান অঙ্গীকার। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদের রাষ্ট্রীয় অবশেষ, অজ্ঞতা ও অবিবেচনাসহ ঘটনার আকস্মিকতার শিকার হন শহীদ সাবের। এই রাষ্ট্রীয় আবেশ তাঁর লড়াই ও বিকাশকে রুদ্ধ করে দেয়। যে বয়সে পুরুষ ভালোবাসে নারীকে, সে বয়সে শহীদ সাবের গ্রহণ করেছিলেন মানবমুক্তির পথ, সেই পথে নেমেছিলেন তিনি, ভালোবেসে ছিলেন দেশ তো বটেই, মানবজাতির মুক্তি, দায়িত্বও নিয়েছিলেন। তার প্রিয় প্রেমিকা ছিল—বিপ্লব। এ ছাড়া কোনো কিছুকে তিনি ভালোবাসতে পারেননি। আর সেই বয়সে তাকে কাটাতে হয় জেলখানায়। তাই-ই তার জন্য কাল হয়—সেনেকার ভাষায়: ‘সময়ের পাখা কোথায় কীভাবে উড়ে যায়, সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না, নিয়তি দ্রুত ধেয়ে চলে, কোনো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না সে’। শহীদ সাবের, মানবতন্ত্রে বিশ্বাসী খাঁটি দরবেশ, দুঃখী সাবের বুঝতেই পারেনি মুক্ত জীবনের রূপ-রস-গন্ধ কী? কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে কেটেছে তার সৃষ্টিশীল জীবন। কিন্তু মহৎ দর্শন সামনে থাকলে জীবনের গতি আর স্বপ্ন মরে না, বরং নতুন করে মনকে দীপ্ত ও দীপ্র করে তোলে, শহীদ সাবের আমাদের সামনে তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। রাশিয়ায় বিপ্লব সম্পাদিত হয়েছে, পৃথিবীর দেশে দেশে বিপ্লবের বেদনা বুকে নিয়ে মানুষ মানবমুক্তি ও মহত্ত্বের স্বপ্নে জোট বেঁধেছে। মানবজাতির বিকাশের ধারায় মানুষ দুটি বিশ্বব্যবস্থাকে দেখেছে। মানুষের মুক্তির প্রশ্নে বিপ্লব আপসহীন থেকেছে, যদিও তা বুর্জোয়া বিকাশের প্রবল স্রোতে টিকতে পারেনি। তাই বলে মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। পুঁজির বিকাশে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদের স্বার্থপর জন্ম একটি বড় বিপদ তৈরি করেছে। মানুষের প্রবল ব্যক্তিসম্পদের মোহ। বিপ্লব স্থগিত হয়ে পড়ার কারণে মানুষের আদিম ইন্দ্রিয় লোভ, সঞ্চয় প্রবণতা, ব্যক্তিসম্পদ অর্জনের মোহ এমনভাবে মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে, যেন ব্যক্তিসম্পদ অর্জনই মানুষের একমাত্র দর্শন ও আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই লোভ সামালানো এই সমাজে মুশকিল। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ ঘটেছে, যা বিকাশের প্রশ্নে উল্লম্ফনই বলা যায়। কোনো মহৎ লড়াই বা সংগ্রাম না করে এ যুগে শ্রেণির মানুষ থেকে শুরু করে শ্রমিক শ্রেণির মানুষও হিরো বা সেলিব্রিটি হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, এ অজ্ঞতার শেষ কোথায়? যেন বর্তমান যুগ সেলিব্রিটি হওয়ার যুগ, খ্যাতি তার চাই-ই চাই, কিন্তু খ্যাতি তার কিছুই জানে না। এটিই এখন উন্নত নামের দেশসমূহের নতুন প্রহসন, নতুন ঝামেলাও। তারা ভেবেছিল এই মিডিয়ামাধ্যম দিয়ে পৃথিবীকে বস করে রাখবে, সম্পদের মতো সব খ্যাতি-প্রশংসাও তারা নিজের করে নেবে, শুষে নেবে, কিন্তু! এখন সাধারণ মানুষও তাদের খ্যাতিতে ভাগ বসাচ্ছে। এই উটকো ঝামেলা থেকে তারা মুক্ত হতে পারছে না, চাইলে তো সব হয় না; এই মাধ্যমের বাণিজ্যই বন্ধ হয়ে যায়। কোটি কোটি ডলার তারা লগ্নি করেছে এই খাতে, সেই টাকা তো তুলতে হবে। পঙ্গপালের মতো এই মাধ্যমে ঝাঁপ দিয়েছে পিপল-জনতা। যারা কখনো নাগরিক হয়ে উঠতে পারেনি। স্বার্থপর ও লগ্নিকৃত পুঁজির সামাজিক বিকাশ সমাজব্যবস্থাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। সমাজ আজ কোথায় দাঁড়িয়েছে, কোনো মহৎ আদর্শ কি নেই, যা নিয়ে সমাজ এগিয়ে যাবে? বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় মহৎ আদর্শ আছে কি? যদি থাকে সেই পথে আমরা হেঁটে যেতে প্রস্তুত। বর্তমান বিশ্বে ‘মানবিক ও রাজনৈতিক পুঁজির ক্ষতিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।‘ শহীদ সাবের তাই বলতে চেয়েছেন।

