• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শহরটা যেন মায়ার জঞ্জাল


নাসিফ আমিন
প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২৩, ০৩:৩০ পিএম
শহরটা যেন মায়ার জঞ্জাল

‍‍`মায়ার জঞ্জাল‍‍` দেখে বেরিয়েছিলাম যখন, রাতের ঢাকা শহরকে মুহূর্তের জন্য ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর সিনেমা মনে হয়েছিল। এই মনে হওয়াটা সত্যি; কোন কাব্যিক সুষমা বা আতিশয্য থেকে নয়। শহর যেমনটা, তেমনটাই। 

পর্দায় প্রজ্ঞাপিত বাস্তবতার সাথে জলজ্যান্ত বাস্তবতার ফারাকটা কোথায় - এই প্রশ্ন আমি করেছি নিজেকে। একেবারে নগদ উত্তরটা এমন যে, একজন ব্যক্তিমানুষ নগরের বিছানায় শুয়ে, বেঞ্চিতে কিংবা চৌরাস্তার মোড়ে বসে, খুব কাছ থেকে জীবন্ত আর ঘুমন্ত মানুষগুলোকে দেখছে। সেই ব্যক্তিমানুষের চোখে আমরা বাস্তবতাটাকে দেখেছি সহজাতভাবে। এবং এই ব্যক্তিমানুষটা যদি হয় নির্মোহ অথচ প্রজ্ঞাবান, তাহলে তার প্রজ্ঞাপিত বাস্তবতায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অভিজ্ঞতাগুলো অনুভূতির মত করে ধরা দেয়। অর্থাৎ ঘটনার দৃশ্যায়ন শুধু ঘটনার দৃশ্যায়ন মাত্র থাকে না। মশারীর ভেতর মনোটোনাস দাম্পত্যও মায়ার মত করে ধরা দেয়। দৃশ্যে এই মায়া ধরার জাল যিনি পেতেছেন, সেই ব্যক্তি মানুষটার নাম ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী। 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু‍‍`টি গল্পের আবহ নিয়ে তিনি চরিত্রগুলোকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন মায়ালিপ্ত এক জগৎ-সংসারের ক্রসরোডে। তাতে যে অভিঘাতগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজের মতন আচমকা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে, তা আগাপাশতলা মর্মস্পর্শী। এই মর্মস্পর্শের উপলব্ধিকে যিনি আন্তরিকভাবে ঘনিয়ে তুলেছেন, তিনি অপি করিম। তার মত যশস্বী শিল্পী কিভাবে একটি চলচ্চিত্রের মূল সুর তৈরি করেছেন, তা বুঝতে হলে অবশ্যই ‍‍`মায়ার জঞ্জাল‍‍` বড় পর্দায় দেখতে হবে। ঋত্বিক চক্রবর্তীকে তার সহজাত প্রভাব বিস্তারকারি নমিত উপস্থিতিতেই পাওয়া গেছে এ চলচ্চিত্রে। সাথে ছিলেন সোহেল মন্ডল। সোহেলের দম ইতোমধ্যে বাঙলার দর্শক জেনে গেছেন তার অভিনীত ওয়েব সিরিজ ও চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি অপি করিমকেই। 

এই অপি করিমকে বাঙলা দর্শক এভাবে আগে দেখেনি। শুনতে খারাপ লাগলেও আমি বলব; আর যা-ই হোক, এই সময়কার সকল পেশাদার অভিনয়শিল্পীর উচিত, অন্তত অপি করিমের অভিনয় দেখে অনুপ্রানিত হওয়ার জন্য হলেও ‍‍`মায়ার জঞ্জাল‍‍` দেখা। কথাটি আমি কাউকে ছোট কিংবা বড় করার জন্য বলছি না। বলছি, স্রেফ একটা ভালো কাজ দেখে অনুপ্রানিত হওয়ার জায়গা থেকে। এমনকি অল্প উপস্থিতিতে ওয়াহিদা মল্লিক জলির অভিনয়ও মনে রাখার মত। চান্দ্রেয়ী ঘোষের অভিনয় ভালো লেগেছে। 

পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় যেমন অভিনয় করেন, এই চলচ্চিত্রেও তেমন। ধরাবাঁধা চরিত্র। একইভাবে, কমলিকা ব্যানার্জিও যেইকে সেই। চরিত্রের গৎবাঁধা শূন্যস্থান পূর্ণ করার মত। এর চেয়ে বেশি কিছু না। ব্রাত্য বসুর চরিত্রটি বেশ দারুণভাবে নির্মিত, সন্দেহ নেই। আমি বরং ‍‍`ওয়ান্স আপ‍‍`ন আ টাইম ইন ক্যালকাটা‍‍`য় ব্রাত্য বসুর অভিনয়ের কথা উল্লেখ করতে চাই। ব্রাত্য বসু নি:সন্দেহে অনবদ্য অভিনয় করেন।‍‍`মায়ার জঞ্জালে‍‍` যতটুক করেছেন সেটাও মনে রাখার মত। 

‍‍`ওয়ান্স আপ‍‍`ন আ টাইম ইন ক্যালকাটা‍‍` প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ‍‍`মায়ার জঞ্জাল‍‍`ও কাছাকাছি প্রেক্ষাপটের গল্প। একইভাবে, সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‍‍`মহানগর@কলকাতা‍‍`ও। তবে সুমন মুখোপাধ্যায়ের কলকাতা থেকে উপরোক্ত দুই সিনেমার কলকাতা কিছুটা আলাদা। চরিত্রগুলোর খুব একটা হেরফের না থাকলেও কলকাতা শহরকে উপস্থাপন করাটা মোটা দাগে আলাদা। নতুন তৈরি হওয়া গগণবিদারি বহুতল কলকাতা পরবর্তী দুই সিনেমায় বিশেষভাবে উপস্থিত। ‍‍`ওয়ান্স আপ‍‍`ন আ টাইম ইন কলকাতা‍‍` তো একেবারে পুরাতন কলকাতা ভেঙে নতুন কলকাতা তৈরিরই গল্প অনেকাংশে। ‍‍`মায়ার জঞ্জাল‍‍`-এ এটি মূল বিষয় না হলেও সিনেমার বহিরঙ্গে এর উল্লেখযোগ্য ছাপ আছে। এমনকি রনি সেনের ‍‍`ক্যাট স্টিক্স‍‍`ও তাই। তবে রনি সেনের ‍‍`ক্যাট স্টিক্স‍‍` পুরোপুরি অন্য চোখে দেখা কলকাতা শহর। 

এই সবগুলো সিনেমার মূল উপজীব্য শহরের আপাত বিচ্ছিন্ন নাগরিক জনগোষ্ঠীর ইন্টারসেক্টিং স্পেস বা আন্তঃছেদী পরিসর। ‍‍`মায়ার জঞ্জাল‍‍`-এর গল্পের প্রেক্ষাপট কি গুগল সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। সেটা এখানে উল্লেখ করছি না। আমি বরং উল্লেখ করতে চাই, ঢাকা শহরে ‍‍`মায়ার জঞ্জাল‍‍` বিষয়ক পরিকল্পিত নিস্তব্ধতা নিয়ে। যারাও অল্প আধটু আলাপ কথা বলছে, তাও খুব দায়সারা গোছের। ঘটনার ঘনঘটা দিয়ে চমকে দেওয়ার সিনেমা না এই ‍‍`মায়ার জঞ্জাল‍‍`। এই সিনেমা মানব সম্পর্কের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুষঙ্গের আণুবীক্ষণিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমাচার। অন্তত শিল্পসাহিত্য এবং তদসংশ্লিষ্ট মানুষজনের এই সিনেমা নিয়ে আলাপ তোলার কথা। অথচ গুটিকয় ছাড়া তেমন আলাপ আমার চোখে পড়েনি। 

আমার অনুমান, ঢাকা শহরের বিদ্বৎকুলে অধুনা সমবেত সংকীর্ণতা আছর করেছে। এটা কাটুক। সিনেমাপ্রেমী হিসেবে আমি অবশ্যই চাইব লোকজন সিনেমাটা দেখুক। হালের সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক রিভিয়ু ব্যবসায়ীরাও ‍‍`পেইড রিভিয়ু‍‍`র বাইরে এসে সৎ রিভিয়ু লিখুক। শুভমস্তু।

Link copied!