• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

অযাচিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনিশ্চয়তায় যে শিশুর ভবিষ্যৎ


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২, ০৬:৫৭ পিএম
অযাচিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনিশ্চয়তায় যে শিশুর ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সুসময় এখন। সাফ উইমেন চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের ফুটবল দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। নারী ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এরইমধ্যে ব্যর্থতার বৃত্তে আটকা থাকা বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকা কম্বোডিয়াকে হারিয়েছে। নেপাল থেকে কাপ জয়ী ফুটবল দল ঢাকায় ফিরে পেয়েছে রাজসিক সংবর্ধনা। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ব্যবস্থাপনায় যে সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয় তা নিয়ে চলছে আলোচনা-উদযাপন।

নারীদের এই সাফল্যে আমাদের অগ্রগতির পথ নির্দেশ করছে। দেশবাসী স্বভাবত আনন্দিত। কিন্তু এরইমধ্যে একদল লোক তাদের পূর্বতন ধ্যানধারণা থেকে বেরুতে পারছে না। নারী ফুটবলারদের নিয়ে তাদের আপত্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশবাসী কেন আনন্দিত এনিয়েও আছে তাদের অনুযোগ-অভিযোগ। এই অনুযোগ ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকছে না, গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে প্রচারণাও চলছে। নারীকে অন্তঃপুরবাসিনী করে রাখার অভিলাষের মূলে কুঠারাঘাতের এই উপলক্ষ সহ্য হচ্ছে না। পোশাক নিয়ে আছে তাদের আপত্তি, এমনকি কেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এতো আয়োজন এনিয়েও ক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক এই ফুটবল টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই নারী ফুটবল দলের প্রতিটি অর্জন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে আসছিল। ফাইনালে স্বাগতিক নেপালের বিপক্ষে জয়ী হয়ে ইতিহাস রচনা করার সে ক্ষণ যখন এলো তখন বাঁধভাঙা যে উল্লাস আমরা লক্ষ করেছি সেটা আগে কখনই দেখা যায়নি। একই সঙ্গে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছিল সেই পুরনো ছিদ্রান্বেষণ। ফুটবলারদের এই অর্জনকে ধর্মের বিপক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সামাজিক মাধ্যমে বেশ কজন ইসলামি বক্তা যখন তাদের অভিমত প্রকাশ করেছিল তখন এর প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে। ধর্মীয় সে বক্তাদের অনুসারীদের অনেকেই সুর পাল্টে সংবর্ধনা ও আনন্দকে বাড়াবাড়ি হিসেবে উল্লেখ করে একে ধর্মের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মেতে ওঠে।

এরই মধ্যে সালেহ আহমাদ তাকরিম নামের এক শিশু সৌদি আরবের মক্কার পবিত্র হারাম শরিফে ৪২তম বাদশাহ আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়। ১১১ দেশের ১৫৩ প্রতিযোগীর অংশগ্রহণের ওই প্রতিযোগিতায় তাকরিম পাঁচটি ক্যাটাগরির মধ্যে চতুর্থ ক্যাটাগরিতে তৃতীয় স্থান অর্জন করে। ওই প্রতিযোগিতায় মিশর, সুদান, সৌদি আরব, কাজাখাস্তান, বাহরাইন, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, গাম্বিয়া, লিবিয়া, কেনিয়া, থাইল্যান্ড, আফ্রিকা ও জার্মানি থেকে অংশ নেওয়া আরও ১৪ জন প্রতিযোগী তাকরিমের মতো পুরস্কৃত হয়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয় ১১১ দেশের ১৫৩ প্রতিযোগীর মধ্যে বাংলাদেশের তাকরিম তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। সামাজিক মাধ্যমের এই ভাষায় অধিকাংশ গণমাধ্যমও প্রতিবেদন করে। এতে বিভ্রান্তি আরও বাড়ে।

সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা না-হয় তথ্য সম্পর্কে অনেকটাই অসচেতন, কিন্তু গণমাধ্যমের এমন অসচেতনতা অনুচিত। বাকি সকল দেশের প্রতিযোগীদের রীতিমতো অবজ্ঞা করে যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করেছে, অনেকেই তাতে তথ্যের সত্যতা এবং গণমাধ্যমের চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এখানে যেখানে আবেগ-অনুভূতির চাইতে সঠিক তথ্য পরিবেশনের দরকার ছিল সেখানে অনেক গণমাধ্যম সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এটা করতে খুব বেশি কাঠখড় পোহাতে হতো না। সৌদি আরবের মিনিস্ট্রি অব
ইসলামিক অ্যাফেয়ার ওয়েবসাইটে সব তথ্য উল্লেখ ছিল, এবং এটা আরবি ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে ভাষাতেও।

নারী ফুটবল দলকে নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-মাতামাতির বিপক্ষে একটা উপলক্ষের প্রয়োজন ছিল অনেকের। কিছু গণমাধ্যমের নীতিবিরুদ্ধ সংবাদ পরিবেশন তাদের জন্যে সহায়ক হয়েছে। কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় স্থান অধিকারী নয়, একটা শিশুকে তৃতীয় বলে দাবি করে কিছু লোক ব্যাপক প্রচারণায় নেমে যায়, যা রীতিমতো অনৈতিক। এটা একটা পক্ষের রাজনৈতিক ইসলামের প্রচারণা হলেও অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করে এর অংশ হতে থাকে। সামাজিক মাধ্যম হয়ে ওঠে ধর্মীয় পরিচয় পরীক্ষার ক্ষেত্র অনেকটাই। যেন অভিনন্দন জানাতেই হবে, তা না হলে ধর্ম যায় যায় অবস্থা!

অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতি যারা সৃষ্টি করেছে তাদের উদ্দেশ্যই ছিল নারী ফুটবল দলের অর্জনের পাল্টা কিছু উপস্থাপন। নারীর অর্জনকে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার যে অভিসন্ধি সেটাতে তাদের কিছুটা সাফল্য মেলে যখন বিভিন্ন মাধ্যমে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি তাকরিম নামের শিশুর অর্জনকে বিশ্বের তৃতীয় সেরা অভিহিত করে অভিমত প্রকাশ করে। শিশু তাকরিম এক্ষেত্রে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অথচ এখানে তার দায় ছিল না সামান্যই। সে এখনও বুঝতে পারছে না, কিংবা বোঝার বয়স হয়নি এখনও তার।

সালেহ আহমাদ তাকরিমের অর্জন এবারই প্রথম নয়। এর আগে দেশে-বিদেশের একাধিক মঞ্চে পুরস্কৃত হয়েছে সে। গত বছরের ইরানে অনুষ্ঠিত হিফজ প্রতিযোগিতায় সে প্রথম হয়েছিল। সে সময় প্রথম স্থান অর্জন করলেও এবারের মতো তাকে নিয়ে এতো মাতামাতি হয়নি। বিমানবন্দরে কেউ ফুল নিয়ে যায়নি তার জন্যে, ছাদখোলা গাড়িতে করে তাকে নিয়ে আসা হয়নি, গভীর রাতে বিমানবন্দরের বাইরে তার জন্যে হাজারও মানুষ অপেক্ষা করেনি। কিন্তু এবার সবটাই হয়েছে, প্রথম না হয়ে, এমনকি প্রাইজমানি প্রাপ্তির হিসাবে ১২তম হয়েও অনেক আয়োজন ছিল তার জন্যে। অনেকেই তাকে রাষ্ট্রীয় তরফে গণসংবর্ধনা দেওয়ার দাবিও জানাচ্ছেন। কিন্তু কেন?

যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল তার ফেসবুক পেজে সালেহ আহমাদ তাকরিমকে অভিনন্দন জানিয়ে একটা পোস্ট করেছেন। সে পোস্টের মন্তব্যে অনেকেই তাকে রাষ্ট্রীয় তরফে গণসংবর্ধনার দাবি জানাচ্ছেন। প্রতিমন্ত্রী অনেকের মন্তব্যের জবাবে বলছেন এটা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নয়; ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিষয়। তাদের মন্তব্যে পুনর্বার প্রমাণ হয় নারী ফুটবলারদের রাজসিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে তাই তাকরিমকেও দিতে হবে! ধর্মচর্চা কিংবা কোরআনপাঠ কি খেলাধুলার অংশ যে এখানে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও প্রতিমন্ত্রীকে কিছু করতে হবে? ভাবা যায়?

ধর্মীয় আচার-অনুশীলন-অনুশাসন আগে যেখানে ছিল ইবাদতের অংশ, এখন এটা হয়ে গেছে প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিরুদ্ধপক্ষ কেবলই নারী এবং তাদের অর্জন। নারী ফুটবলাররা সাফ উইমেন চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে সংবর্ধনা পেয়েছে, আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে; তাই এর পাল্টা কিছু করতে হবে এমন মানসিকতা। সামাজিক মাধ্যমে কেন লোকজনকে ধর্ম পরীক্ষা দিতে হবে? কী পরিবেশ, কোন পরিণতির দিকে এগুচ্ছি আমরা?

তাকরিম নামের শিশুটিকে নিয়ে যারা অযাচিত এই খেলায় মেতেছে তারা শিশুটির ভবিষ্যৎকে কি অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে না? গভীর রাতে বিমানবন্দরে হাজার-হাজার মানুষের অপেক্ষা, হাতে ফুলের তোড়া, গলায় ফুলের মালা কি তাকে সাফল্যের মাপকাঠি নিয়ে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে না? আগে প্রথম হয়ে এসেও যেখানে জুটেনি ফুল, দেখা মেলেনি মানুষের সেখানে পাঁচ ক্যাটাগরির একটা প্রতিযোগিতার একটা ক্যাটাগরিতে তৃতীয় স্থান পেয়ে কেন এমন এতো আয়োজন? মাত্র তেরো বছর বয়স যার তার মাথায় কি জাগছে না এমন প্রশ্ন?

শিশুর জন্যে বাসযোগ্য পৃথিবী রচনার স্লোগান শুনি আমরা। এদিকে আমাদের চোখের সামনে একটা প্রতিভাবান শিশুকে নিয়ে ধ্বংসের খেলা শুরু হয়েছে। তার প্রতিভাকে ধ্বংস করে দিতে চায় যারা, তারা ধর্মের নাম নিয়েছে। ধর্মকে খেলাধুলার সঙ্গে তুলনা করছে তারা নিজেদের স্বার্থে। তাদের কবল থেকে শিশু তাকরিমকে বাঁচাতে হবে, তার ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক করতে হবে। এখানে কঠোর হওয়ার প্রয়োজন হলে সেটাই করতে হবে।

তাকরিমের জন্যে ভালোবাসা। অর্জন তার যতখানিই হোক অভিনন্দন তার প্রাপ্য, তাকে অভিনন্দিত করি; একই সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত যেন না হয় তার ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করি!

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

Link copied!