• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

অসহনীয় দ্রব্যমূল্যে দিশেহারা ক্রেতা


সুব্রত চন্দ
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২২, ০৯:৩৩ পিএম
অসহনীয় দ্রব্যমূল্যে দিশেহারা ক্রেতা

প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। কিন্তু সেই তুলনায় বাড়ছে না সাধারণ মানুষের আয়। অসহনীয় দ্রব্যমূল্যের কারণে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা অবস্থার মধ্যে পড়ছেন ক্রেতারা। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের পুষ্টিহীনতা বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর নিত্যপণ্য ও কাঁচাবাজারগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, মরিচ— সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। অন্যান্য বছর শাক-সবজির দাম কম থাকলেও, এবার সেটিও সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে আছে। শুধু নিত্যপণ্য বা কাঁচাবাজারই নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপনে প্রয়োজনীয় সকল কিছুর দামই বেড়েছে উচ্চহারে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্য ও শিল্পপণ্যের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। প্রতিনিয়ত মানুষ বাড়লেও চাহিদা অনুসারে উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়েনি। এছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়েছে। যার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল কিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি দাম ক্রেতাদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

এদিকে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতির চাকা ফের থমকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। করোনার কারণে আয় হারানো মানুষরাই এখনো ঠিকমতো উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নতুন করে যদি সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে ফের কাজের সুযোগ সংকুচিত হবে। এতে বড় ধরনের বিপাকে পড়বেন নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীরা।

নিত্যপণ্যের দামে আগুন!

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে প্রতি কেজি মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৪ টাকা, নাজিরশাইল ৬৬ থেকে ৭২ টাকা, আটাশ জাতের চাল ৪৭ থেকে ৫০ টাকা, পাইজাম (স্বর্ণা) ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা, পাইজাম (গুটি) ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা।

গত এক বছরের বেশি সময় ধরে এমন বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে প্রতি জাতের চাল। মৌসুমভেদে নতুন ধান উঠলেও ক্রেতার নাগালে আসছে না চালের দাম। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমান আমন মৌসুমে নতুন ধান উঠেছে কৃষকের ঘরে। সেগুলো চাতাল মালিকদের মিল হয়ে উঠছে বাজারেও। হিসাব অনুসারে এখন চালের দাম কম হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো বেড়েছে ২-৩ টাকা। এর জন্য চাতাল মালিকদের কারসাজি এবং সরকারের যথাযথ তদারকির অভাবকেই দুষছেন বিক্রেতারা।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল বিক্রেতা শাহজাহান বলেন, ‍“নতুন আমন ধান উঠেছে। আশা করেছিলাম চালের দাম কমবে। উল্টো দাম আরো এক দফা বাড়লো। মাঝে মাঝে ১-২ টাকা দাম কমে, আবার ৩-৪ টাকা করে বেড়ে যায়। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে এই অবস্থা চলছে। সরকারের ঠিকমতো মনিটরিং নেই বলেই চাতাল মালিকরা ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।”

শুধু চাল নয়, দাম বেড়েছে ডাল, আটা, ময়দা, চিনিরও। বর্তমানে বাজারভেদে প্রতি কেজি দেশি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, গত সপ্তাহে যা ছিল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। এছাড়া মোটা দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা, ছোলা ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, মুগের ডাল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা, বুটের ডাল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা, অ্যাংকর ডাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।

এক মাস আগেও ৭০ টাকা বিক্রি হওয়া খোলা চিনি এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৬ টাকা। প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা, যা মাসখানেক আগেও ছিল ৭৫ টাকা। এছাড়া বর্তমানে দুই কেজির আটার প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা এবং ময়দা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। অথচ মাসখানেক আগেও দুই কেজির আটার প্যাকেট ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং ময়দার প্যাকেট ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ, মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং চিকন চালের দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। দেশি মসুর ডালের দাম বেড়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ এবং মোটা মসুর ডালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ। আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩৯ শতাংশ।

টিসিবির তথ্য অনুসারে, গত এক বছরে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং পাম অয়েলের দাম বেড়েছে ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

বর্তমানে বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকা এবং পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা। এছাড়া পুষ্টি ব্র্যান্ডের পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকা, বসুন্ধরা ব্র্যান্ডের ৭২০ টাকা, তীর ব্র্যান্ডের ৭৪০ টাকা এবং রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের ৭৫০ টাকা।

পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, ডিলারদের কাছ থেকে বাড়তি দামে কিনে আনতে হয়, তাই তারাও নিরুপায় হয়ে বেশি দামে বিক্রি করেন। আগে এক ড্রাম তেলের দাম ছিল ৩০ হাজার ১০০ টাকা। এখন প্রতি ড্রাম কিনতে হয় ৩০ হাজার ৬০০ টাকায়।

জুলফিকার আলী নামে এক বিক্রেতা বলেন, “দুই দিন আগে পুষ্টি ব্র্যান্ডের দুই লিটারের তেলের বোতল কিনেছি ৩২০ টাকায়। আজ কিনতে হলো ৩৩৫ টাকায়। কোম্পানিগুলো দাম বাড়ালে আমাদের কী করার আছে? আমরা তো আর নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কম দামে তেল বিক্রি করতে পারবো না।”

 

