• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,
কাতার বিশ্বকাপ

সময়ের ব্যবধান বাড়লেও মেসিই ফিনিক্স পাখি


সৌরভ কুমার দাস
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২২, ০৪:২৫ এএম
সময়ের ব্যবধান বাড়লেও মেসিই ফিনিক্স পাখি
ছবিঃ গেটি ইমেজস

২০১৮ বিশ্বকাপের বাছাইয়ের কথা মনে আছে? খোদ আর্জেন্টাইন ভক্ত না হলেও মনে থাকার কথা! বাছাইপর্বে এতটা জঘন্য পারফর্মেন্স ছিল আর্জেন্টিনার, বিশ্বকাপ খেলাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল!

এমনকি সমীকরণ এমন দাঁড়িয়েছিল, একেবারে শেষ ম্যাচে ইকুয়েডরের বিপক্ষে জয় না পেলে আর্জেন্টিনাকে ছাড়াই বিশ্বকাপ মাঠে গড়াবে! চারিদিকে সে কী উৎকণ্ঠা! চরম মেসি ও আর্জেন্টিনা নিন্দুকও বোধহয় সেদিন জয় চেয়েছিলেন আর্জেন্টিনার!

তবে ওই সময়ের পারফর্মেন্স বিবেচনায় আর্জেন্টিনাকে ছাড়াই হয়তো বিশ্বকাপ দেখার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলেন অনেকে! ইকুয়েডরের বিপক্ষে সেদিনকার ম্যাচটা ছিল বাংলাদেশ সময় ভোরে!

অনেকেই অযথা ঘুম নষ্ট করে আর্জেন্টিনার সেই সময়ের বিশ্রী খেলা দেখতে চাননি! কিন্তু যারা ওই সময়েও বিশ্বাস রেখেছিলেন তাদের হতাশ করেনি আর্জেন্টিনা! না আর্জেন্টিনা না বলে লিওনেল মেসি নামক যাদুকরের নামটা উচ্চারণ করলেই বোধহয় যুতসই হয়!

এই ফুটবল যাদুকরের অবিশ্বাস্য হ্যাটট্রিকে জয় নিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছিল আর্জেন্টিনা। হটাত কেন প্রায় পাঁচ বছর আগের কাহিনী নিয়ে পড়লাম? আমার ধারণা, নিশ্চিতভাবেই বুঝে গেছেন! আসলে পাঁচ বছর আগের গল্প করতে আমাকে বাধ্য করেছেন পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির এক আর্জেন্টাইন ভদ্রলোক, যাকে আপনার ভালোবেসে খুদে যাদুকর বলে ডেকে থাকেন।

পাঁচ বছর পর আবারও একই সমীকরণের সামনে আর্জেন্টিনা। নাহ, ঠিক একই নয় আবার একই! রহস্য হয়ে যাচ্ছে বেশি? আচ্ছা তাইলে সোজাসাপ্টাই বলি! ২০১৮ সালে  আর্জেন্টিনার সমীকরণ ছিল জিতলে বিশ্বকাপ খেলতে পারবে!

আর এবার হট ফেভারিট হয়ে বিশ্বকাপে এসেও প্রথম ম্যাচ হারার পর দ্বিতীয় ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে জয় প্রয়োজন ছিল আসরে টিকে থাকতে! এই ম্যাচে যদি জয় বাদে অন্য কোনো ফল আসতো তবে এতক্ষণে হয়তো খেলোয়াড়দের অবকাশ যাপনের জায়গা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়ে যেত!

মেক্সিকোর বিপক্ষে বাঁচা মরার লড়াইয়ে প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনা আজ যা খেলেছে তাতে করে স্বয়ং আলবেসেলিস্তা সমর্থকরাও হা-হুতাশ করছিলেন! কোনো আর্জেন্টাইনকে দেখলে মনেই হচ্ছিল না এটা তাদের জন্য বাঁচা মরার লড়াই!

পুরো দলটাকেই যেন নার্ভাস দেখাচ্ছিল! তবে লিওনেল মেসির যাদুকরী এক গোলেই যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো পুরো আর্জেন্টিনা!। ম্যাচের তখন বয়স ৬৫ মিনিট! রীতিমতো উতকণ্ঠা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা শুরু করেছেন!

সেই সময়ে আরও একবার ত্রাতা হয়ে হাজির মেসি নামক ভদ্রলোক! যাকে হয়তো স্বর্গ থেকেই আশীর্বাদ করছিলেন বছর দুই আগে স্বর্গলোকের বাসিন্দা হওয়া দিয়েগো ম্যারাডোনা।

বাঁ পাশ থেকে নেহাতই একটি নিরীহ পাস দিয়েছিলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া! তবে গবরে পদ্ম ফুল ফোটাতে পারেন বলেই যেন মেসিকে বলা হয় আর্জেন্টিনার বিপদের কাণ্ডারী!