‘কনটেন্ট’ ও ‘ভাইরাল’ শব্দগুলো এখন বেশ জনপ্রিয়—মানুষের মুখে মুখে। সমাজে এত প্রতিভা লুকিয়ে ছিল গত শতকেও কেউ কল্পনা করেনি। এখন তোমার টিউব, ফেসবুক, টিকটকের কল্যাণে প্রতিভা নামে প্রহসনের ছড়াছড়ি, লোকে বলে তামাশার ছড়াছড়ি। আর রাজনৈতিক আনুগত্য নিরঙ্কুশ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যে যেখান থেকে পারে ব্যক্তিসম্পদ অর্জন করছে। কনটেন্ট ও ভাইরাল, তোমার টিউব, কী খবর, টুইটার, টিকটক, টাম্বালার, এআই-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ এসব পুঁজিবাদী ফাঁদে মানুষ মোহাচ্ছান্ন হয়ে পড়েছে। মানুষের ধর্মীয় মন পড়ে আছে মধ্যযুগে, মানুষের আধুনিক সাম্প্রতিক মন ঘুরছে ইথারে এবং মোবাইলের পর্দায়—দৃশ্যমান হচ্ছে নিজের মূর্তি ও অন্যের মূর্ত বক্ষে, সৃষ্টিশীলতা নেই। ‘দেখুন টিকটক, রিল, ইউটিউব’। আধুনিক পুঁজি ছড়িয়ে দিয়েছে নার্সিসিজম। কে শুনে কার কথা, এখন সবাই নার্সিসিস্ট। এ সামাজিক রাষ্ট্রিক বৈশ্বিক নতুন যুগের পর্বে মানুষের আর কী লাগে? স্বর্গীয় সব প্রতিশ্রুতি সে তো দুনিয়াতেই পেয়ে যাচ্ছে। সমাজ বিকশিত হয়েছে পুঁজির নির্দেশিত তৈরি করা লোভ ও অজ্ঞতার পথে। 

এই উত্তর ঔপনিবেশিক কালে আধুনিকতার সমৃদ্ধি, বেদনা ও মহিমা বুকে নিয়ে জীবন আর সমাজের সঙ্গী হওয়া সহজ কোনো কাজ নয়, এটি প্রমিথিউসের আগুন চুরির চেয়েও কঠিন সাহসের ব্যাপার। জীবনের এই সৃষ্টিপথে ধরা পড়লে আধুনিকতার লোহার শিকলে এমনভাবে বন্দি হতে হবে, এমন শাস্তি পেতে হবে; তার কোনো দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আগে কেউ দেখেনি। ডান্ডাবেড়ি ও শিকলের টুংটাং শব্দে সচকিত হওয়া যাবে না, পেছন থেকে পড়বে বেতের বারি অথবা পাছায় নিষ্ঠুর থাপ্পড়, লাথি। গরিবের শত্রু গরিব, তা নাহলে গরিব সৈনিক, পুলিশ, চৌকিদার, পাহারাদার তার শ্রেণির মানুষটিকে ওপরওয়ালা বা মালিকের হুকুমে এমন অভব্য আচারণ করে, যা শতাব্দী থেকে শতাব্দী আমরা দেখেছি আর সহ্য করে গেছি। অ্যালেক্স হেলির ‘দ্য রোড’ অনুবাদে ‘শেকড়ের সন্ধানে’, এই অসাধারণ মানবদলিল থেকে জানতে পারি, হেলির পূর্বপুরষ কুন্টাকিন্টের কাহিনি। কী নির্দয় ও নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিল তারা শতাব্দী থেকে শতাব্দী। এই নিষ্ঠুর আচরণে হিংস্র গরিব মানুষটি কয়েদি গরিব মানুষটির প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারে না। তাহলে দুজনের মরতে হয়। সে ভাগ্য গরিব কয়েদি, বড়লোকের পাহারাদার, সচেতন বিপ্লবী, বিদ্রোহী, প্রতিবাদী মানুষগুলোর কপালে কখনো জোটেনি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এ পৃথিবী একবার পায় তারে পায় নাকো আর। ‘শহীদ সাবের তিনি জীবনের পানে চোখ তোলে চাইবে, কী বিষাদ অভ্যর্থনা সে পেল ঘরে ফিরে’।

