• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দেশীয় বিনিয়োগে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উন্নয়ন


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২, ০৮:০২ পিএম
দেশীয় বিনিয়োগে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উন্নয়ন

চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের একমাত্র প্রাকৃতিক সমুদ্রবন্দর। এর নাব্যতা সমুদ্রবিজ্ঞানের জন্য বিস্ময়। অধিকন্তু এটার ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক, যেটা বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের অর্থনীতির নিউক্লিয়াস বলা যায় এই বন্দরকে। সবচেয়ে কম খরচে সর্বোচ্চ সেবাদানের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে এই বন্দর ব্যবসায়ীদের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত। অনন্য ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের বিশ্বের অন্যতম গতিশীল ও বেগবান দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, যথা সার্ক ও আসিয়ানের সংযোগকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের অফুরান সম্ভাবনা বিদ্যমান। অধিকন্তু প্রস্তাবিত ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে এবং রেলওয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের সুবিধার কারণে ভবিষ্যতে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক সমুদ্র, বিমান, রেল ও সড়ক যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ হাব-এ পরিণত হওয়ার সব সম্ভাবনাই বিদ্যমান। চট্টগ্রামের উল্লিখিত সম্ভাবনা ছাড়াও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জীববৈচিত্র্য বিদ্যমান। এর সঙ্গে এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন প্রকার ফলমূল যেমন আনারস, কাঁঠাল, কলা, তরমুজ, পেয়ারা, লেবু, পেঁপে, নারিকেল এবং শাকসবজি উৎপাদিত হয়। কিন্তু আধুনিক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলের অনেক পণ্য ও সেবা বৈশ্বিক বাজার ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিবছর দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য অনন্য জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও চট্টগ্রাম অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান। প্রাকৃতিক লেক, অবারিত সবুজ সমতল ভূমি, পাহাড়, অরণ্য, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এবং উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থাপনার কারণে চট্টগামে বন্দরের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর ১৩৫ বছরে পড়েছে। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি, শিল্পায়ন, শিল্পকারখানা পরিচালনা, বৈদেশিক ও দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, সর্বোপরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খাতে সর্বোচ্চ অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের চাবিকাঠি, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড চট্টগ্রাম বন্দরকে বাংলাদেশের গেটওয়ে বলা হয়। লন্ডনভিত্তিক শিপিংবিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সংবাদমাধ্যম লয়েড’স লিস্টে ২০২১ সালে আগের বছরের চেয়ে তিন ধাপ এগিয়ে বিশ্বের ৬৪তম ব্যস্ততম বন্দরে পরিণত হয়েছে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর। এর আগে ২০২০ সালে লয়েড’স লিস্টে এক লাফে ৯ ধাপ পিছিয়ে গিয়েছিল দেশের এই প্রধান বন্দরটি মূলত করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে। হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দরটি ২০২১ সালে মোট ৩২ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৮ টিইইউ (২০ ফুট সমতুল্য ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছে, যা আগের বছরের ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭ টিইইউ থেকে বেশি, যা বছরে ১৩.২ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডলিং বছরের প্রবৃদ্ধি। নৌ-দস্যুতার হুমকিমুক্ত, শ্রম অসন্তোষমুক্ত এবং ব্যবস্থাপনায় উন্নতির সূচকে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূতি ক্রমাগত বাড়ছে। বিদায়ী বছরে চট্টগ্রাম পোর্ট লিমিট কুতুবদিয়া অবধি বিস্তৃত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশ্বের সর্বাধিক ব্যস্ত ১০০ কনটেইনার পোর্টের তালিকায় ৩০তম অবস্থানে উন্নীত করার প্রত্যয় নিয়ে বর্তমান সরকার কাজ করছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের ৯২ শতাংশই সম্পন্ন হয়ে থাকে। সার্বিকভাবে দেশের প্রধান এই সমুদ্র বন্দর জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রেখে চলেছে। চট্টগ্রাম বন্দরভিত্তিক দেশের একক বৃহৎ রাজস্ব প্রতিষ্ঠান কাস্টম হাউসের শুল্ক-কর আদায় ছাড়াও ভ্যাট অ্যান্ড এক্সাইজ, কর-রাজস্ব, বন্দরের চার্জ-ডিউজ, বন্দর ব্যবহারকারীদের কর-রাজস্ব খাতে অবদান ইত্যাদি মিলিয়ে বার্ষিক কমপক্ষে এক লাখ কোটি টাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজস্ব জোগানদার বহুপাক্ষিক এই প্রতিষ্ঠান। তবে দেশের ও বৈশ্বিক ক্রমবর্ধমান চাপ আর চাহিদা সুচারুরূপে সামাল দিতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষত ভৌত অবকাঠামো, ভারী যান্ত্রিক সাজসরঞ্জামের প্রয়োজন মেটাতে হবে। পোর্ট-শিপিং সার্কেল ও বন্দর ব্যবহারকারীরা মনে করেন, ফি বছর বাড়তি মুনাফা অর্জনকারী এই বন্দরের উন্নয়নে নিজস্ব অর্থায়নে এবং যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে বন্দরের উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের অপরিহার্যতা পরিপূরণ করা সম্ভব। বৈদেশিক বাণিজ্য ও রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় আরও আধুনিকায়নে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং যুগের চাহিদা পূরণে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসের মধ্যকার সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

