• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬
তালেবান শাসনের দুই বছর

আফগান নারীদের ধীরে ধীরে ‘মুছে ফেলা’ হচ্ছে


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৩, ০৪:১৩ পিএম
আফগান নারীদের ধীরে ধীরে ‘মুছে ফেলা’ হচ্ছে

আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের দুই বছর পূর্তি হচ্ছে মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট)। প্রায় ২০ বছর লড়াই করে তালেবান দেশটির দখল নেয়। যদিও এখনো গোষ্ঠীটি বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায় করতে পারেনি।

তালেবান মঙ্গলবার দেশটিতে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করে। তালেবানের সহকারী মুখপাত্র বিলাল কারিমি সিএনএনকে জানান, এই দিনটি আফগানদের জন্য সম্মান ও মর্যাদার।

বিলাল কারিমি আরও বলেন, “আফগানিস্তান এই দিনে দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয়। আফগানরা তাদের দেশ, স্বাধীনতা, সরকার এবং ইচ্ছাশক্তি ফিরে পান।” তিনি মনে করেন সমস্যা সমাধানে বল প্রয়োগ যৌক্তিক নয়। সংলাপকে একমাত্র পথ বলে অভিহিত করেন তিনি।

তালেবান সরকার দিনটিকে উদযাপন করলেও জাহরার (২০) মতো অনেক নারী তাতে সামিল হতে পারছেন না। কারণ তালেবান সরকারের শাসন ক্রমবর্ধমানভাবে দমনমূলক এবং নিষ্ঠুর হয়ে পড়ছে।

২০২১ সালের গ্রীষ্মের কথা ভাবলে আফগান নারী জাহরার মনে হয়, সেটি ছিলো অন্য এক জীবন। স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে তার ছিলো অনেক বন্ধু। তার ভাষ্যে, “আমরা সবাই একসাথে সুখেই ছিলাম। আমরা পড়াশোনা করছিলাম, মাঝেমাঝে একসঙ্গে হতাম। আমরা সাইকেল চালাতাম একসঙ্গে।”

বার্তা সংস্থা সিএনএনকে নিরাপত্তার স্বার্থে শুধু প্রথম নাম জানানো জাহরা জানান, এখন আর আগের মতো সাইকেল চালাতে পারেন না। স্কুলে যাওয়াও বন্ধ তার। এমনকি চেহারা না ঢেকে বাইরে যাওয়া, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা, কোনো কিছুই করতে পারেন না। তার একমাত্র কাজ এখন ঘরে বসে থাকা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করা।

“যখন আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই, আমি দুই বছর আগের জাহরা থেকে ভিন্ন এক জাহরাকে দেখতে পাই। অতীতের কথা ভেবে কষ্ট পাই।”—বলেন জাহরা।

২০২১ সালে ক্ষমতায় এসে তালেবান ৯০-এর তালেবানের তুলনায় নিজেদের আধুনিক রূপে উপস্থাপন করে। তারা এমনকি নারীদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা নারীদের মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ করে দেয়। নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, জাতিসংঘসহ সকল এনজিওতে কাজ করা এবং জনপরিসর যেমন জিম, পার্কে যাওয়া নিষিদ্ধ করে। এমনকি নারীদের ভ্রমণ করতে পুরুষ সঙ্গী লাগবে বলে ঘোষণা দেয় তালেবান সরকার।

আফগান নারীরা এখন দেশটিতে অধিকাংশ সেক্টরে কাজ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত। সর্বশেষ গত মাসে দেশের সব বিউটি পার্লার বন্ধ ঘোষণা করে তালেবান। এ সেক্টরে প্রায় ৬০ হাজার নারী কাজ করতো। যার মধ্যে অনেকেই ছিলো পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। যার ফলে এই পরিবারগুলোর দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পাবে।