হৃদয়ের অনুভব যদি খাঁটি হয় তাহলে লেখার বিষয়টি অনেক অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। শহীদ সাবেরকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমাকে এখন নতুন সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। শহীদ সাবের ছিলেন হৃদয়ের অনুভবে খাঁটি মানুষ, সত্যিকারের গিনি। কয়েকটি শতাব্দী জীবন আর শিল্পের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন যুগ হিসেবে কেটে গেল। জীবন ও শিল্পের আসল আর নকলের মধ্যে কোনো তফাত রইল না। সবার ঘর একই পণ্যদ্রব্য নিয়ে সাজানো, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া একই রকম কিসেন, ড্রয়িংরুম, একই রকম টয়লেট, একই রকম বেডরুম, ওয়ালে যে ছবিটি টাঙানো তা আসল না নকল (প্রিন্ট) সেটিও বোঝা যায় না। সে বিষয়টি নিয়ে জর্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেনযামিন ‘শিল্পকর্মের অরা এবং তার অবক্ষয়’ নামে (অনুবাদ শংকর কুন্ডু, চিরঞ্জীব শূর সম্পাদিত, ফ্রাঙ্কফুট স্কুল, প্রকাশক আলোচনা চক্র, ২০১৩, কলকাতা, ভারত পৃ. ১৬৬) অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছেন। শিল্পের সেই মাহিমাকে তিনি ‘অরা’ হিসেবে চিহ্নিত করলেন। কিন্তু কথা সেটি নয়, কথা হচ্ছে এই পরিবর্তন শিল্পকে কোথায় নিয়ে গেল। যারা শিল্পের জন্য শিল্প, শুদ্ধজীবন বাস্তবতার কথা বলছেন তারা বুঝতেই পারেননি- তাদের শিল্পের জন্য শিল্পকে বুর্জোয়া শ্রেণি কীভাবে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছে। কীভাবে লুট করে নিয়েছে তাদের সংবেদন। ওয়াল্টার বেনযামিন লেখেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ঘটল প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদন শিল্পকর্মকে পরনির্ভর বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যবহারযোগ্য বস্তু থেকে প্রথানির্ভর পর্যন্ত সব রকম অর্থ থেকে বিযুক্ত করল। ক্রমই যেটা দাঁড়াল: যে বস্তু পুনরুৎপাদিত হচ্ছে, তাকে এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যাতে সেটা পুনরুৎপানযোগ্য হয়। যেমন ছবির প্লেট যত খুশি সম্ভব নকল ছাপানো যায়; তার মধ্যে ‘প্রামাণিক ছাপা কোন কপিটা, এ কথা জিজ্ঞেস করার মানে হয় না। কিন্তু শিল্পকর্ম থেকে প্রামাণিকতার ব্যাপরাটি লোপ পেল, শিল্পের সমস্ত সামাজিক ভূমিকার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটল। প্রথানির্ভরতার পরিবের্ত শিল্প অন্য কাজে ব্যবহৃত হতে লাগল। সেটা হলো: রাজনীতি (পৃ. ২৪-২৫)। (শিল্পকর্মের অরা এবং তার অবক্ষয়: ওয়াল্টার বেনযামিন যেভাবে বলেছেন, অনুবাদ: শঙ্কর কুন্ডু, ফ্রাঙ্কফুট স্কুল, সংকলন: চিরঞ্জীব শূর, পৃ. ১৭৪) শিল্পী যতই তার শিল্পকর্মকে অরাজনৈতিক ঘোষণা দিন না কেন, তাতে কোনো লাভ হলো না। তাদের সেই সুকুমার সৌন্দর্যবোধ, শিল্পবোধ দখল করে নিল বুর্জোয়ারা এবং তারা তা ব্যবহার করল রাজনীতিতে। তাই মার্কসবাদীরা তাদের স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক ঘ্রাণশক্তি, অনুভূতি, সংবেদনা দিয়ে বুঝেছিলেন, শিল্প রাজনীতির বাইরে বিষয় বা বিষয়ী নয়। তাই তারা রাজনীতির ভেতর থেকেই তার সমাধান খুঁজতে চাইলেন। কোনটি সবচেয়ে ভালো পথ, তারা পেয়ে গেলেন মার্কসীয় অভীজ্ঞায়, শহীদ সাবের সেই অভীজ্ঞার অনুজ্ঞা, সেই স্বপ্নের সূত্রধর, শিল্পী।

এই সময়ে শিল্পের যে যুগ শুরু হলো, সে বিষয়টি একটু আগেও আমি উল্লেখ করেছি—জগতের আরেক অধ্যায় লাইভ, টিকটক, ফেসবুক, ইউটিউভ, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ইমু, ভাইভার, কত কী! আধুনিকতা, পরাবাস্তবতা, উত্তরাধুনিকতা, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা এখন এসবে লেপ্টে গেছে। এখন ঘরে বসে বলতে পারি, দেখতে পারি, হেঁটে হেঁটে হাতের মুঠোয় কানাডা বাংলাদেশ, দূরপ্রাচ্য, দূর ইউরোপে মুহূর্তে সময়ের ব্যবধান সত্ত্বেও কথা বলতে পারি। টয়লেটে বসে সুদূর আমেরিকাকে দেখা যায়, কথা বলা যায়, হাতের মুঠোয় আঁকা যায় সময়ের উলকি। এই সময়ে কবিতা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন বিষয়ে এত বেশি লেখা হয়েছে, এত কথা বলা হয়েছে—শহীদ সাবেরকে নিয়ে আমি নতুন করে কী বলতে পারব। তবুও মনে মনে ধ্যান করি। ঢাকা শহরের গাড়ির সাউন্ড, ফুটপাতের দুর্গন্ধ, সাব অলটার্ন মানুষের বেদনাভরা মুখ, ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক মহিলা, রাস্তায় পেশাব করা ভদ্রলোক, মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া নাগরিক মুসল্লি, মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়া মানুষগুলো, করপোরেট সুফি, ফাইলপত্র, প্রজেক্ট, মগজ, গাড়ির হর্ন, টাইস্যুট, ভাসমান যৌনকর্মীদের আহ্বান, মসজিদের যত দরজা তার চেয়ে বেশি ভিখারি, বাজার, মেগা স্টোর, রাজনৈতিক দলের মিছিল, কাচের শপসহ নগর বাঁচে নগরের মহিমায় আর আমি বেঁচে থাকি পেটি বুর্জোয়া খায়েশে এই আধুনিকতার মহিমা, এই আধুনিকতার বেদনা। নগরে সিনেমা নাটক, পুলিশ, রেব, লিটলম্যাগ, দৈনিক পত্রিকা, কবিতা, সেমিনার, অনুষ্ঠান—আহা, নগরের নতুন নতুন অরা। অধ্যাপক, মডেল, রাজনৈতিক, নিগার, নায়ক-নায়িকা, কবি, লেখক, গবেষক, নাট্যকার, ডিরেক্টর এত এত মেধাবী বিশেষজ্ঞের ভিড় তুলনাহীন শহর। পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের ঢাকা শহরের তুলনা নেই। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বদলে- প্রযুক্তি ও প্রলোভন আমাদের মথিত করে রেখেছে। নতুন বাস্তবতা নতুন চাহিদাও তৈরি করেছে করপোরেট গার্ল, অফিস গার্ল, কল গার্ল, ক্যাসিনো ইত্যাদি। প্রত্যেক বিল্ডিংই টাইলস করা, ঝকঝকে, তকতকে, তাকে পরিষ্কার করে রাখে কাজের বুয়া নামে গ্রামের হতদরিদ্র নারী। সেই নারীটিকে আবার বাংলার সুশীল মালিক গৃহস্থ ও গৃহিণীরা লিফটে চড়তে দেয় না। কী নিষ্ঠুর আমাদের সামাজিক নৈতিকতা। ঢাকা শহরে কোনো বিল্ডিংয়ের নাম বাংলায় লেখা নেই, খুব কম। আমরা সময়ের দিক থেকে আধুনিকতায় পৌঁছেছি, মনের দিক থেকে ঔপনিবেশিক ও মধ্যযুগে বাস করি। মধ্যযুগ পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে আমাদের মন, ভারতীয় বৈদিক মন তারও পূর্বে বাস করে, রামায়ণ ও মহাভারতের যুগে। সে মনের উদ্ধার কী? আমাদের নারীরা মস্তিষ্ক উন্মোচনের আগে বক্ষ উন্মোচন শুরু করে দিয়েছে। আমাদের পুরুষদের ক্ষমতার পূজা দাস যুগকেও হার মানিয়েছে। আমাদের মনে হাজার হাজার ‘অরা’।