আশার কথা এই যে বিদেশি বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অনুধাবন করে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসছে। বাংলাদেশ সরকার সব দিকে বিবেচনা করে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে এবং দেশীয় উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠানকে এই বন্দরের উন্নয়নে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে প্রথমবারের মতো নির্মিত হয়েছে বন্দরের নতুন টার্মিনাল, যেটি তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা এলাকায়। নতুন এই টার্মিনালের নাম রাখা হয়েছে ‘পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল’। চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন এই টার্মিনালে গত ২১ জুলাই পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ ভেড়ানো হয়েছে। এই টার্মিনালটি তৈরি হয়েছে সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার খালাস ও রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজে তুলে দেওয়ার জন্য। চট্টগ্রাম বন্দরের মূল জেটি থেকে ভাটির দিকে চট্টগ্রাম ড্রাই ডক ও চট্টগ্রাম বোটক্লাবের মধ্যে প্রায় ২৬ একর জায়গায় কর্ণফুলী নদীর তীরে এ টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। এটির ব্যবহার পুরোপুরি শুরু হলে বন্দরের টার্মিনালের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে চারটিতে। আর জাহাজ ভেড়ানোর জন্য বন্দরের মূল জেটির সংখ্যা দাঁড়াবে ২১। ২১ জুলাই পাথরবাহী একটি জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের মাধ্যমে এ টার্মিনালের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে নির্মিত প্রথম এই টার্মিনাল বাংলাদেশের বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াবে।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের পূর্ত কাজের দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের। সেনাবাহিনী পূর্ত কাজের জন্য নিয়োগ দেয় দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। জেটি নির্মাণের জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিংকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ইয়ার্ডসহ অন্যান্য কাজও দেশীয় প্রতিষ্ঠান সম্পন্ন করেছে। টার্মিনাল নির্মাণের বিস্তারিত নকশা ও পরামর্শক ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ টার্মিনালের নির্মাণকাজের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। ২০১৯ সালে এই কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে প্রকল্প এলাকায় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা স্থানান্তরসহ নানা জটিলতায় নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। নতুন টার্মিনালের ৫৮৪ মিটার লম্বা জেটিতে একসঙ্গে ৩টি কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানো যাবে। এ টার্মিনালের মাধ্যমে বছরে জাহাজ থেকে পাঁচ লাখ আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার ওঠানো-নামানো সম্ভব হবে। এ ছাড়া ২০৪ মিটার লম্বা ডলফিন জেটিতে তেল পরিবহনকারী একটি জাহাজ ভেড়ানো যাবে। তিন জেটির এই কনটেইনার টার্মিনাল পুরোদমে চালু হলে বন্দরে একসঙ্গে ১৪-১৫টি কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে।

