• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

পানির সংকটে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য


বান্দরবান প্রতিনিধি
প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২২, ০৮:৪৫ এএম
পানির সংকটে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
বান্দরবানের অধিকাংশ এলাকার ঝিরি-ঝরনা প্রায় পানিশূন্য। ছবি : সংবাদ প্রকাশ

পার্বত্য জেলা বান্দরবানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ঝিরি-ঝরনা থেকে পাথর উত্তোলন ও নির্বিচারে বন উজাড়ের কারণে পানিপ্রবাহের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।

কয়েক বছর ধরে বান্দরবানে শুষ্ক মৌসুম এলে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। একসময় সারা বছর পানি থাকত পাহাড়ি ঝিরি-ঝরনায়। কিন্তু বর্তমানে শুকিয়ে যাচ্ছে প্রায় সব কটি। ফলে পানির অভাবে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় বিশেষ করে দুর্গম এলাকার পাহাড়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীদের।

আদিকাল থেকে বছরের পর বছর ধরে পানি সংগ্রহের একমাত্র ভরসা ছিল এসব ঝিরি-ঝরনা ও ছড়া। এভাবে যদি চলতে থাকলে অচিরে ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে গিয়ে তীব্র পানি সংকট দেখা দেবে এই জনপদে।

দেখা গেছে, বান্দরবান অধিকাংশ এলাকা পানিশূন্য প্রায় সব ঝিরি-ঝরনা। তীব্র পানি সংকটে দিন কাটাতে হচ্ছে ঝিরি-ঝরনার আশপাশে বসবাস করা জনগোষ্ঠীর। এদিকে নিরুপায় হয়ে ঝিরি ও খাল কিনারে ছোট ছোট কূপের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করে সংকট নিবারণের চেষ্টা করছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বান্দরবান জেলা সদর হতে ৮৫ কিলোমিটার দূরত্বে থানচি উপজেলা সীমান্তবর্তী লিক্রি সড়কে পাবলা ঝিড়ি, মরা ঝিড়ি ও লাইন ঝিড়ি বিভিন্ন নামক স্থান থেকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা পাথর উত্তোলন করে মজুত করে রাখে। সাম্প্রতিক সময়ে শীলা ঝিড়ি নামক স্থান থেকে পাথর উত্তোলন মজুত করে রাখা ও পাথর ভাঙার মেশিন জব্দ করেছে প্রশাসন। এ সময় শ্রমিকরা টের পেয়ে পালিয়ে গেলে কাউকে আটক করতে পারেনি প্রশাসন। পরে জনপ্রতিনিধির জিম্মায় মজুত করা পাথরগুলো রাখা হয়।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে একটি সিন্ডিকেট চক্র আশপাশের ঝিরি-ঝরনা থেকে পাথর উত্তোলন করছে। এর কারণে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, পানিকে ধরে রাখে পাথর আর পাথরের ভেতরে বসবাস করে পোকামাকড়ের সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা পাহাড়িরা শামুক, ঝিনুক ও বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ঝিড়ি-ঝরনা থেকে সংগ্রহ করে খেয়ে থাকি। এসব ঝিরি-ঝরনা থেকে প্রায় কয়েক বছর ধরে নির্বিচারে পাথর উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে এসব জীববৈচিত্র্য। এতে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য।

এদিকে জেলা সদর হতে ৪৩ কিলোমিটার দূরত্বে রুমা উপজেলার পাহাড়ি বনাঞ্চলের শতাব্দীর প্রাচীন বহু গাছগুলো সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চল রিজার্ভ থেকে অবৈধভাবে কাটা হচ্ছে, যা সাঙ্গু নদী পথে পরিবহন করা হয়। রেঞ্জের যোগসাজশে একটি সিন্ডিকেট গত কয়েক বছর ধরে এই পাহাড়ি অঞ্চল দখল করে নিমেষেই বন থেকে গাছ কাটছে। ফলে বনগুলোর অনেক জায়গা খালি এবং অনুর্বর হয়ে গেছে। এতে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্যে, আর বিলুপ্তির পথে বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, উভচর এবং বিরল প্রজাতির পাখি।

বেথেনি পাড়া এলাকার জুয়েল বম বলেন, “এই এলাকায় কয়েক শ পরিবারের বসবাস। প্রতিনিয়ত কিছূ অর্থ লোভনীয় ব্যক্তি পাহাড়কে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃতিকে আঘাতের পাশাপাশি পাহাড়ে জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই প্রকৃতির রূপ অস্তিত্ব বলতে কিছুই আর থাকবে না।”

এ সময় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় নলকূপ বা ডিপ টিউবওয়েল বসানোর সুযোগ নেই। পানির জন্য ঝিরিই একমাত্র ভরসা। এখানে বসবাসরত বেশির ভাগ জনগণ নিম্ন আয়ের হওয়ায় আমিষের জন্য ঝিরি ও প্রোটিনের জন্য পাহাড়ের বন্য প্রাণীই তাদের একমাত্র ভরসা।”

এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন বান্দরবান চ্যাপ্টারের সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, “সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝিরি-ঝরনা ও নদ-নদী পানিশূন্য হওয়ার কারণ মনে করলেও মানুষসৃষ্ট সমস্যাগুলো এর অন্যতম কারণ। পাথরকে পাহাড়ের প্রাণ হিসেবে বিবেচনা করা হলে, গাছকে সঞ্চালনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। প্রচলিত আছে ভূগর্ভস্থ পানির স্থর থেকে সর্বনিম্ন ১০০ ফুট গভীর পর্যন্ত পানি শোষণের ক্ষমতা রাখে পাথর। গাছের মূল সেই পানিকে নিজে শোষণের পাশাপাশি মাটির বিভিন্ন স্তরে সঞ্চার করে। প্রাণ (পাথর)-সঞ্চালন (গাছ) না থাকলে নির্জীব মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।”

এছাড়া উন্নয়নের নামে অবাধে পাথর উত্তোলন, জোত পারমিটের নামে বৃক্ষনিধন ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।

বান্দরবান বন বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. মাহাবুব মোরশেদ বলেন, “থানচি রির্জাভে জব্দকৃত গাছগুলো লিজের মাধ্যমে নৌপথে থানচি রেঞ্জ হয়ে রুমায় আসছে। তাছাড়া অনেক কিছু আমার রেঞ্জের আওতার বাইরে।”

এছাড়া কতটুকু আপনার রেঞ্জের আওতায় পারমিট আছে, কোনো কোনো গাছ কাটা নিষিদ্ধ বিশেষ করে বনায়ন হতেই চাপালিশ, গর্জনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছগুলো কীভাবে আসছে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

এ বিষয়ে সবকিছু বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলেও রুমা সদরের পলি রেঞ্জের বন বিভাগের কর্মকর্তা বশিরকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তাকে পাওয়া য়ায়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বান্দরবান পরিবেশ অধিদপ্তর সহকারী পরিচালক মো. ফখর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “আমি কয়েক দিন হলো কর্মস্থলে যোগদান করেছি।”

যদি কোনো অবৈধ কাজ হয়, তাহলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

Link copied!