এই শহরে আকাশ ও দিগন্ত দেখতে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু আপনি দেখতে পাবেন বড় বড় ফ্লাইওভার, ওভারব্রিজ, বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি, শত শত রিকশা, বাজারে গেলে দেখতে পাবেন ডজন ডজন মুরগি কিনছে টাইস্যুট পরা দশসাই লোক, দশ-বারো (১০-১২) কেজি করে গরুর মাংসে বাজারের থলিতে ভরছে, তার কাছে হাত পাতছে অনেক ভিখারি, পথে পড়ে আছে যুবতী-শিশু—শিশুটিকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে মা। মানুষের পিপিলিকার মতো মিছিল। এই শহরে এত ধনী এবং এত ভিখারী কোথা থেকে এলো ভাবতে অবাক লাগে। এই উন্নয়ন বাস্তবে গর্ব করার মতো। ধানমন্ডিতে এক সমাজ, কামরাঙ্গীরচরে আরেক সমাজ। কামরঙ্গীরচরে উঠতি পয়সাওয়ালার রমরমা অবস্থা আর ধানমন্ডি, উত্তরা, বনানীতে পয়সাওয়ালাদের আরেক ধরনের রমরমা, বেদনাদায়ক অবস্থা। মাদক, নারীবাদ, রেস্টুরেন্ট, ড্যান্স, পার্টি, ক্লাব, সিসা, পরকীয়া, সমকামীতা, ডিপিএস, লোন, রাজনীতি, প্রজেক্ট, তিন চারটা গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, ট্যুর, ছেলের একটা, মেয়ের একটা, মায়ের একটা আহা, ধনতন্ত্র কি আহ্লাদের জীবন। একুশে বইমেলা, পয়লা বৈশাখ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, চিত্রকলা প্রদর্শনী, সেমিনার, মিটিং, বাজেট, সম্মানী, ভাতা। নাগরিক জীবনের কি শৈনঃ শৈনঃ বিকাশ। রাজনৈতিক ডিজিটাল বিলবোর্ডে নেতাদের পালিশ করা মুখ, ঢাকার সব ওয়াল পোস্টারে ভরা, চোখ যেন পারে না আর দেখতে তবুও উপায় নেই, দেখতে হবে। কিছু দূর বাস চলল, আবার বন্ধ, জ্যামে পড়েছে, আবার কিছু দূর বাস চলল, কী হয়েছে মন্ত্রীর গাড়ি যাচ্ছে সব রাস্তা বন্ধ। ফুটপাত দখল রেখেছে হকার, সবখানে অচল অবস্থা। প্রচুর গরম, শীতেও ঘেমে যায়। হাসপাতালে রোগীর জায়গা নেই, বারান্দা, ব্যালকনি যেখানে পারছে সেখানে রোগীকে রাখা হয়েছে।  

এই যুগ হচ্ছে আয়নায় দেখে নিজের মুখে নিজে থুতু দেওয়ার যুগ। সবাই হিরো। এখানে আলাদা কোনো হিরো নেই। সবারই প্রচার মাধ্যম আছে। কে কখন টয়লেটে গেছে, তা-ও মানুষ মুহূর্তে খবর পেয়ে যায়। মানুষ ম্যাডম্যানের (পাগলের) নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। নতুন মন্তব্যে সয়লাভ জগৎ। পান থেকে চুন খসলেই সেটা খবর হয়ে ছড়িয়ে (ভাইরাল) পড়ে। তাই এখন কথা বললে ভেবেচিন্তে বলতে হয় না, বলে দিলে হয়। এই নতুন যুগের জ্ঞাত বা অজ্ঞতা কী? সেই অজ্ঞতা কেউ ধরতে পারছে না। নিৎশে ঘোষণা করেছিলেন- ঈশ্বর মৃত, ঈশ্বর মারা গেছেন। আমরা কি বলতে পারি না শহরগুলো মরে গেছে, আধুনিকতা মরে গেছে। কীভাবে মরল। মরল ধনতন্ত্রের আদর্শে-বিকাশে-উৎকর্ষে। ধনতন্ত্রের বিকাশ মানে নাগরিকপনায় ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, নিষ্ঠুরতা, লোভ, লালসা আর ক্ষমতার কাছে মাথা নত করা। গণতন্ত্র যেহেতু সম্পত্তির মালিক শ্রেণির তালুকে পরিণত হয়েছে, তাতে আর কি। নিজের বিবেকের আয়নায় কেউ এখানে নিজেকে দেখার সুযোগ পায় না। গ্রাম এবং শহরে ক্ষমতার পূজা ছাড়া মানুষ আর কিছুই করে না। তাহলে বইপত্রে, ধর্মে, নৈতিকতায় যা যা বলা হয়েছে, সব কি মিথ্যে! হাদিসে আছে, কেয়ামতের দিন যার যার বিষয় নিয়ে মানুষ এতই ব্যস্ত থাকবে কেউ কারও দিকে থাকাতে পারবে না, কেউ কারও খোঁজ নিতে পারবে না, সবাই নিজের পাপ, অপরাধ নিয়ে আতঙ্কে ভয়ে তটস্থ থাকবে। পুঁজিবাদের যুগে এই হাদিসটি আংশিকভাবে ফলে গেছে—এই যুগে এখন যে যার ব্যক্তিসম্পদ আহরণ ও জমা করতে এত ব্যস্ত- কেউ কারও দিকে ফিরে তাকাতে পারে না। প্রতি সেকেন্ডে শুধু লাভের হিসেব। আপনি মানেন কি না মানেন তাতে কিছু যায় আসে না, আমরা এখন মুনাফার যুগ পেরিয়ে, ব্যাংকে টাকা জমানোর যুগ পার হয়ে- ব্যক্তিগত বিনিয়োগের যুগে পেরিয়ে, সিন্ডিকেট বিনিয়োগের যুগে প্রবেশ করেছি। যাদের মাথায় চব্বিশ ঘণ্টা মুনাফা, মুনাফা। এ অবস্থায় খাঁটি গিনি কি, তাকে পরখ করবে কে? মহান ইকবালের ভাষায়- যেমন:

