• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২২, ০৯:৪৩ এএম
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম :১২ অক্টোবর ১৯২৪–মৃত্যু : ৫ এপ্রিল ২০০০)

এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, আমি রবীন্দ্র সংগীতের খুব সমঝদার শ্রোতা নাই। দশ এগারো বছর ধরে আমি রবীন্দ্র সংগীত শুনছি। তার আগে মন দিয়ে শুনতাম না। যেদিন থেকে ওয়াইম্যাক্স নিলাম তখন থেকে ইউটিউবে শোনা শুরু। সুতরাং বাল্যকাল থেকে যারা রবীন্দ্র সংগীত ঘরে শুনে গেয়ে ভাজাভাজা করছে তাদের সাথে আমার কথা ও ভাবনা মিলে না। সুনীলের মতই আমার প্রিয় শিল্পী ঋতু গুহ। যখন শুনি ইউটিউবে গাইছেন, ‘এ পরবাসে রবে কে’ মনে হয় এরচেয়ে সত্য কী? আমার যুগের সবাই অর্ণবের ‘মাঝে মাঝে তব’ শুনেই ভক্ত, ঋতু গুহর ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ শুনলেই মনে হয় এই যে বেদনা, চিরদিন পাওয়ার আকুতি কি প্রবলভাবে আছে গানটায়। এখন তো অকাল প্রয়াত বিক্রম সিং, কিংবদন্তি সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন থেকে জয়তী, বন্যা, অদিতি মহসিন, অনিমা রায়, এমনকি কবীর সুমনের রবীন্দ্র সংগীতও ভালো লাগে!

তবে ধরুন কিছু শিল্পীর রবীন্দ্র সংগীতে আমি আকৃষ্ট হয়েছি বই পড়ে। প্রথমেই আসবে দেবব্রত বিশ্বাসের বই, ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত। কি অসাধারণ একটা বই। এ বইটা পড়ার পরে আমি দেবব্রত বিশ্বাসের গান শোনা শুরু করি। আর অনেকদিন আগে যায়যায়দিনে পড়েছিলাম, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে। যায়যায়দিন ছিল পপ কালচার নিয়ে জানা আর ট্রিবিউটের আখড়া। তো সেইখানে এক ভদ্রলোক তার প্রিয় শিল্পীকে নিয়ে লিখেছিলেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ে ছাত্র নন, কোনোদিন শান্তিনিকেতন যাননি, একটা ঢাকার লোক এত অসাধারণভাবে লিখেছে এটা বিস্ময়ের। আমার মনে হয় প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি পরিচয় ইস্যু না। সত্যিকারের ভালোবাসা ও জানাশোনা আর পড়াশোনার প্রতি নিবেদন থাকলে অনেককে নিয়েই ভালোভাবে লেখা যায়। তো যায়যায়দিনে সে ভদ্রলোক কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় আসলে দেখাও করেননি। খালি অডিটোরিয়ামে শুনেছেন ওনার গান। তার গায়ে নাকি কাঁটা দিচ্ছিল। ভাবছিলেন এখন মরে গেলেও দুঃখ নেই। কারণ তার প্রিয় শিল্পীকে এভাবে গাইতে দেখছেন। তার অনেক বছর পর আমি যখন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান শুনি, তাঁর ক্ষীণকায় আত্মজীবনী পড়ি, মনে হয় সেই লোকটার নামটা মনে রাখা উচিত ছিল। সেই লোক কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ে চাইতেও ভালো লেখেন।

ইউটিউবে গৌতম ঘোষের বানানো ডকুমেন্টারি পাবেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইন্টারভিউ নিয়ে, নাম ‘মোহর’। তার গান সব আছে কম বেশী ইউটিউবে। কিন্তু একুশ বছর আগে চলে যাওয়া কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আর পাওয়া যাবে না। পুরো শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে তিনি অনন্য ও অসাধারণ। গুগলে সার্চ দিলেই দেখবেন উইকিপিডিয়ার প্রথম দুটো লাইন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন স্বনামধন্য ভারতীয় বাঙালি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও শিক্ষিকা। রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিরোধীদলীয় প্রধান থাকতেন, লেখা হতো গণতন্ত্রের মানস কন্যা, আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের মানস কন্যা বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে সে, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার নাম রাখা হয়েছিল অন্যকিছু। রবীন্দ্রনাথ নাম দেন কণিকা। কিন্তু ডাক নাম মোহর। তা থেকে গেছে আজীবন। শান্তিনিকেতনেই তার জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা। সেই ঝোপ ঝাড় জঙ্গলে খেলাধুলা করা তার শৈশব। বইয়ে আছে প্রথমদিন সুচিত্রা মিত্রকে দেখার গল্প। তার বয়সী কোনো মেয়ে যে এত সুন্দর ও পরিপাটি হতে পারে এ বিষয়ে তার প্রথম ধারণা হয় সুচিত্রাকে দেখে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কণিকাকেই বেশী স্নেহ করতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি না বলতেন না। নাচ গান অভিনয় সব করতেন। আধো ঘুম আধো চেতনায় শিশু কিশোরদের গলার আওয়াজ শুনলেই বুঝতেন কবিগুরু আজ মোহর আসেনি নাকি এসেছে। তাই রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সংগীত, স্বরলিপি আঙ্গিক এসবে তিনি বংশানুগতভাবেই কঠোর। কখনো তিনি এ পথ থেকে সরে যাননি।

