• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

বাংলাদেশ সার্কাস বোর্ড-বিসিবি


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২২, ০৭:৫২ পিএম
বাংলাদেশ সার্কাস বোর্ড-বিসিবি

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান। মাঠে এবং মাঠের বাইরে; দুই ক্ষেত্রেই তিনি সবার উপরে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ক্রিকেট বিশ্বে, মাঠে এবং মাঠের বাইরে তার মতো পারফরমার খুব বেশি নেই। মাঠে তার পারপরম্যান্স নিয়ে কোনো সংশয় নেই। বাংলাদেশের তো বটেই, ধারাবাহিকতা বিবেচনায় সাম্প্রতিকালে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের তালিকায় তার নাম থাকবে সবার উপরে। আরেকটু নিয়মিত খেললে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার সুযোগও ছিল তার সামনে। কিন্তু তিনি হেলায় সে সুযোগের অপমৃত্যু ঘটিয়েছেন। তারপরও ক্রিকেট মাঠে এখন পর্যন্ত যা করেছেন, তার অমরত্ব নিশ্চিত হয়ে গেছে। তবে তার মাঠের বাইরের পারফরম্যান্স মাঠের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বরং বিতর্কের পারফারম্যান্সে তিনি মাঠের চেয়েও বেশি ধারাবাহিক। মাঠের খেলায় ছুটিতে থাকার সময়ও বিতর্কের খেলায় অনুপস্থিত থাকেন না সাকিব আল হাসান। বরং এক বিতর্ক থেকে আরেক বিতর্কে যেতে সময় নেন না মোটেই। কেউ কেউ বলেন, বিতর্কে না থাকলে নাকি সাকিব চাঙা থাকেন না।

সাকিবের অপকর্মের তালিকা অনেক লম্বা। জুয়ারির সাথে গোপন যোগাযোগ, সেই অপরাধে আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় এক বছর মাঠের বাইরে কাটানো, বিসিবিকে থোড়াই কেয়ার করা, মাঠে এসেও বিশ্বকাপের টিম ফটোসেশনে অংশ না নেয়া, ক্যামেরার সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, দর্শক পেটানো, ভক্তের ক্যামেরা ভেঙে ফেলা, করোনার বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো  আম্পায়ারের দিকে তেড়ে যাওয়া, দেশের হয়ে না খেলার হুমকি দেয়া, চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরও বারবার যেনতেন কারণে ছুটি চাওয়া, বিশ্রামের কথা বলে ছুটি নিয়ে শেয়ারবাজারের পক্ষে প্রচারণা চালানো, খেলার চেয়ে ব্যবসায় বেশি সময় দেয়া, শ্রমিকদের বেতন না দেয়া। এত কিছুর পরও মাঠে নামলে সাকিবই সেরা। মুহূর্তেই মানুষ ভুলে যায় সাকিবের মাঠের বাইরের সব অপকর্ম। বারবার সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, সবচেয়ে আকর্ষণীয় পোস্টার বয়।

তবে সর্বশেষ বিতর্কটি অনেক নাটকীয়। একটা জিনিস সবাই মানবেন, অর্থের প্রতি সাকিব আল হাসানের দুর্দমনীয় টান। এটাকে আমি অন্যায় মনে করি না। নিজের খ্যাতি বিক্রি করে বৈধ পথে অর্থ উপার্জনের অধিকার সবারই আছে। এবং সেটা যত ইচ্ছা তত। অনেকে বলেন, সাকিবের আর কত টাকা লাগবে? এটা আসলে সাকিব ঠিক করবেন, তার চাহিদার সাথে আমার-আপনার চাহিদা নাও মিলতে পারে। তিনি যত উপার্জন করতে পারবেন, সেটাই তার চাহিদা। অবসর নেয়ার আগেই সাকিব নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একের পর এক ব্র্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর হওয়া, বিজ্ঞাপনচিত্র করা তো আছেই কাকড়া ব্যবসা, হোটেল ব্যবসা, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ই-কমার্স, স্বর্ণ ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা— সব জায়গাতেই বিনিয়োগ করেছেন তিনি। ব্যাংকের লাইসেন্স চেয়েও পাননি। তবে অর্থ উপার্জনেরও কিছু নিয়ম-কানুন, নীতি নৈতিকতা আছে। সেটা না মানলেই সমস্যা। চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার হিসেবে যেকোনো ব্যবসা, বিজ্ঞাপন বা চুক্তি করার আগে বিসিবির অনুমতি নেয়া বা অন্তত অবহিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু সাকিব কখনোই বোর্ডকে পাত্তা দেন বলে মনে হয় না। তবে এবার সীমা ছাড়িয়েছেন। বেটউইনার নিউজ নামে একটি নিউজপোর্টালের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে চুক্তি করেছিলেন সাকিব। এমনিতে একটি নিউজপোর্টালের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু বেটউইনার নিউজের মূল প্রতিষ্ঠান বেটউইনার মূলত জুয়ার কারবার করে। আর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নীতি হলো, জুয়া এবং জুয়া সংশ্লিষ্ট কোনো বা প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনো সম্পর্ক না রাখা। কিন্তু সাকিব কখনোই এসব নীতি-নৈতিকতার ধার ধারেননি। সাকিব বেটউইনার চেনেন না, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি নিশ্চিত সাকিব জেনেশুনেই বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে বেটউইনারের সাথে চুক্তি করেছেন। তবে দুদিন আগে যখন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন কড়া ভাষায় বলে দিলেন, বেটউইনারের সাথে চুক্তি বাতিল না করলে সাকিবের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে না বোর্ড। শুনে আমি চমকে গেছি, সাকিবের ব্যাপারে এত কড়া হওয়ার সাহস কোথায় পেলো বোর্ড? অতীতে সাকিব বারবার বোর্ডকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। কিন্তু অনেক হম্বি তম্বি করলেও বোর্ড সাকিবের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। কিন্তু একদিনের মধ্যেই যখন সাকিব জানালেন, বেটউইনারের সাথে চুক্তি বাতিল করছেন তিনি। আমার একটু সন্দেহ হলো, সাকিব তো এত সহজে মাখা নোয়ানোর পাত্র নয়। এখন পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে সাজানো মনে হচ্ছে। এখন শুনছি, চুক্তি বাতিল করলেও সাকিবকে ১০ কোটি টাকা ফেরত নেবে না বেটউইনার। প্রথম কথা হলো, সাকিবের সাথে চুক্তি করতে পারাটাই বেটউইনারের জন্য বিশাল বিজয়। তারচেয়ে বড় কথা, এই চুক্তি নিয়ে হুমকি, নতি স্বীকার— সব মিলে নাটকীয়তা যা হলো; তাতে বেটউইনারের কাঙ্ক্ষিত প্রচারণা হয়ে গেছে। সাকিব কোনো সাধারণ কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হলে ১০ বছরে যতটা প্রচারণা হতে পারতো, বেটউইনার ৩ দিনে তা পেয়ে গেছে। বাংলাদেশের আমজনতাও এখন বেটউইনারকে চিনে গেছে। ভবিষ্যতে বেটউইনারের জুয়ার বোর্ডে বাংলাদেশিরা এগিয়ে থাকবে নিশ্চিত। তাতে সাকিবকে দেয়া ১০ কোটি টাকা কয়েকগুণ হয়ে ফিরে আসবে।

