• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

৫৩ বছরেও মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি বীরাঙ্গনা যোগমায়ার


শরীয়তপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৪, ০২:৪৪ পিএম
৫৩ বছরেও মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি বীরাঙ্গনা যোগমায়ার
বীরাঙ্গনা যোগমায়া মালো। ছবি : প্রতিনিধি

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর পাশবিকতার স্মৃতি মনে পড়লে এখনো আঁতকে ওঠেন শরীয়তপুরের বীরাঙ্গনা যোগমায়া মালো। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। ৫৩ বছর ধরে শরীর ও মনের ক্ষত বয়ে বেড়ালেও এখনো তিনি অন্যের আশ্রয়ে থাকেন। মাথা গোঁজার মতো ছোট্ট একটি ঘরও নেই তার। শেষ জীবনে একটি ঘরের আশ্বাস বারবার তাকে দেওয়া হলেও এখনও তিনি সেই ঘর পাননি।

যোগমায়া মালো, তার পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে ১৫ বছরের কিশোরী গৃহবধূ ছিলেন যোগমায়া। একাত্তরের ২২ মে শরীয়তপুরের মনোহর বাজারের দক্ষিণ মধ্যপাড়ার হিন্দু বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায় পাকিস্তানি সেনারা। হামলার দিন তার স্বামী নেপাল চন্দ্র মালো গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। কিশোরী গৃহবধূ যোগমায়া মালো একা বাড়িতে থাকায় অন্যদের সঙ্গে পালাতে সাহস করেননি। রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ঘর থেকে জোর করে নিয়ে যায় মাদারীপুরের এআর হাওলাদার জুট মিলে। তার সঙ্গে নেওয়া হয় আরও ৩০-৩৫ জন নারীকে। সেখানে পাঁচদিন নির্যাতন করার পর ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। পরে মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে বাড়িতে এসে স্বামীকে খুঁজে পান তিনি।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে পড়লেও পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের স্মৃতি এখনও তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। প্রায় ৩০ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি দক্ষিণ মধ্যপাড়া এলাকার একটি ছোট্ট টিনের ঘরে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাওয়ার পরে যোগমায়া মালোকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে থাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তবে যোগমায়া সেখানে থাকতে রাজি হননি। পরবর্তীকালে তাকে জানানো হয়, নিজস্ব জমি থাকলে বীর নিবাস নির্মাণ করে দেওয়া হবে। ছেলে অশোক মালো ও উত্তম মালো পেশায় জেলে। ঋণ করে তারা তিন বছর আগে মায়ের নামে ৪ শতাংশ জমি কিনেছেন একটি ঘর পাবেন বলে। কিন্তু বয়সের ভারে নুয়ে পড়া যোগমায়া মালো সেই ঘর পাননি এখনও।

যোগমায়া মালোর পুত্রবধূ ডলি মালো সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “অসুস্থ হলে নাওয়া-খাওয়া সবই করে দিতে হয় আমাকে। কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আমার শাশুড়ি। তখন ঢাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রায়ই বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি অসুস্থ থাকেন। সরকার যদি বেঁচে থাকতে তাকে ঘরটি দিতো তাহলে তিনি ঘরটা দেখে যেতে পারতেন।”

যোগমায়া মালোর ছেলে অশোক চন্দ্র মালো সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পরে আর নিজের ঘরে মাথা গোজার ঠাঁই হয়নি। এখন টিনের একটি ছোট্ট ঘরে ভাড়া থাকি আমরা। বাড়ির মালিককে মাঝে মধ্যে ভাড়া দেই, আবার কখনো কখনো দিতে পারি না। খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন যায় আমাদের। মা বেঁচে থাকতে যদি সরকার বীর নিবাস তৈরি করে দিতো, তাহলে মাকে নিয়ে থাকতে পারতাম।”

বীরাঙ্গনা বীর মুক্তিযোদ্ধা যোগমায়া মালো সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এই জন্য আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ঘর বাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়েছিল। আমাকে অপমান করেছিল। নির্যাতন করেছিল। আমার থাকার মতো কোনো ঘর নেই। ছোট একটি ঘরে ছেলে, বউ, নাতি নিয়ে থাকি। সরকার আমাকে ঘর দেবে বলে আমার ছেলেরা খুব কষ্ট করে আমাকে জমি কিনে দিয়েছে। ৩ থেকে ৪ বছর ধরে শুধু বলছে ঘর দেবে, কিন্তু এখনও ঘর দেয় নাই।”

শরীয়তপুর সদর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ শিকদার সংবাদ প্রকাশকে বলেন, সদর উপজেলার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যোগমায়া মালো অন্যতম একজন। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার গেজেট প্রকাশ হয়েছে। উপজেলা ও জেলা প্রশাসন তাকে একটি বীর নিবাস তৈরি করে দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু এখনও ঘরটি তিনি পাননি। যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে যোগমায়া মালো ঘরটি পায়, তাহলে বাকি জীবন তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে পার করতে পারবেন।

শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বীর মুক্তিযোদ্ধা যোগমায়া মালো। তাকে এখনও বীর নিবাস দেওয়া যায়নি, কারণ তার নামে জমি ছিল না। তবে জানতে পেরেছি এখন তার নামে জমি রয়েছে। তার নামে থাকা জমির নথিপত্র আমাদের কাছে তিনি দিয়েছেন। পরবর্তী ধাপে আমরা তাকে একটি বীর নিবাস নির্মাণ করে দেওয়ার চেষ্টা করব। পাশাপাশি তার যেকোনো প্রয়োজনে তার পাশে থাকবে উপজেলা প্রশাসন।”

Link copied!