• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

কে জন্মায়, হে বৈশাখ


হাসান শাওন
প্রকাশিত: মে ৮, ২০২৩, ০৮:৪৪ এএম
কে জন্মায়, হে বৈশাখ

রৌদ্রদিন তোমার গান বৃষ্টিদিন
অন্ধকার বনের পথ শাল পিয়াল
শালপিয়াল ধূলিধূসর ফুলগুলি
দলবেঁধে ইস্কুলের রিহার্সাল
কোথায় আজ দিন কাটে?—ভোরবেলায় মায়ের চোখ
চোখের জলে—
ছোটোবেলার স্কুলপোশাক, নদীর ধার, বেলতলা
শ্যামসবুজ মফস্বল।
ও রাঙা পথ, ও ভাঙা পথ দেশছাড়া
মনে রাখিস, তোরা এসব মনে রাখিস
পথে এখন নতুন বিষ। ছোট্ট থেকে বড়ো হওয়ার
নতুন বিষ, পুরোনো বিষ। মনে রাখিস
কেউ কি বিষ ধুইয়ে দেয়, রৌদ্রদিন?
বৃষ্টিদিন মুছিয়ে দেয়?—একটি লোক
ঘুরে বেড়ায়, মিলিয়ে যাওয়া এক বালক
এই পথেই ঘুরে বেড়ায়, ধরে বাতাস
হাওয়া মুঠোয় সে উড়ে যায়
সে উড়ে যায়
পচাপুকুর, কলোনিমাঠ, রেললাইন,
খুনখারাপ মফস্বল—
ঘরে ঘরে ছেঁড়া চটির টিউশনি
শ্যামলীদের মাধবীদের গান শেখা
লণ্ঠন আর মোমবাতির রাত জাগা
খোকন স্যার, স্বপন স্যার, স্বপ্নাদি—
সবার গায়ে ছড়িয়ে দেয় নিজের গান-
সেই গানের রঙ লাগায়
গরিব সব বাপমায়ের চোখের জল
রৌদ্র পায়, বৃষ্টি পায়...
রৌদ্র নিয়ে বৃষ্টি নিয়ে, প্রতি বছর
সবার চোখ আড়াল দিয়ে, প্রতি বছর
কে জন্মায়, হে বৈশাখ,
কে জন্মায়?

(কে জন্মায়, জয় গোস্বামী)

বাঙালির সূর্য রবির জন্ম দিবস এই ২৫ বৈশাখ। শুধু শতবর্ষ নয়, কোটি বর্ষ জুড়ে এককভাবে একটি জাতিগোষ্ঠীর শ্বাস প্রশ্বাসের মতো প্রবাহিত হওয়ার সামর্থ রাখে যার সৃষ্টিকর্ম। একটি জাতিগোষ্ঠী বলা হয়তো ক্ষুদ্রার্থ হয়ে যায়। ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’র কবিকে বরং মনে করবে বিশ্ব মানব। ধর্ম, ভাষা, সীমানা, বর্ণ ও যাবতীয় ভেদকারী জাত-পাতের ঊর্ধ্বে যার অবস্থান।

রবির সময়েও ‘হেটার্স’ ছিলেন। কুতর্ক তাকে নিয়ে কম হয়নি। বা হচ্ছে না। কিন্তু তার উচ্চতার কারণেই বারবার ঘৃণা নিক্ষেপকারীদের দিকেই ফিরে আসে তা।

কে কোথায় জন্মাবে তা বিধি নির্ধারণ করে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো প্রসঙ্গে গল্পগুচ্ছের শেষে পরিশিষ্ট অংশে যে বিষয়ে রবি লিখতে বাধ্য হন দু-কলম। তার প্রশ্ন ছিল, কুড়ির মধ্যে যে কীট জন্মে, সে কি ফুলকে ভালো চেনে? না যে বাইরে থেকে ফুল দেখেছে সে? নোবেল জয়, নাইটহুড উপাধি-অর্জন বর্জন নিয়েও বিতর্ক চলে। পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার না-কি বিরোধী ছিলেন তিনি? ব্রিটিশ তোষণ, সৃষ্টিকর্মে মুসলমান চরিত্রের স্বল্প উপস্থিতি ও লালনের গান মেরে দেওয়ার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে। আহা! কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কী বিপুল বিস্ফোরণ! রবীন্দ্র সমালোচনা চলুক তার মাথা থেকে পা অবধি। তবে নিশ্চিত শেষ পর্যন্ত তার পদালোচক হয়েই থাকতে হবে তাবৎ পণ্ডিতকূলকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০ বছরের জীবনে অপূর্ণতা ছিল কমই। বিশ্ববিদ্যালয় সনদহীন রবি নিজেই অনন্য এক বিদ্যাপীঠের স্রষ্টা। অনেক বিনাশ সত্ত্বেও যা এখনো বাতিঘর হয়ে আছে স্বমহিমায়।