স্বাধীনতার পর সমুদ্রগামী জাহাজ ভেড়ানোর দুটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। তিন দশক আগে নির্মিত চট্টগ্রাম বন্দরের চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালের (সিসিটি) নির্মাণকাজ করেছে ইউরোপীয় একটি প্রতিষ্ঠান। আর সর্বশেষ ২০০৭ সালে এ বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল নির্মাণ করেছে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) কর্তৃপক্ষ এই টার্মিনাল পরিচালনার জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে কাজ করছে। শুরুতে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে। তবে এখন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ডেনমার্কের একটি করে তিনটি প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চায়। এ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় এখন অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বন্দরের তত্ত্বাবধানে টার্মিনালটির পরিচালন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এদিকে দ্য চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ দেশীয় অর্থনীতির বিকাশ ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে চট্টগ্রামে দেশের প্রথম বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে ‘বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র নির্মিত হবে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক অঞ্চলে, যার নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪২ কোটি টাকা। ২১তলা ভবনে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাই বিদ্যমান থাকবে। এটি নির্মিত হলে শুধু কর্মসংস্থান, বৈদেশিক বাণিজ্যই বৃদ্ধি পাবে না, এর পাশাপাশি স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরসহ অন্যান্য সমুদ্রবন্দর দেশীয় বিনিয়োগে নির্মাণ করা এখন অনেকটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কেননা, ভূরাজনৈতিক কারণে চীন ও ভারতের অর্থায়নে বাংলাদেশের বন্দর উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা পাশ্চাত্য দেশগুলো বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা ভালো চোখে দেখছে না। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারে পাশ্চাত্য দেশগুলো উদ্বিগ্ন। শ্রীলঙ্কার একটি সমুদ্রবন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের মালিকানায় চলে যাওয়ার পর বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও চামড়ার চাহিদা বাড়ছে। একই সঙ্গে আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। বিশেষ করে পেট্রোলিয়াম পণ্য, ভোজ্যতেল, সুতা ও যন্ত্রপাতি আমদানি করছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ২০২৩ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বাল্ক থ্রোপুট বেড়ে ৪ কোটি ৪০ লাখ টন হওয়ার কথা, ২০৪৩ সালের মধ্যে যা হবে ৭ কোটি ৩৩ লাখ টন। আর বাল্ক সেগমেন্ট বছরে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বেড়ে ২০৪৩ সালের মধ্যে ৫ কোটি ৫৫ লাখ টন হবে। এইচপিসি হামবুর্গ পোর্ট কনসালটিং গত বছর আরও দুটি কোম্পানির সঙ্গে এক যৌথ সমীক্ষা করেছে। তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ২০২০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরকে ২০ ফুট লম্বা কনটেইনার খালাস করতে হবে ২৯ লাখ, যেটা ২০৪০ সালের মধ্যে দাঁড়াবে ৫১ লাখ। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশ বন্দর নির্মাণ করতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছে। ব্যাপারটা হচ্ছে কি, বাংলাদেশ চীনের সমুদ্রপথনির্ভর বেল্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কথা ছিল, বেইজিং বাংলাদেশের দক্ষিণে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করবে। কিন্তু এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির প্রকল্প প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ধারণা করা হয়, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড রাজনৈতিক চাপের কারণে বাংলাদেশ চায়না হারবারের প্রস্তাব নাকচ করতে বাধ্য হয়েছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। আবার পায়রা বন্দরও চীনের করার কথা ছিল। কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল, এটি কয়েকটি দেশের যৌথ প্রকল্পে পরিণত হয়েছে, যেখানে ভারতের বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। এদিকে জাপানও সম্প্রতি বাংলাদেশে ভালোভাবে ঢুকতে পেরেছে। এ বছরের শুরুতে মাতারবাড়ীতে শতকোটি ডলারের একটি বন্দর ও বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ ও জাপান চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেখানে সিংহভাগ অর্থ দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। এই প্রকল্পে ৪৬০ কোটি ডলার ব্যয় হবে, যার মধ্যে ৩৪০ কোটি ডলার দেবে জাপান। এতে দুটি ৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ৬০ ফুট ড্রাফটের জাহাজ ঢোকার মতো একটি বন্দরও রয়েছে। জাইকার তথ্যমতে, এই বন্দরে ৮০ হাজার ডেডওয়েট টনের (জাহাজ সর্বোচ্চ যে পরিমাণ পণ্য নিয়ে নিরাপদে চলতে পারে) জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা যাবে। একই সঙ্গে, পতেঙ্গা উপকূলে ‘বে টার্মিনাল’ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জার্মানির হামবুর্গের এইচএইচএলএ প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করেছে। এটি মূলত কনটেইনারভিত্তিক সেবা দেবে, যেখানে ৪৫ ফুট ড্রাফটের (পানিতে জাহাজের ডুবন্ত অংশের পরিমাণ) জাহাজ ঢুকতে পারবে। ফলে প্রথমবারের মতো বড় জাহাজগুলো চট্টগ্রামে ঢুকতে পারবে। এর আংশিক অর্থায়ন করবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।

বিদেশি বিনিয়োগে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল প্রকল্প হোক বা না হোক, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়ে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে উন্নয়ন কার্যক্রম বিলম্ব হওয়ার ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের নিজস্ব বিনিয়োগের দিকে এখন নজর দেওয়া আবশ্যক। আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্মাণ সক্ষমতা ও বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের যে কারিগরি জ্ঞানের মাধ্যমে তা যে করা সম্ভব, তা পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প শেষ করার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে।

 

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

Link copied!