খাঁটি গিনি, তাঁকে পরখ করবে কে
তত্ত্বে দড়, কিন্তু কেউ তো প্রমাণ করার নেই—
ব্যাকুল শ্বাসের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক
হারিয়ে যাওয়া পথিক হারান আপন পথের খেই।
(জাভেদনামা-মুহাম্মদ ইকবাল, অনুবাদ: শঙ্খ ঘোষ, নীৎসে আর ইকবাল, পৃ. ৯ এবং মুশায়েরা- ইকবাল সংখ্যা)

সারা জীবন বেদনা বহন করেছে শহীদ সাবের। খাঁটি গিনি হতে চেয়েছিলেন, কলঙ্ক নিয়েও শুদ্ধতম স্বপ্ন বহন করেছিলেন। বেদনা কি ব্যক্ত করতে পেরেছিলেন তিনি। বেদনা কি ব্যক্ত করা যায়? নিজের ভেতর নিজেকেই সেধিয়ে যেতে হয়। সমাজ তাকে আরও কোণঠাসা করে ফেলে। ঝিনুক মুক্তা গলাতে গিয়ে যেমন চূর্ণ হয়ে ওঠে- বেদনা নিঃসঙ্গ করে তোলে বেদনার সঙ্গীকে। জেলখানার বন্দিজীবন থেকে শুরু করে পৃথিবী কারাগারের বন্দিজীবন পর্যন্ত তার বেদনা তাকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে রেখেছিল। এই দহন কীভাবে সহ্য করবেন তিনি। বেদনা ধ্বংস করে দেয় ভাষাও। ‘একটি বিখ্যাত পৃষ্ঠায় নিৎসে বলেছেন, তিনি তাঁর বেদনাকে ‘কুকুর’ নামে অবহিত করার সিদ্বান্ত নিয়েছেন। এটি সমানভাবেই বিশ্বাসী, নিজেকে নজরে আনে না এবং নির্লজ্জ, এটি সমানভাবেই মজার সঙ্গ দেয়...এবং আমি একে তিরস্কার করতে পারি আর আমার সমস্ত বদমেজাজ নির্গমন করতে পারি তার ওপর দিয়ে।’ (বেদনা: যা জীবনকে হত্যা করে- ফ্রিদা কাহ্লো, কিছু কথা ও ডায়েরির পাতা, ভূমিকা- কার্লোস ফুয়েন্তেস, রচনা অংশ অনুবাদ: জাকিয়া রহমান ঋতা, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর-২০১৭, পৃ. ২২) 
শহীদ সাবেরের পাগলামির ধরনকে আমরা কীভাবে শনাক্ত করব। গতানুগতিক ভাষা দিয়ে, অনুভব দিয়ে...’ চিন্তা দিয়ে বা ব্যক্তিগত সম্পদে যাপিত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে, তাহলে শহীদ সাবেরের প্রতি সুবিচার করা হবে না, আমরা এই বেদনার নাগালই পাব না, পাইওনি। আমরা তাকে মিথ করে একটি মিথ্যাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছি, এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। যে সমাজ আবরণের ওপর নিজেকে বিকশিত করে সেই সমাজ শহীদ সাবের চাননি। এই প্রতারণার সমাজ শহীদ সাবের প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার বেদনা ছিল সামষ্টিক সুন্দরের জন্য যা ব্যক্তিগতভাবে জন্ম নিলেও দর্শন-চৈতন্যর মাধ্যমে সামষ্টিক কল্যাণ ও রক্তাক্ত অর্জনে প্রলেপিত হয়, আর সমাজকে বুঝতে শেখায়।