একাধিক দেশের জাতীয় সংগীতস্রষ্টা হিসেবে পূজিত হন ঠাকুর নিয়মিত। কিন্তু প্রয়াণের এত বছর পরও তার আরাধ্য বাঙালি হয়ে থাকা ‘মানুষ’ মুক্ত হয়নি জুলুমতন্ত্র থেকে।

শিল্প সাহিত্যের সকল শাখার মতো গানেও তিনি আছেন। কোনো প্রতিষ্ঠান কপিরাইট কর্তৃত্বে রাখতে পারেনি তার সংগীত। যে সংগীত একই সঙ্গে উপশমকারী ও শক্ত সমর্থ বিপ্লবী ব্যক্তি সত্তা নির্মাণে তাৎপর্যপূর্ণ।

পারিবারিক উত্তরসূরি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি পেয়েছেন। আমাদের জনপদের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পতিসর ও শাহজাদপুরে ছিল যার অবস্থান। এজন্য অনেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আখ্যায়িত করেন ধনকুবের, বড়লোক, শ্রেণি বিবেচনায় শাসক শ্রেণি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কোনো কার্যক্রমে তার জমিদারি বা বড়লোক সুলভ দাপট প্রকাশ হয় না।

প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘কালান্তর’ এ রবীন্দ্রনাথ লেখেন—“আমি জানি জমিদার জমির জোঁক। সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিত জীব। আমরা পরিশ্রম না করে, উপার্জন না করে, কোনো যথার্থ দায়িত্ব গ্রহণ না করে ঐশ্বর্য ভোগের দ্বারা দেহকে অপুট ও চিত্তকে অলস করে তুলি। যারা বীর্যের দ্বারা বিলাসের অধিকার লাভ করে আমরা সে জাতির মানুষ নই। প্রজারা আমাদের অন্ন জোগায় আর আমলারা আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়—এর মধ্যে পৌরুষও নেই, গৌরবও নেই।”

তিনি জমিদারি প্রথা উচ্ছেদে যা করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। আজীবন নিষ্ঠ ছিলেন গরিব মানুষের ভাগ্য বদলে। মুসলমান কৃষকদের প্রতি তার ছিল অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। কৃষি উন্নয়ন, সমবায় ব্যবস্থা, রাজস্ব আহরণ থেকে শুরু করে জমিদার রবির প্রতিটি কর্মে প্রাধান্য পেয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মঙ্গল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে আরেক মিথ্যা অভিযোগ, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন। যদিও এর কোনো দালিলিক প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেননি। উল্টো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া লিখিত বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন,

“ধর্মে ধর্মে বিরোধ হতে পারে না। কারণ ধর্ম হলো মিলনের সেতু আর অধর্ম বিরোধের। যখন ধর্মে বিকার উপস্থিত হয় তখনই বিচ্ছেদ প্রবল হয়ে ওঠে। শুধু হিন্দু-মুসলমানে প্রভেদ নয় সমাজের মধ্যে ভেদের অন্ত নেই। যখন মানুষ মানুষকে অপমান করে, তখন সে দুর্গতি-দারিদ্র্যে চরম সীমায় উপনীত হয়, আমি আমার সমাজের জন্য লজ্জিত হয়েছি, বিচ্ছেদের রক্তপ্লাবনে মানব-সমাজের প্রতি স্তর কলুষিত হয়েছে। এই সমস্যা ভারতে বহুদিন থেকে আছে। বিরোধের প্রাচীর তুলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। শুভবুদ্ধির আলোক বিকীর্ণ হোক। তবেই আমাদের চিত্ত মুক্ত হবে।”

সূর্যের উদয় আর সূর্যাস্ত থেকে সব প্রহরে যেন পৃথিবীর সব মাটিনিষ্ঠরা সমর্পিত হন রবির সৃষ্টিতে।

Link copied!