• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

এদেশে নাসার ছবির উন্মাদনা স্রেফ সায়েন্স ফিকশন মুভির মতো


মনজুরুল হক
প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২২, ০৬:৩৮ পিএম
এদেশে নাসার ছবির উন্মাদনা স্রেফ সায়েন্স ফিকশন মুভির মতো

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের প্রথম রঙিন ছবি প্রকাশের পর সারা বিশ্বে সাড়া পড়ে গেছে। বাংলাদেশের নেটিজেনদের মধ্যেও। এটা পজিটিভ যে, প্রতিদিনকার ব্যক্তিগত কথাবার্তা ছাপিয়ে হাজার হাজার মানুষ ছবিটি পোস্ট দিয়ে জানতে এবং জানাতে চেষ্টা করছেন। ছবিটি NASA কীভাবে তুলেছে, কত বছর আগের ইমেজ, কত সময় লেগেছে এসব নিয়ে বিস্তর লেখা হয়েছে। সংক্ষেপে—জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের প্রথম ফুল-কালার ডিপ ফিল্ড ইমেজ এবং একই সঙ্গে মানবজাতির চিন্তার ইতিহাসে দূর মহাবিশ্বের ডিপেস্ট ও শার্পেস্ট ইনফ্রারেড ইমেজ। ডিপ ফিল্ড ইমেজ বলতে বোঝায়, যখন একটা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ছবি তুলতে আকাশের নির্দিষ্ট একটি অংশে অনেক লম্বা সময় ধরে এক্সপোজার রাখা হয়। এ ছবির ক্ষেত্রে সেটা সাড়ে বারো ঘণ্টা। হাবল টেলিস্কোপ মানুষ যেসব জ্যোতিষ্ক ‘চোখে’-ই দেখতে পেত না, সেটাও অনায়াসে দেখতে পাচ্ছে জেমস ওয়েবের নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা। ছবিতে যে অংশটুকু দেখানো হয়েছে তা ইউনিভার্সের এক ধূলিকণার সমান জায়গার। যার নাম- SMACS 0723 cluster.  NASA’র ভাষায়—“This slice of the vast universe covers a patch of sky approximately the size of a grain of sand held at arm’s length by someone on the ground.”

এই ছায়াপথগুচ্ছ থেকে আলো এসে পৌঁছাতে ৪.৬ বিলিয়ন বছর অর্থাৎ ৪৬০ কোটি বছর লেগেছে। ছবিতে যে বাঁকা ইমেজগুলো দেখা যাচ্ছে, সেটা স্থান-কাল বক্রতা! জেনারেল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি অনুযায়ী ছবির কেন্দ্রে থাকা ছায়াপথগুচ্ছের গ্রাভিটির কারণে স্পেস-টাইম কার্ভেচার  দেখা যাচ্ছে।

অনন্ত-অসীম মহাশূন্যের বিশালতা পৃথিবীর ম্যাথ্যামেটিক্সে প্রকাশ করা যাবে না। মহাশূন্যের যে অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের এই ছবি আমরা দেখছি, তার মধ্যেই রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি, যার প্রতিটির ভেতরে রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ-নক্ষত্র। ধারণা করে হয়, এমন ২০০ বিলিয়নেরও বেশি গ্যালাক্সি আছে এই মহাবিশ্বে।