‘আমাদের সকল ইন্দ্রিয়ের মধ্যে দৃষ্টি সবচাইতে স্বচ্ছ, লিখেছেন প্লাটিনাস, কিন্তু এরপরও সেটি আত্মাকে দেখতে পায় না। এবং এটা এই জন্য যে, তিনি সংযোগ করেছিলেন, যদি আমরা আত্মাকে দেখতে পাই, তবে তা আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলবে এক ভয়ংকর প্রেম, এক অসহনীয় ভালোবাসা। একমাত্র সৌন্দর্যের রয়েছে অন্ধ না হয়ে আত্মাকে দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য।’ প্লাটিনাসের এই কথাটিই শহীদ সাবেরের জন্যই প্রযুক্ত। শহীদ সাবের সৌন্দর্যের চোখে, শিশুর চোখে পৃথিবীকে দেখেছিলেন এবং ভয়ংকরভাবে পৃথিবীকে ভালোবেসেছিলেন


শহীদ সাবের বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতার অমৃতের সন্তান। কক্সবাজার তথা দরিয়ানগরের এ যাবৎ কালের সৃষ্টিচেতনা, সভ্যতার মহত্ত্বকে উপলব্ধি করতে পারা, মানবিক দর্শনের উঁচুস্তরের মানুষের জন্য, মানবিক সাম্যের আনন্দ, বেদনা ও উৎসবের জন্য যে পৃথিবী অপেক্ষা করেছিল, সে পৃথিবীর পরিশীলিত বোধিসন্তান, কক্সবাজারের ভূমিপুত্র। শহীদ সাবের নামটি এমন মহত্ত্বকে ধারণ করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন সরল, মানবিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক বুঝে, তা ভেঙে, যে ছেলেটি পৃথিবীর সন্তান হতে চেয়েছিল, শুধুই মানবসন্তান, সেই মহৎ সন্তানটির নামই হলো শহীদ সাবের। আমাদের বুঝতে হবে যে, মহত্ত্ব গাছেও ধরে না, আসমান থেকেও পড়ে না, মহত্ত্ব শিখতে হয়। মানবিক বোধ, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, দর্শনসহ নানা ইজম থেকে মহত্ত্বকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। শুধু উপলব্ধি করলে হয় না, তার জন্য লড়াইও করতে হয়। 

শহীদ সাবেরের সময়ে শ্রেণি বুঝতে পারাও ছিল অনেক কঠিন- যা বোধ, বোধিসত্তা, চৈতন্য ও চিন্তার ব্যাপার। শহীদ সাবের তখন রীতিমতো শ্রেণি সংগ্রামের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি মনে করি বঙ্গোপসাগরের তীরে হাজার বছরের জন্ম নেওয়া শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের প্রথমজন শহীদ সাবের। তাঁকে একবাক্যে তুলনা করা যায়, ইতালির মহৎ দার্শনিক আন্তনিও গ্রামসি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্তিনিক দ্বীপের বেড়ে ওঠা বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রানজ ফাঁনোর সঙ্গে। যদিও শহীদ সাবের দর্শনের তেমন ক্রিটিক রেখে যাননি, কিন্তু তার গল্প, কবিতা, আত্মজৈবনিক রোজনামচা, চিঠি, কিশোর রচনাতে চিন্তা ও দর্শনের যে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তা এই বাংলাদেশের মানুষের জন্য আশ্চর্যই বটে। শহীদ সাবের নিয়ে আমাদের দেশে তেমন আলোচনা হয়নি। না বাংলা একাডেমি পর্যায়ে, না বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। জাতির মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে এ এক বড় অপরাধ। স্বাধীনতার পর যারা দেশকে ভাগ ভাটোয়ার করে নিয়েছিল, তারা ভুলে গেছে যে শহীদ সাবের এ দেশ, দেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় নিবেদনটি করেছেন। 

মহৎ চিন্তা লালন করতেন শহীদ সাবের। মানুষের মুক্তির জন্য দেশভাগের পর তার মতো করে হৃদয় ও আন্তরিকতা নিয়ে এদেশে কেউ ভাবেনি। ভাবনার সেই চিন্তার জায়গায়ই পৌঁছতে পারেনি কেউ। হাজার হাজার বছর ধরে ব্যক্তিগত সম্পদের লোভলালসা মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির মোহ, আয়েশ, আরাম, নির্ভরতা, দাম্ভিকতা, হিংস্রতা, লোভ ইত্যাদি তাদের চিন্তার ইন্দ্রিয় লোভে ফেলেছে। যদিও মহত্ত্ব মানুষ আবিষ্কার করেছে, কেউ কেউ সেই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছিল, অনেকে পারেন নাই। ব্যক্তি অহমের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মানুষ আবার আবিষ্কার করেছে মহত্ত্ববিনাশী চিন্তাও ।

যেহেতু বুর্জোয়া সিস্টেমটা এমন, যে ব্যক্তি দাস হয়ে গেলে তার ভাতের চিন্তা থাকে না, সেহেতু মানুষ এই সিস্টেমের সহজ সুযোগটা নেয়। আপনি শ্রম দিবেন, আপনার শ্রমঘণ্টা হিসেব করে, বেশির ভাগ মালিক পক্ষ—হিসাব করে শ্রমঘণ্টা কেটে নিয়ে আপনাকে বেতন দেবে, সিস্টেমটা এমন চোখের সামনেই আপনার রক্ত শুষে নিচ্ছে, আপনি কিছু বলতে পারবেন না, আপনার সংসার আছে, সাংসারিক মর্যাদা আছে, ইতিমধ্যেই সামাজিক মর্যাদাও অর্জিত হয়ে গেছে। তাই এ শোষণ নীরবে সহ্য করত হয়। আর আল্লাহ আল্লাহ ভগবান ভগবান করে মানবতার বিরুদ্ধে যত ধরনের অপরাধ আছে তা করে যেতে হয়। মালিক-শ্রমিক বা অন্যান্য পেশাজীবী মানুষও শ্রেণিস্বার্থে এক হয়। এ ক্ষেত্রে মানুষ সিস্টেমের কাছে মাথা নত করে। জীবনের জন্য করতে বাধ্য হয়, তবুও মানুষ সমবায়ী হয় না, সঞ্চয়ী হয়, সমবায়ী হলে নিজের জীবনসহ প্রতিবেশীর জীবন কত না সুন্দর হতো। সিস্টেম তাকে, তার জীবনকে কিনে নেয়, মানুষ হয়ে পড়ে সিস্টেমের দাস। তার নিজের অক্ষমতা, হীনম্মন্যতা কাটানোর জন্য নিজে আরও কঠোর হৃদয়হীন হয়ে ওঠে, হয়ে উঠে পাষাণ। সমাজ বিকাশের বদলে বিকাশহীন, পাষাণ মর্মর হয়ে ওঠে, আজকের পুরো পৃথিবীটা এই সিস্টেমের জালে বন্দি। গিট দেওয়া এই পৃথিবীকে খুব স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন আমাদের শহীদ সাবের। তাই ছাত্র অবস্থায়ই নতুন পৃথিবীর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। সময়ের সন্তান হিসেবে অমৃতের সন্তান হিসেবে পান করেছিলেন হলাহল-বিষ। 