চল্লিশের আগে থেকে তার রেকর্ড বের হওয়া শুরু হয়, আকাশবাণীতে গাওয়াও শুরু করেন চল্লিশের শুরু থেকে। তিন দশক শান্তিনিকেতনে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। সেখানে প্রায় আমৃত্যুই তিনি গান শিখিয়েছেন। শেখানোকেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেন। তার স্বামীও ছিলেন অদ্ভুত, জার্মানিতে উচ্চ শিক্ষায় যাবেন, তা বাদ দিয়ে শান্তিনিকেতনের মোহে পড়লেন। মোহ আর মোহরে তার জীবনটা ছিল নিটোল, গোরা সর্বাধিকারীর। বঙ্গবন্ধুকে, রবীন্দ্রনাথের তার নিজের তোলা ছবি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এ উপহারে। সেদিনই বসার ঘরে ছবিটা টাঙানো হয়। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ে গানের ভক্ত ছিলেন জাতির পিতাও। ১৯৭২ সালে যখন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আসেন ঢাকায়, স্বাধীন দেশে, উনি বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেন গানের দুটো রেকর্ড। বঙ্গবন্ধু নাকি বলেছিলেন, “আপনি আমার মত অধমের জন্য গান বয়ে এনেছেন, এই দিন আমি কোনোদিন ভুলবো না।”

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশকে খুব ভালোবাসতেন। বারবার তিনি এসেছেন। রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ভাবতেন তার অন্যতম সেরা ছাত্রী। একবার সুফিয়া কামাল তার উদ্দেশ্যে একটা কবিতা লিখেছিলেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমার জীবনে অন্যতম আশীর্বাদ হলো শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা ও কবি গুরুর সান্নিধ্য। আর দ্বিতীয় বড় ঘটনাটা হলো আজ কবি সুফিয়া কামালের কবিতাটি। যে সম্মান দিলেন যদি সম্ভব হতো এ দেশেই বাকি জীবনটা পার করে দিতাম।” বাংলাদেশকে তিনি অন্য একটা দেশ ভাবতেন না কখনো। 
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর খুব ভালো একটা সম্পর্ক ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীকে তিনি বড় ভাইয়ের চাইতেও বেশি ভাবতেন। তো সৈয়দ মুজতবা আলী মজা করে বলতেন, “তোমার বাসায় একদিন খেতে যাবো।” কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় পড়লেন ভাবনায়। এমনিতেই তিনি সাংসারিক বিষয়ে খুব পারদর্শী নন। তাও তিনি সৈয়দ মুজতবা আলীকে খাওয়াবেন বলে রান্নায় মন দিলেন। শিখলেন কিছু। তারপর একদিন দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে চান খালি, কেমন হয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলী তো চালাক। বলেন, “ভালো... তবে কি ...। ‘তবে কি’ বলে আর কথা শেষ করেন না। এদিকে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁদো কাঁদো ভাব। পরে বললেন, “রান্না খুবই ভালো হয়েছে। তবে আমি চাই না তুমি রবীন্দ্র সংগীত বাদ দিয়ে রান্নাবান্না করো। খাওয়ার উপযোগী রান্না যে কেউ করতে পারবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান তুমি না গাইলে কে গাইবে।”

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ে একটা ছবি মুজতবা আলী নিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ছবির নিচে লাগাবেন বলে। সবাই তো অবাক। সৈয়দ মুজতবা আলী বললেন, “গুরুদেবের ছবি থাকবে আর তার সেরা শিষ্যের ছবি থাকবে না।”

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু তার সময়ের অন্য বড় মানুষদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। শক্তি আর সুনীল তো ছিলেন তার একনিষ্ঠ ভক্ত। সত্যজিৎ রায় ও বিজয়া রায়ও শান্তিনিকেতনে আসলে তার বাসায় কিছুটা সময় থাকতেনই। মহাশ্বেতা দেবী থেকে লতা মুঙ্গেশকার সবার প্রিয় তিনি। অবশ্য শেষ বয়সে তিনি আধ্যাত্মিকতায় যান। তার এক গুরু ছিলেন। সেই গুরু আবার অদ্ভুত। বলতেন, “জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। একজন অন্য ধর্মের মানুষকেও যদি আমার মত না ভাবি, তার ছোঁয়া এড়িয়ে চলি তাহলে মানব জন্ম বৃথা।”

মোটা ফ্রেমের চশমায় বাঙালি নারীকে যে অপূর্ব লাগবে, এটা দশকের পর দশক রেফারেন্স বানিয়েছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে কিছু লিখলাম না। কারণ সেই ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে বেঁচে থাকতে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন কারাগারে তিনি গান গাইতেন। এক অবাঙালি কয়েদি তার গান শুনে বলেছিল, “আপনি গান গাইলে মনে হয়, আমি যে জেলে এত কষ্টে আছি, আত্মীয় স্বজন, বাইরের সব চিন্তা ভুলে যাই। যদিও আমি আপনাদের বাংলাটাই বুঝি না।”

জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ এই অসাধারণ শিল্পীর প্রতি।

Link copied!