এদিকে প্রতিনিয়ত নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় বাজার করতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে ক্রেতাদের। আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে চাহিদার তুলনায় কম বাজার করতে হচ্ছে তাদের। সেই সঙ্গে আপোস করতে হচ্ছে পুষ্টি ও মানের সঙ্গে।

কারওয়ানবাজারে বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী অনীক সাহা বলেন, “প্রতি সপ্তাহে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াছে। কিন্তু আয় বাড়ছে না বছরেও। করোনার সময় তো উল্টো বেতনও কমেছে। তাই স্বাদ থাকলেও সাধ্য নেই। আগে চিকন চাল কিনতাম। এখন মোটা চাল কিনি।”

স্বস্তি নেই কাঁচাবাজারেও। বর্তমানে প্রতি কেজি বয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা, সোনালি জাতের মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৭০ টাকা, লেয়ার ২৩০ টাকা, সাদা কক জাতের মুরগি ২৫০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় মুরগির দাম কিছুটা কমলেও এখনো ক্রেতাদের হাতের নাগালে আসেনি। কারণ রাজধানীর বাজারগুলোতে স্বাভাবিক সময়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয় ১১০ থেকে ১২০ টাকা, সোনালি জাতের মুরগি ২২০ থেকে ২৪০ টাকা এবং লেয়ার ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা।

দাম বাড়ার বিষয়ে বিক্রেতারা বলছেন, শীতকালে মুরগির উৎপাদন কিছুটা কম হয়। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় এখন দাম একটু বেশি। এছাড়া বছরে শুরুতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রচুর মুরগির চাহিদা থাকায় দাম বেড়েছে।

মুরগির পাশাপাশি দাম বেড়েছে ডিমেরও। ফলে যারা মাংসের পরিবর্তে ডিম দিয়ে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতেন তাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি হালি মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা এবং হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা।

সম্ভু চক্রবর্তী নামের কারওয়ান বাজারের ডিম বিক্রেতা বলেন, ‍“কাঁচা মালের দামের ঠিক নেই। চাহিদা বাড়লে দাম বেড়ে যায়। এক সপ্তাহ আগেও প্রতি হালি মুরগির ডিম বিক্রি করেছি ৩৩ টাকায়। এই সপ্তাহে দুই টাকা বেড়ে গেল।”

সাধারণত শীতকালে সবজির বাজার অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। কিন্তু এবার সেখানেও যেন আগুন লেগেছে। শীতকাল অনুযায়ী সব ধরনের সবজিই বিক্রি হচ্ছে উচ্চমূল্যে। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মিষ্টিকুমড়া বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, মিষ্টি আলু ৪০ থেকে ৫০ টাকা, কচুরমুখী ৪০ থেকে ৫০ টাকা, পঞ্চমুখী কচু ৩০ টাকা, মানকচু ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শিম ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শালগম ৩০ থেকে ৪০ টাকা, মূলা ৩০ টাকা, করলা ৭০ থেকে ৯০ টাকা, শিমের বিচি ১২০ টাকা, সশা ৪০ থেকে ৫০ টাকা, বরবটি ৭০ থেকে ৮০ টাকা, গাজর ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, টমেটো ৩০ থেকে ৪০ টাকা, বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকা, মটরশুঁটি ৬০ টাকা, পেঁপে ২০ টাকা, ঢেঁড়শ ৫০ থেকে ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, লাল মূলা ৩০ টাকা, ধুন্দুল ৬০ টাকা, কাঁচামরিচ ৫০ টাকা। এছাড়া প্রতি পিস ফুলকপি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, বাঁধাকপি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, কলার মোচা ৪০ টাকা, লাউ ৮০ থেকে ১০০ টাকা, জালি লাউ ৫০ টাকা, ব্রকলি ২৫ টাকা এবং লেবু প্রতি হালি ২০ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা, দেশি রসুন ৫০ টাকা, ভারতীয় রসুন ১২০ টাকা, দেশি আদা ৮০ টাকা, চীনা আদা ১১০ টাকা এবং আলু ২০ টাকা।

রিজভী আহমেদ নামের এক ক্রেতা বলেন, “প্রতি বছর এই সময় সবজির দাম থাকে একেবারে কম। শীতকালে তাই বাজার করা নিয়ে তেমন চিন্তিত থাকতে হয় না। বিভিন্ন রকম সবজি খেয়েই ভালোভাবে দিন চলে যায়। কিন্তু এই বছর সবজির দামও বেশি। আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের কিছু দিন পর না খেয়ে থাকতে হবে। সবকিছুর দাম নাগালের বাইরে।”

এবার সবজির দাম বাড়ার বিষয়ে বিক্রেতারা বলেন, “জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। তাই সবরাহ থাকলেও সবজির দাম বেশি।”

মো আনিস নামের এক বিক্রেতা বলেন, “আগে যেখানে ট্রাক ভাড়া দিতে হতো ৫ হাজার টাকা, এখন সেখানে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। তাই পরিবহন খরচ গিয়ে পড়েছে সবজির দামে। আগের বছর ৫—৬ টাকায় বিক্রি করা মূলা, এই বছর ৩০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এখানে ক্রেতা-বিক্রেতা কারোই দোষ নেই।”

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে যেমন যৌক্তিক কারণ রয়েছে, তেমনি রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিও। তাই দ্রব্যমূল্যে এই অসহনীয় অবস্থা থেকে ক্রেতাদের মুক্তি দিতে সরকারের যথাযথ মনিটরিং ও অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ।

Link copied!