এ সৃষ্টিশীল অন্য রকম। কেশ থেকে পায়ের নখ অবধি সশস্ত্র। শব্দমালা যার অস্ত্র। এক গ্রেনেডের প্রতিশব্দ যেন কবি নবারুণ ভট্টাচার্য। জীবনজুড়ে যিনি আপসহীন। ঔদ্ধত্য তখন তাকেই মানায়। লিখেছেনও তা এভাবে-
...
“গণ্ডি ভেঙে আগুন মেঙে কোথায় চলেছিস
যেথায় খুশি যাচ্ছি আমি, তোদের বাবার কী
এই দেশেতে কবির জন্ম দগ্ধ অভিশাপ
বেশ্যাকূলে সীতার সামিল, ভষ্মে ঢালার ঘি।”
: কবির ঔদ্ধত্য, নবারুণ ভট্টাচার্য
১৯৪৮ সালের ২৩ জুন পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্ম। পরিবারেই তার দ্রোহী রক্ত বহমান। বরেণ্য নাট্য ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য তার বাবা। তার মা বাংলা সাহিত্যে নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিলিপিকার মহাশ্বেতা দেবী। এখানেই শেষ নয়। তার পারিবারিক রক্তধারায় জড়িয়ে আছেন মণীশ ঘটক ও ঋত্বিক ঘটকের মতো ব্যক্তিত্ব।
নবারুণের কাছে হয়তো আগে স্বভূমি চেনা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে পড়েছেন ভূতত্ত্ব নিয়ে। এরপর ভর্তি হন ইংরেজি বিভাগে।
বিপ্লবকে ভাষা দেওয়ার লড়াকু দায়িত্ব পালন করেছেন অহর্নিষ তিনি। যুক্ত ছিলেন সিপিআইএমএল লিবারেশনের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে। ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ সূত্রে তিনি প্রথম জনপ্রিয়তা পান। কিন্তু তার লেখা উপন্যাসও কম প্রভাবধারী নয়। ‘হারবার্ট’, ‘ফ্যাতাড়ু সিরিজ’, ‘কাঙাল মালসাট’ সিনেমা হয়ে এর প্রমাণ রেখেছে।
পার্টি করা মানুষ হলেও অপ্রিয় সত্য উচ্চারণে দ্বিধাহীন ছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। নইলে কেন লিখলেন এমন লাইন?
...
“বিপ্লব গেছে নেতাদের খোঁজে
যুবকেরা গেছে উৎসবে
যুবতীরা গেছে বিশিষ্ট ভোজে
গরীবের হায় কী হবে?”
: কালবেলা, নবারুণ ভট্টাচার্য
শুধু চেয়ার পেতে শিল্প-সাহিত্য করাকে একমাত্র কাজ মনে করেননি নবারুণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের মিছিল, বিক্ষোভ, প্রতিবাদেও তিনি শামিল ছিলেন। তিনি টের পেতেন ক্ষত আর দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা।
...
“কিছু একটা পুড়ছে, গনগন করছে
চুপ করে পুড়ছে, মুখ বুজে পুড়ছে
ঝড় যদি ওঠে তাহলে কিন্তু দপ করে জ্বলে উঠবে
কিছু একটা পুড়ছে বলছি
দমকলের গাড়ি, নাভিকুণ্ডল, সূর্য
কিছু একটা পুড়ছে
প্রকাশ্যে, চোখের ওপর
মানুষের মধ্যে
স্বদেশ!”
: কিছু একটা পুড়ছে, নবারুণ ভট্টাচার্য
সৃষ্টিগুণে তিনি অর্জন করেছেন সাহিত্য আকাদেমি ও বঙ্কিম পুরস্কার। তার সাহিত্য অনুদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। ক্যান্সারের ছোবলে ৬৬ বছর বয়সেই বিদায় নবারুণ ভট্টাচার্যের। সে তারিখ ২০১৪ সালের ৩১ জুলাই।
দূরদ্রষ্টা বলেই দশজনের চেয়ে আলাদা একজন কবি। আমৃত্যু লড়াকু নবারুণ ভট্টাচার্য বিপ্লবকে চিরজীবী করে অনন্ত প্রতিরোধের উৎস হয়ে আছেন এখনো।
...
“আমার মরে যাওয়াটা কোনো বড় কথা নয়
খুব বেশিদিন আমি বাঁচব না
এটা আমি জানতাম
কিন্তু আমার বিশ্বাস কখনও হটে যায়নি
সমস্ত মৃত্যুকে অতিক্রম করে
সমস্ত অন্ধকারকে অস্বীকার করে
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হয়েছে
বিপ্লব চিরজীবী হয়েছে।”
: শেষ ইচ্ছে, নবারুণ ভট্টাচার্য
আপনার মতামত লিখুন :