ঘটনা এটুকু হলেও ঠিক ছিল। এরপর বিসিবি যে চমক দেখালো, তা ছাড়িয়ে গেছে আগের সব নাটকীয়তাকেও। দুদিন আগে যার সাথে বোর্ডের সম্পর্ক থাকা না থাকার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, তাকেই অধিনায়কত্ব দেয়া হলো টি-২০ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। তবে সাকিবকে অধিনায়ক করা হলেও টি-২০ দলের নিয়মিত অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দেয়ার ঘোষণা কিন্তু দেয়া হয়নি। এমনিতে মাহমুদুল্লাহর যা পারফরম্যান্স, তাতে তার দলে থাকাটাই অনিশ্চিত ছিল। জিম্বাবুয়ে সফরে মাহমুদুল্লাহকে বিশ্রাম দিয়ে নুরুল হাসান সোহানকে টি-২০ দলের অধিনায়ক করা হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় ম্যাচে সোহানের ইনজুরির সুবাদে মাহমুদুল্লাহ দলে ফিরলেও অধিনায়কত্ব ফিরে পাননি। সে ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেন মোসাদ্দেক হোসেন। বিশ্রাম থেকে কেন মাহমুদল্লাহকে ফিরিয়ে আনা হলো, কেন তাকে অধিনায়কত্ব ফিরিয়ে দেয়া হলো না, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এশিয়া কাপের ১৭ জনের দলে মাহমুদুল্লাহ আছেন বটে, তবে অধিনায়ক সাকিব। তার মানে মাহমুদুল্লাহর অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ারের ইতি ঘটলো অঘোষিতভাবেই।
এটা ঠিক সাকিব বাংলাদেশ দলের সেরা পারফরমার। তাই অধিনায়কত্ব তারই সাজে। এছাড়া সাকিব বাংলাদেশ টেস্ট দলেরও অধিনায়ক। এখন জানা যাচ্ছে, অধিনায়কত্বের শর্তেই সাকিব বেটউইনারের সাথে চুক্তি বাতিলে সম্মত হয়েছেন। সেরা পারফরমার হলেও সাকিবের অধিনায়কত্ব নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্নটি কিন্তু রয়েই গেছে। জুয়ারির সাথে গোপন যোগাযোগের অপরাধে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরে আসা কাউকে দলের অধিনায়ক বানানোটা ভালো উদাহরণ নয়। এর আগে অন্য কোনো দেশে শাস্তি পাওয়া অপরাধীকে অধিনায়ক বানায়নি। আর টি-২০ অধিনায়ক হওয়ার দুদিন আগেও সাকিব ছিলেন একটি জুয়া প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। দলের সেরা খেলোয়াড়ই অধিনায়ক হবেন, এমন কোনো কথা নেই। নেতৃত্বের সাথে পারপরম্যান্সের পাশাপাশি দৃঢ় নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়াটাও জরুরি। সাকিব সেরা খেলোয়াড় বটে, তবে তিনি তরুণদের আইডল হওয়ার মতো দৃঢ় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সবকিছু দেখেশুনে বলতে মন চাইছে, ‘চলিতেছে সার্কাস’।

Link copied!