শহীদ সাবের স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন, এই পাকিস্তান রাষ্ট্র জনগণের না, তিনি আরেক দুনিয়া নামক তার জেলখানার রোজনামচায় তা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন- যে ‘এটা আমাদের জাতীয় সরকার নয়, এ সরকার ইস্পাহানি-হারুনদের, পীর-মীরদের, বড় বড় ধনীদের। তারা জাতি নয়, তার বাইরে রয়েছে মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি শোষিত শ্রেণি। বর্তমান সরকার তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না।’

এত রক্তাক্ত দহন, এত ভাঙন, রক্ত, মৃত্যু, লাশ, বিলাপ, নিষ্পেষণ, অপমান, জখমসহ আরেকটি স্বাধীনতাযুদ্ধের পরও আমরা কি বলতে পারি মানুষ মুক্ত হয়েছে। কত আগে না, শহীদ সাবের তা শনাক্ত করেছিলেন। তাই তিনি চেয়েছিলেন নতুন পৃথিবী, নয়া সমাজ, নতুন বিশ্ব, মুক্ত বিশ্ব। আজকে বাংলাদেশ বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, যমুনা, হা-মীম গ্রুপ, সেই ইস্পাহানি, পীর-মীর-আমলাদেরই, এরা কিন্ত জাতি নয়; এরা কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। এটি না বুঝলে জাতি বুঝতে পারবেন না। কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী জাতি বা দেশকে ভালোবাসে না। তারা ভালোবাসে মুনাফা, সঞ্চয়, লুট, গোত্র, স্বজন, শ্রেণিসম্পর্ক। জনগণ ও সরকার এদের জাতি মনে করে ভুল করে।

এই স্বার্থবাদী শ্রেণির হাত থেকে শহীদ সাবের এ দেশের মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ জাতি তা চাই নাই, চেয়েছিল গুটিকয় মানুষ, তাই গুটিকয় মানুষকে দিতে হয়েছে তার নজরানা। আর বাকি সব দাস হয়ে থাকতে ভালোবাসল বা পরাজিত হলো বা মিশে গেল। প্রাচীন গ্রিস, প্রাচীন রোম, পারস্য, ভারতবর্ষের দিকে যদি তাকায় আমরা দেখব-হাজার হাজার কৃতদাস, চাবুকের তলে নিষ্পেষিত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ কৃতদাসকে ঝরাতে হয়েছে রক্ত। হাজার বছর ধরে মানুষের এই অপমান, অবমাননা সহ্য করতে হয়েছে মানুষকে। হাজার বছর পর আধুনিক পৃথিবীর এই গ্রহে কার্ল মার্কস নামক এক লোক এসে বলল, এভাবে চলতে পারে না, মনুষ্যত্বের মর্যাদা দিতে হবে মানুষকে না দিলে তা লড়াই করে আদায় করতে হবে। পৃথিবীর দেশে দেশে সে কথার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল, মানুষ তার মনুষ্যত্বের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন এই লড়াইয়ে দলে দলে যোগ দিল। শহীদ সাবের সে মহান লড়াইয়ের সন্তান। সেখান থেকে তাকে কীভাবে আলাদা করব।

‘আকস্মিক ও অভাবিত শোকে এখন প্রতিটি হৃদয় পূর্ণ
সবার নয়ন থেকে অশ্রু নিঃসৃত হয়ে 
এক বিষণ্ন সঙ্গীত সৃষ্টি করবে। ও ছিল মহৎ
সবাই তার প্রশংসা ও তার জন্য বিলাপে
পৃথিবীকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করে তুলবে।’
(ফ্রেইডা অথবা হিপলিটাস-মূল: সেনেকা, অনুবাদ, ভূমিকা ও টীকভাষ্য- কবীর চৌধুরী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, পৃ. ১১-১২) 

