বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রকোপ কিছুটা কম ছিল এই বছর। তবে থেমে ছিল না অন্যান্য রোগগুলো। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রোগের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। এই বছরও কিছু রোগ দেশসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের মানুষের স্বাস্থ্যে হানা দেয়। শিশু-বৃ্দ্ধ কেউ বাদ যায়নি সেসব রোগের থাবা থেকে। চলুন এই বছর কোন কোন রোগ বিশ্বব্যাপী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা দেখতে একটু পেছনে ফিরে আসি।
ডেঙ্গু রোগ
বর্ষা শেষ, উৎসবের মরসুম শুরু মানেই ডেঙ্গি বা প্রচলিত ভাষায় ডেঙ্গু রোগের চোখ রাঙানি শুরু। দেশজুড়ে এই বছর মারাত্মক ছিল এই রোগটি। জেলায় জেলায় দমানো যায়নি এই মশাবাহিত রোগের দাপট। সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মশা বাহিত এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। তবে এবার অক্টোবরের মাঝামাঝি সংক্রমণের গ্রাফ উর্ধ্বমুখী ছিল। অসংখ্য শিশুর মৃত্যুও হয়েছে এই রোগে। হাসপাতালে ছিল ডেঙ্গি রোগীর ভিড়। এডিস মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে সব বয়সী মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩১ হাজার ৯৬৬ জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১১৮ জনের। অর্থাৎ শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুর হার ০.৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি এক হাজার রোগীর বিপরীতে মারা যাচ্ছে ৩.৭ জন। বিশেষজ্ঞরা জানান, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান কারণ রক্তের প্ল্যাটিলেট কমে যাওয়া। যে কারণে রক্তক্ষরণ হয় এবং মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও আগে থেকে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যানসার, কিডনির মতো সমস্যায় ভোগেন, তাদের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি থাকে ডেঙ্গু সংক্রমণে। সরকারও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কঠোর ছিল। অপরিচ্ছন্নতা দূর করতে নজরদারিতে ছিল প্রশাসন। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বাড়তি চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয় সরকার।
মাঙ্কিপক্স
মাঙ্কিপক্স এক ধরনের পক্স। এটি এক ধরণের গুটিবসন্ত। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়ে মাঙ্কিপক্স। ২০২২ সালে এই রোগ ভাইরাল হয়ে যায় বিশ্বজুড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম এর প্রাদুর্ভাব হয়। যা পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী ৮০ হাজার জনেরও বেশি মানুষকে সংক্রমিত করে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা মাঙ্কিপক্সকে একটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা বলে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই বছর জুলাই মাসে এই রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে আলোচনার করে সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যভিত্তিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
হাম
হাম ঋতুকালীন রোগ। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এই রোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ২০২২ সালেও ব্যতীক্রম ছিল না। বরং এই বছর একটু বেশিই ছড়িয়ে পড়ে রোগটি। অসংখ্য শিশু এই বছর হামে আক্রান্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকস্মিক হামের প্রাদুর্ভাব হওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে টিকাদানের অভাব। করোনার মহামারিতে হামের টিকাদানে ব্যাহত হওয়ার কারণেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়েছে এই রোগে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সংস্থা ও মার্কিন সংস্থা Centers for Disease Control and Prevention বা CDC-র সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪ কোটি শিশু ভ্যাকসিনেশনেশন থেকে বঞ্চিত হয়।
সোয়াইন ফ্লু
এই বছর মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সোয়াইন ফ্লুও। বাংলাদেশে এর প্রকোপ কম থাকলেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ছড়িয়ে পড়ে রোগটি। বিশেষজ্ঞরা জানান, ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। কোভিড এবং সোয়াইন ফ্লু উভয়েরই সাধারণ লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো ছিল একইরকম। জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যথা, সর্দি বা নাক বন্ধ, শরীরে ব্যথা। তাই প্রায়শই প্রাথমিক পর্যায়ে একে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাই পরে এটি মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
ম্যালেরিয়া
ডেঙ্গির পাশাপাশি ম্যালেরিয়া রোগেও ভুগেছে সাধারণ মানুষ। এই বছর ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছিল। ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে অনেকে। এই রোগে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায়। বাংলাদেশে মোট ৩৬ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা দেখা যায়। এদের মধ্যে সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। বাংলাদেশের ১৩টি জেলার ৭২টি থানায় ম্যালেরিয়া রোগের উপস্থিতি ছিল। পার্বত্য ও সীমান্ত এলাকাতেই এই রোগ বেশি হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূলের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
ডায়ারিয়া
প্রতি বছর ডায়ারিয়ার প্রকোপ শুরু হয় এপ্রিলের শুরু থেকে। ছয় থেকে আট সপ্তাহ চলতেই থাকে। তবে এই বছরের চিত্রটা থাকে ভিন্ন। ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও আগের যেকোনও বছরের তুলনায় অনেক বেশি ছিল।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডায়ারিয়া রোগী নিয়েও নিয়মিত বুলেটিন দিয়েছে এই বছর। ডেঙ্গুর উপসর্গ হিসাবেই ডায়ারিয়া রোগের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।