মারিয়ার ওই বলটাকে জাস্ট থামালেন! এরপর মুহূর্তের মধ্যে যাদুকরী অমূল্য সেই বা  পা থেকে সেই বাকানো শট! যে শটে প্রতিহত হলেন ওচোয়া নামের ঝাটকা চুলওয়ালা মেক্রিকান গোলরক্ষক! যে ভদ্রলোক বিশ্বকাপের আসর হলেই মেক্সিকোর গোলপোস্টে নিজেকে চীনের মহা প্রাচীর বানিয়ে ফেলেন!

সাথে সাথে ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে ভেসে আসলো, ‘ইটস ফ্রম দ্যা ম্যাজিক ম্যান! আসলেই হতো যাকে বাংলায় যাদুকর বলেন তাকেই তো ইংলিশে ম্যাজিক ম্যান বলা যায়! আর এটা তো ম্যাজিকাল মানে যাদুকরী মুহুর্তই!

মহাকাঙ্খিত গোলটা করে দুই হাত মেলে যেভাবে হাসি মুখে ছুটলেন তাতে হয়তো সহস্রকাল প্রেমিকার অপেক্ষায় থাকা প্রেমিকও তৃপ্তি নিয়ে হেসে উঠলেন! প্রেমিকার কথা ভুলে বিষ্ময়ভরা চোখে চেয়ে রইলেন রোজারিওতে জন্ম নেওয়া এই ফুটবল যাদুকরের দিকে!

খালি চোখে মেসির এই গোলটাকে যদি আপনি শুধু গোল হিসেবে দেখেন তাহলে বলতে হবে আপনার ফুটবল দেখাই বৃথা! শুধু ফুটবল দেখবেন সেটা হবে না, এর ভিতরে যেতে হবে! প্রতিটি পাস, গোল বাঁ অ্যাসিস্টের মাহাত্ম্য খুঁজে বের করতে হবে!

আজকের ম্যাচ দেখছেন নিশ্চয়ই! মেসির গোলের আগের আর্জেন্টিনা আর পরের আর্জেন্টিনার পার্থক্য তো খালি চোখেই ধরা পরার কথা!

মেসির গোলের পরই যেন আর্জেন্টিনার দলের প্রত্যেকে বুঝতে পারলেন, ওহহো! আজ তো আমাদের বাঁচা মরার লড়াই! প্রথম দিকে টানা ডিফেন্স করা মেক্সিকো গোল হজম করে রীতিমতো আক্রমণের পসরা সাজিয়ে বসলো!

কিন্তু মেসির গোলের পর আর্জেন্টিনা যেভাবে জেগে উঠেছে তাতে তাদের থামায় কে! নিজেদের রক্ষণে মানব দেয়াল বানিয়ে ফেললেন আর্জেন্টাইন ফুটবলাররা! আর এতে একের পর এক আক্রমণ করলেও কাজ হলো না মেক্সিকোর!

উল্টো ম্যাচের ৮৭তম মিনিটে এই বিশ্বকাপের সম্ভাব্য সেরা গোলটি করলেন আর্জেন্টাইন ফুটবলার এঞ্জো ফার্নান্দেজ! এখানেও সেই মেসিই ত্রাতা! ফার্নান্দেজকে গোলের বলটাই তো যুগিয়েছেন লিওনেল মেসিই!

আসলে এই আর্জেন্টিনা দলের হৃপিন্ড বলেন আর পাকস্থলী! সবখানেই যে মেসির বিচরণ! এ কারণেই হয়ত ফিনিক্স পাখির মতো আর্জেন্টিনাকে বারবারই খাঁদের কিনারা থেকে তুলে ওঠান তিনি।

বলা হয়, শুধুমাত্র ফিনিক্স পাখিই কেবল ছাইভস্মের ধ্বংসস্তুপ থেকে বের হয়ে আসতে পারে! তবে কি মেসি সেই ফিনিক্স পাখির মনুষ্য রুপ! কারণ, তিনিই তো আর্জেন্টিনাকে বারবার ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠিয়ে আনেন! বিপদে পড়লে আর্জেন্টাইনরা হয়তো মেসির নামটাই সবচেয়ে বেশিবার মুখে আনে!

লোকে বলে ঈশ্বর নাকি ভক্তের প্রার্থনা শুনতে পান, মনমতো হলে পূরণও করেন। এই ম্যাচের আগে ঈশ্বর হয়তো দেখেছেন পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির ওই লোকটা এভাবে শেষ বিশ্বকাপে ফিরে যান এটা আজীবন সমালোচনা করে নিন্দুকরাও চাননি! হয়তো ঈশ্বরও চাইছেন না! তাহলে? তাহলে আর কি, দেখা যাক… কি হয়।

Link copied!