The Critique of Hegelian Dialectic and Philoshopy as a Whole (1844) এ মার্কস হেগেলীয় দর্শনের সমালোচনায় পুরো সমাজের দহন বেদনা বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন Spirit-এর আত্ম-উপলব্ধি প্রক্রিয়া বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়। হেগেলীয় এই অধিবিদ্যক ধারণার বিরোধিতা করে মার্কস দাবি করেন যে বিচ্ছিন্নতা কোনো বিমূর্ত, অতিপ্রাকৃত ঘটনা বা ধারণা নয়। বিচ্ছিন্নতার উৎস চলমান বস্তুজগতের মধ্যেই নিহিত। ব্যক্তি আত্মোপলব্ধির জন্য যে বহিঃক্রমণ প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেয়, তা থেকে জন্ম নেয় সৃষ্টিশীলতা। সৃষ্টিশীলতা বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয় না। বরং বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয় সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে ব্যক্তি তার আত্মোপলিব্ধ থেকে বঞ্চিত হয় যেখানে পরিবেশ ব্যক্তির আত্মবিকাশের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।’ (মাকর্সীয় সমাজতত্ত্ব, শোভনলাল দত্তগুপ্ত, উৎপল ঘোষ, পমিবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০০, কলকাতা, ভারত)। শহীদ সাবের সৃষ্টিশীলতা ও বাস্তবতার ধাক্কায় সমগ্র সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সমাজ ও রাষ্ট্র তাঁর চিন্তার জন্য তৈরি ছিল না। পরিবেশ তার জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কষ্ট আমরা রাখব কোথায়! যে সমাজ প্রবাদ তৈরি করেছে ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম। সেখানে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চাওয়া শহীদ সাবেরের কী হাল হয়েছে, তা আমরা চোখের সামনেই দেখেছি। এত নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থপরতার জন্ম দিতে পারে যে জাতি তাদের আর সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম করা অধিকার থাকে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অউশবিৎস গ্যাস চেম্বারে ইহুদিদের পুড়িয়ে মারার বীভৎস চিত্র দেখে থিওডর অ্যাডর্নো বলেছিলেন- যে মস্তিষ্ক গ্যাস চেম্বারের মত প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারে তাদের আর কবিতা বা শিল্পচর্চার অধিকার নেই। কিন্তু তবুও মানুষ তার সংবেদনা নিয়ে পৃথিবীর সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাবলো পিকাশোর গ্যেয়ের্নিকা বা মকবুল ফ্রিদা হোসেনের গতির ঘোড়া, সুলতানের প্রথম বৃক্ষ রোপণ এসব কে আমরা কী বলতে পারি!

তথ্যসূত্র
১. ফ্রেইডা অথবা হিপলিটাস-মূল: সেনেকা, অনুবাদ, ভূমিকা ও টীকাভাষ্য- কবীর চৌধুরী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, পৃ. ৮১।
২. শহীদ সাবেরকে স্মরণ করে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রথম আলো, প্রকাশ: ৪ সেপ্টেম্বর- ২০২১।
৩. ফ্রিদা কাহ্লো, কিছু কথা ও ডায়েরির পাতা, ভূমিকা- কার্লোস ফুয়েন্তেস, রচনা অংশ অনুবাদ: জাকিয়া রহমান ঋতা, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর-২০১৭, পৃ. ২৭
৪.ফ্রিদা কাহ্লো, কিছু কথা ও ডায়েরির পাতা, ভূমিকা- কার্লোস ফুয়েন্তেস, রচনা অংশ অনুবাদ: জাকিয়া রহমান ঋতা, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর-২০১৭, পৃ. ৩০)
৫. অুনবাদ শংকর কুন্ডু, চিরঞ্জীব শূর সম্পাদিত, ফ্রাঙ্কফুট স্কুল, প্রকাশক আলোচনা চক্র, ২০১৩, কলকাতা, ভারত পৃ. ১৬৬।
৬. শিল্পকর্মের অরা এবং তার অবক্ষয়: ওয়াল্টার বেনযামিন যেভাবে বলেছেন, অনুবাদ: শঙ্কর কুন্ডু, ফ্রাঙ্কফুট স্কুল, সঙ্কলন: চিরঞ্জীব শূর। পৃ, ১৭৪
৭. প্রাগুক্ত
৮. মাকর্সীয় সমাজতত্ত্ব, শোভনলাল দত্ত, উৎপল ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০০, কলকাতা, ভারত
৯. পরার্থপরতার অর্থনীতি, আকবর আলী খান, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস রিমিটেড প্রথম প্রকাশ ২০০০
১০. গেঅর্গ লুকাচ, একটি অন্তর্লীল বিশ্বদর্শন, সম্পাদনা: রবিন ঘোষ, বিজ্ঞাপনপর্ব, কোলকাতা, ভারত।
১১. রাজনীতির গোড়ার কথা, হ্যারল্ড লাস্কি, বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ ফেব্রয়ারি ১৯৭৬, ঢাকা।
১২. অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব, অরুণকুমার রায়চৌধুরী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পর্ষৎ, প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ১৯৮৪, কলকাতা, ভারত। 
১৩. আদমবোমা, সলিমুল্লাহ খান, আগামী প্রকাশনী, এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, দ্বিতীয় মুদ্রণ অগ্রহায়ণ-১৪২০, ডিসেম্বর ২০১০। প্রথম প্রকাশ চৈত্র ১৪১৫, মার্চ ২০১৯।

নোট
১. মালিক সোবহান, অকালপ্রয়াত সাহিত্যিক, গবেষক, প্রাবন্ধিক, লোকব্যক্তিত্ব, বাড়ি: কক্সবাজার জেলার, ঈদগাঁও উপজেলার, দক্ষিণ মাইজপাড়া গ্রামে। জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ, কবি ও প্রাবন্ধিক। ওই সময় তার কম্পিউটারের দোকানে আমরা আড্ডা দিতাম দিনের পর দিন।
২. ডুলা ফকির, পেটার ফকির, জরিনা ফকির, মোক্তার পাগলা লৌকিক দার্শনিক, দরবেশ, আউলিয়া। এদের প্রত্যেকের মাজার আছে ঈদগাঁও উপজেলায়। 
৩. প্রবন্ধটি একই শিরোনামে ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে- বাংলা একাডেমি অমর একুশে বইমেলার মূল মঞ্চে জাতীয় সেমিনারে পঠিত।

Link copied!