বিভিন্ন সংস্থা সতর্ক করে বলেছে বিশ্বের দৃষ্টি আফগানিস্তান থেকে সরে যাওয়াতে এই অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে। একইসঙ্গে ক্রমহ্রাসমান বিদেশি সহায়তার ফলে আফগানদের খরা, দুর্ভিক্ষ ও রোগ-বালাইয়ের সঙ্গে লড়াই করার সক্ষমতা কমছে বলে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার বিশেষজ্ঞরা জানান।

আফগান নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা মাহবুবা সেরাজ বলেন, “নারী অধিকার বলে এখন আর কিছু আফগানিস্তানে নেই।” 
২০২৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে মনোনয়ন পাওয়া মাহবুবা সেরাজ আরও বলেন, “আফগানিস্তানের নারীদের মতামত, কণ্ঠ, চিন্তাভাবনা ধীরে ধীরে সমাজ থেকে, জীবন থেকে, সব কিছু থেকেই মুছে ফেলা হচ্ছে।”

জাহরার মতো নারীরা যাদের এখন নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার কথা, তারা এখন কিছুই করতে পারছে না। জাহরা ছবি আঁকতে পছন্দ করেন। তার ইচ্ছে ডিজাইনার হওয়া এবং নিজের ব্যবসা দাঁড় করানো। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

জাহরা বলেন, “আমি ২০ বছর বয়সী। আমার এখন পড়াশোনা করার সময়। কিন্তু আমি তা পারছি না। আমি বাসায় বসে নিজের, আমার বোনের এবং আফগান সকল নারীর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি।”

আর আফগান নারীদের এই বন্দী দশার ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব পড়ছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির প্রায় ৮ শতাংশ মানুষ জানান, তারা এমন নারীদের কথা জানে যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

যদিও তালেবান দাবি করে যাচ্ছে ‘ইসলামী মূল্যবোধ’ মেনে নারীরা নির্দিষ্ট সেক্টরে কাজ করতে পারবে। জাবিউল্লাহ মুজাহিদ নামের তালেবান মুখপাত্র দাবি করেন নারীরা সক্রিয়ভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ, পাসপোর্ট অফিস, বিমানবন্দরসহ অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করছেন।

কিন্তু, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞরা জানান তালেবান সরকারের দাবি সত্য থেকে অনেক দূরে। আর স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট।

তালেবান সরকার নিয়ম করেছে নারীরা শুধুমাত্র নারী চিকিৎসকের সেবা নিতে পারবেন। কিন্তু নারীদের উচ্চশিক্ষা নেওয়া নিষিদ্ধ করার ফলে নারী চিকিৎসকের ঘাটতি তৈরি করছে। ফলে নারীদের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নারীদের প্রতি তালেবানের দমনমূলক পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা নারী অধিকারকে সম্মান জানাতে আহবান জানায়। কিন্তু এইসব বার্তা তেমন কোনো কাজে আসছে না। আর বিশ্বের মনোযোগ দেশটি থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। যার ফলে আফগানরা ক্ষুব্ধ হচ্ছে।

জাহরার মতো আফগানরা ভাবছেন কেন বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখছে। জাহরা বলেন, “তারা আরামে আছে, তাদের মেয়েরা, বোনেরা স্কুলে যাচ্ছে। কিন্তু, এখানে নারীরা অবহেলিত হচ্ছে, তারা কিছুই করতে পারছে না।”

তবে মাহবুবা সেরাজের মতো কিছু মানুষ আফগানিস্তানে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছে, কথা বলছে। তিনি জানান তিনি এখনো আশা হারাননি।

যদিও তালেবান সরকারের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নারীদের অধিকার আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আর এর ফলে আফগান নারীদের সামনে শুধুমাত্র দেশ থেকে পালানো একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাহরা বলেন, “অবশ্যই সবাই তার দেশেই থাকতে চায়। কিন্তু এখানে থাকার আর কোনো উপায় নেই। আমাকে আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবতে হবে। আর তার জন্য দেশ ছেড়ে যাওয়া হলো সবচেয়ে ভালো উপায়।”          
 

Link copied!