• ঢাকা
  • শনিবার, ০৫ জুলাই, ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২, ১০ মুহররম ১৪৪৬

রক্তে লেখা ইতিহাস: কারবালা থেকে কায়রো


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ৫, ২০২৫, ০৫:৪৭ পিএম
রক্তে লেখা ইতিহাস: কারবালা থেকে কায়রো
ছবি: সংগৃহীত

ইসলামের ইতিহাসে কারবালার ঘটনা এক বেদনাবিধূর, স্মরণীয় ও দীপ্তিময় অধ্যায়। আর এই অধ্যায়ের কেন্দ্রবিন্দু হলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)। আজও তার আত্মত্যাগ মুসলিম হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে সাহস, সত্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দীপ্ত শিখা।

মিশরের রাজধানী কায়রোতে রয়েছে এক মহান স্মারক—যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন তার পবিত্র শির মোবারক। এই পবিত্র স্থানটি শুধু ধর্মীয় তাৎপর্যের জন্যই নয় বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার এক মহাকেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত।

৬১ হিজরির ১০ মহররম, ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে সংঘটিত হয় মানব ইতিহাসের অন্যতম হৃদয়বিদারক ঘটনা। ইয়াজিদের নিযুক্ত গভর্নর উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদের সেনারা ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার পরিবার ও অনুসারীদের নির্মমভাবে শহীদ করে।

নরপিশাচ শিমর ইবনে জিলজউশান নিজ হাতে ছুরি চালিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পবিত্র মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সেই শির মোবারক এবং পরিবারের নারী ও শিশুদের নিয়ে যায় কুফা ও পরে দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে।

ইয়াজিদ ইমাম হোসাইনের (রা.) শির মোবারক দামেস্কের দরজায় ঝুলিয়ে জনগণের মনে ভীতি সঞ্চার করতে চেয়েছিল। কিছুদিন পর সেই শির মোবারক রাখা হয় সালাম নামক একটি রাজকীয় গুদামে। সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শন করা হয় এবং পরে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ফিলিস্তিনের আসকালান শহরে তা দাফন করা হয়।

প্রচলিত বর্ণনা অনুযায়ী, ইয়াজিদের নির্দেশে পবিত্র শির মোবারক গোলাপজল দিয়ে ধুয়ে কাফন পরানো হয়। আসকালানের কিছু বিশ্বস্ত মুসলিম তখন তা দাফনের অনুমতি চাইলে রাজ দরবার তা মঞ্জুর করে। তারা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তা দাফন করেন।

৫৪৯ হিজরিতে ক্রুসেডারদের আগ্রাসনে যখন আসকালান শহর হুমকির মুখে পড়ে, গুজব ওঠে—তারা ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর শির মোবারক উত্তোলন করতে চায়। তখন মিশরের ফাতেমীয় খলিফা এ সংকট মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেন। উজিরের পরামর্শে সিদ্ধান্ত হয়—পবিত্র শির মোবারককে নিরাপদ আশ্রয়ে, মিশরে স্থানান্তর করা হবে।

ফাতেমী আমির কায়েদুল জুয়ুস বদরুদ্দিন, এক বিশাল কাফেলার মাধ্যমে ৮ জমাদিউল আখর ৫৪৮ হিজরিতে আসকালান থেকে শির মোবারক ১০ জমাদিউল আখর, মঙ্গলবার পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে তা কায়রোতে নিয়ে আসেন।

মিশরের আমীর সাইফ তা গ্রহণ করেন এবং লাখো মানুষ পথে দাঁড়িয়ে, জুতা খুলে, ফুল হাতে ইমামের শির মোবারককে স্বাগত জানায়। সেদিন কায়রোর আকাশ-বাতাস আবেগে, ভালোবাসায় ও ভক্তিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে।

ইতিহাসবিদ মাকিরজির বর্ণনায় জানা যায়, সোনারূপা খচিত যে সবুজ সিঁন্দুকে শির মোবারক রাখা হয়েছিল—সেটি আজও কায়রোর ইসলামিক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

৫৪৮ হিজরির ১০ জমাদিউল আখর, কায়রোর পবিত্র মাটিতে শির মোবারককে পুনঃসমাহিত করা হয়। সেই স্থানেই নির্মিত হয় সাঈয়েদীনা হোসাইন মসজিদ—যেটি আজ ‘গামা ইল হোসাইন’ নামে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কাছে পরিচিত।‌

ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শির মোবারকের কায়রো সফর শুধু একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় নয়—এটি ইসলামি ঐক্য, আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার এক অনুপম নিদর্শন। আজও এই রওজা শরীফ লাখো মানুষের হৃদয়ে সাহস জাগায়, চোখে আনে অশ্রু, আর স্মরণ করিয়ে দেয়—সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করাই হল প্রকৃত ইমান।

এই ইতিহাস শুধু অতীত নয়, বরং আমাদের চেতনায় জাগ্রত এক দীপ্ত অগ্নিশিখা—যা জ্বলবে যতদিন ইসলাম থাকবে, যতদিন হৃদয়ে থাকবে হোসাইন (রা.)-এর নাম।

Link copied!