এবার একটা কনক্লুশন টানা যাক। এই অনন্ত-অসীম জিরো-টু-জিরো মহাশূন্যের খুবই ক্ষুদ্র বালুকণার মতো অঞ্চলের ছবি এই SMACS 0723 cluster ছবিটির মধ্য থেকে একটা ‘ফেঞ্চফ্রাই-এর মতো দেখতে’ একটা অংশের মধ্যে আছে বিলিয়ন বিলিয়ন তারা, গ্রহ-নক্ষত্র। আমাদের সৌরজগৎ সেই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের একটি। তারপরও সৌরজগৎ আমাদের চিন্তায় কত বিশাল! যার মধ্যে বৃহস্পতি গ্রহ আছে, যা পৃথিবী থেকে ১ হাজার ৩২১ গুণ বড়। অর্থাৎ সৌরজগতের খুবই ক্ষুদ্র একটা গ্রহ এই পৃথিবীতে আমাদের বসবাস। এই প্লানেটের দেশ-জাতি, সাড়ে সাতশ কোটি মানুষ, তাদের ক্ষুধা-দারিদ্র্য, অন্ন-বস্ত্র, প্রেম-প্রীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারণাস্ত্র, রাজনীতির খেয়ো-খেয়ি, দলাদলি, ধর্ম-ধর্মী, তুকতাক, ন্যায়-অন্যায়, জাতিগত সংঘাত, শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই, মায়া-মমতা, হাসি-কান্না নিয়ে ওই মহাশূন্যের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি, গ্রহ-নক্ষত্র, তারকারাজি আর অনন্ত-অসীম মহাশূন্যের কোনো মাথাব্যথা নেই। এই মহাশূন্যের তুলনায় পৃথিবী আনকাউন্টেবল একটি অবজেক্ট মাত্র। সেই পৃথিবীর অতি ক্ষুদ্র একটি অঞ্চল বাংলাদেশে। সেই দেশে বসে আমরা যারা SMACS 0723 cluster দেখে বিস্মিত হচ্ছি, চমৎকৃত হচ্ছি, ‘অনেক রহস্যের মীমাংসা হলো’ বলে মতামত দিচ্ছি, তার কোনো ভিত্তি নেই আসলে। কারণ, আমরা এমনই একটা দেশে বসবাস করছি যেখানে রাষ্ট্রের টপ-টু-বটম কোথাও বিজ্ঞানচর্চা নেই, ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানের সকল ফ্যাসিলিটিজ উপভোগ করেও বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস নেই! বিজ্ঞান-চেতনাগত তুলনায় বিশ্বের সবচেয়ে কূপমণ্ডুক একটি দেশের নাগরিক আমরা। NASA’র ছবিটি নিয়ে যখন আমরা উদ্বেল, সেসময় আমাদের একটি ‘রাষ্ট্রধর্ম’ আছে। ধর্মের নামে হাজার হাজার খুনোখুনি আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলোতে মহাবিশ্ব, মহাশূন্য, ইভাল্যুশন নিয়ে বর্ণনার পরেই লেখা থাকে—‘এসব বিজ্ঞানিদের মতামত’। তারপরই লেখা থাকে ‘আল্লাহ কীভাবে কত দিনে দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন’ সেই মতবাদ। এবং সেটাই স্বীকৃত।

সুতরাং NASA’র SMACS 0723 cluster নিয়ে আমাদের উন্মাদনা-উদ্দীপনা স্রেফ সায়েন্স ফিকশন মুভির মতো। ভিডিও শেষ হলে আবার নিজেদের কূপমণ্ডুকতায় ফেরত যাওয়া।

পুনশ্চ (১) : দুজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর extraterrestrial intelligence প্রজেক্টের এক রিপোর্টে ২০২০ সালেই একটা Astronomers catalogue এঁকেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল— ১০ হাজার বিশ্ব আমাদের ‘আর্থ’কে দেখতে পাচ্ছে এবং সম্ভাব্য কলোনি হিসেবে বিবেচনা করছে!

পুনশ্চ (২) : ২০২১ সালের এপ্রিলে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ছাত্র ক্যাপ্রিস ফিলিপসের মতে, হাবলের উত্তরসূরি নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) পরবর্তী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে অন্যান্য গ্রহে জীবনের লক্ষণ শনাক্ত করতে পারবে।

পুনশ্চ (৩) : হ্যাঁ, আপনি এসবের পেছনে মনে মনে যে ‘ক্রিয়েটর’ খুঁজছেন তার কোনো অস্তিত্ব নেই। ৪৬০ কোটি আলোকবর্ষ আগের যে ছবি দেখছেন, আগামীতে অমন ৪,৬০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের বস্তু দেখতে পেলেও এর তল পাবেন না। সেই মহাশূন্যতা এবং মহাব্যাপ্তি মানুষের বিজ্ঞান, টেকনোলজি, এমনকি কল্পনারও বাইরে।

Link copied!