`মা` শব্দটি শুধু একটি ডাক নয়—এটি একটি অনুভব, আত্মিক বন্ধন এবং এক বিশাল আত্মত্যাগের প্রতীক। মা শুধুমাত্র একটি সন্তানের জন্মদাত্রী নন, তিনি একজন পথপ্রদর্শক, আশ্রয়দাতা এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উৎস। সন্তানের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মায়ের যে আত্মত্যাগ জড়িয়ে থাকে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই কঠিন।
মাতৃত্বের যাত্রা শুরু হয় গর্ভধারণের মধ্য দিয়ে। মা তার শরীরে একটি নতুন প্রাণ লালন করেন। এই নয় মাসে তার দৈহিক ও মানসিক জীবনে ঘটে যায় ব্যাপক পরিবর্তন। সকালবেলা বমিভাব, হরমোনের ওঠানামা, ক্লান্তি, শরীরের ব্যথা সব সহ্য করেন হাসিমুখে। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, এমনকি ঘুমও হয়ে ওঠে সন্তানের উপর নির্ভরশীল। নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করাই হয়ে ওঠে তার প্রধান লক্ষ্য।
এই সময়টুকুই দেখিয়ে দেয়, কীভাবে একজন মা নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সন্তানের জন্য জীবন সাজিয়ে নেন।
শারীরিকভাবে সবচেয়ে কষ্টদায়ক ধাপটি হলো সন্তানের জন্মদান। প্রসবযন্ত্রণার কষ্ট পৃথিবীর সবচেয়ে তীব্র ব্যথার একটি। অনেক মা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্তান প্রসব করেন। তবু কষ্টের মাঝে মা সন্তানের মুখ দেখার মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকেন।সন্তানের প্রথম কান্না শোনার পর যেন সব যন্ত্রণা ভুলে যান। এই অসীম ধৈর্য ও ত্যাগই মাকে করেন অমর।
সন্তান জন্মের পর মায়ের জন্য বিশ্রাম শব্দটি যেন বিলীন হয়ে যায়। রাত জেগে বারবার ঘুম ভেঙে সন্তানকে দুধ খাওয়ানো, কান্না থামানো, ডায়াপার বদলানো যেন নিয়মিত রুটিন হয়ে উঠে। নিজের ঘুম, খাওয়া, বিশ্রাম—সব পিছিয়ে দেন সন্তানের প্রয়োজনে। অসুস্থ হলে ছুটে যান চিকিৎসকের কাছে, দরকারে নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান।
সন্তানের একটি হাসি মায়ের কাছে পৃথিবীর সব সুখের চেয়ে বড়।
অনেক মা সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য নিজের স্বপ্ন, ক্যারিয়ার বা পছন্দ বিসর্জন দেন। কেউ চাকরি ছেড়ে দেন সন্তানের যত্ন নিতে। কেউ আবার জীবনের আরাম-আয়েশ, সামাজিকতা ছাড়েন সন্তানের ভালোর জন্য। অনেকে অর্থনৈতিক সংকটে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসও ত্যাগ করেন যাতে সন্তানের পড়াশোনা বা খাবারে ব্যাঘাত না ঘটে। এই আত্মত্যাগ অনেক সময় নীরবে ঘটে। যা চোখে পড়ে না। কিন্তু তার প্রভাব থাকে সন্তানের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে।
শুধু দৈহিক শ্রম নয়, মা মানসিকভাবে সন্তানের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। দুঃখে, ভয়ে বা হতাশায় মা-ই সবচেয়ে আগে বুঝতে পারেন সন্তানের কষ্ট। নিজের মনের যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখে সন্তানের মুখে হাসি ফোটান। সন্তান ব্যর্থ হলে তাকে দোষারোপ না করে বারবার উৎসাহ দেন। মায়ের ভালোবাসা কখনো শর্তসাপেক্ষ নয়—তা নি:স্বার্থ, নির্ভেজাল ও নিঃশর্ত।
সন্তান বড় হয়ে গেলেও মায়ের দায়িত্ব যেন শেষ হয় না। সন্তান যখন নিজস্ব পরিবার নিয়ে ব্যস্ত, মা তখনও তার জন্য প্রার্থনা করেন। দুঃখে-কষ্টে সন্তানের খোঁজ নিতে কখনো পিছপা হন না। নিজের বার্ধক্যের কষ্ট লুকিয়ে রাখেন, যেন সন্তান উদ্বিগ্ন না হয়।
এমনকি কেউ কেউ বৃদ্ধাশ্রমে থেকেও সন্তানের খোঁজখবর নেন, কারণ মা কখনো অভিমানী হলেও কখনোই প্রতিশোধ পরায়ণ হন না।
মায়ের আত্মত্যাগ কেবল জীবনের একটি পর্যায়ে নয়, বরং তা হয় পূর্ণাঙ্গ জীবনের প্রতিচ্ছবি। নিজের সব শক্তি, সময় ও ভালোবাসা নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দেন শুধু সন্তানের জন্যই।