• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্যবিধি মানুন, মানতে বাধ্য করুন


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৫, ২০২২, ০৮:১৬ পিএম
স্বাস্থ্যবিধি মানুন, মানতে বাধ্য করুন

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ফের বাড়তে শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ষাট শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ পরিচালক অধ্যাপক রোবেদ আমিন এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, গত ২০ ডিসেম্বর থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে এবং ২৭ ডিসেম্বর থেকে সংক্রমণের হার দুই শতাংশ পার হয়ে যায়। এর আগে অনেকদিন এ হার দুইয়ের নিচে, এমনকি এক শতাংশের নিচেও ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, নভেম্বরে দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৭৪৫, আর ডিসেম্বরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ২৫৫। শনাক্তের সংখ্যা ডিসেম্বরের শেষ অর্ধ থেকে বাড়তে থাকে। সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর বলছে, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলার ফল এই বাড়তি সংক্রমণ। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আবারও সংক্রমণ বাড়াচ্ছে। দেশে যখন ডেল্টা ধরনের প্রভাবে এই সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে তখন বিশ্বব্যাপী শঙ্কা বাড়াচ্ছে করোনার ওমিক্রন ধরন। এর প্রভাবে পর্যুদস্ত পুরো ইউরোপ। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও বাড়ছে ওমিক্রনের সংক্রমণ। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে, এবং ইতোমধ্যেই বেশ কজনের দেহে করোনার ওমিক্রনের ধরন শনাক্ত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ডেল্টার মতো বহুল সংক্রমণ হলে এর বড়সড় প্রভাব যে বাংলাদেশের ওপরও পড়তে যাচ্ছে, সে আশঙ্কা করছে জনস্বাস্থ্যবিদরা।

ওমিক্রনের কারণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে ইতোমধ্যেই নানা বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হার অর্ধেক করা হয়েছে। করোনা মোকাবেলায় ভারত যখন এমন সিদ্ধান্তে গেল, তখন বাংলাদেশের কী হবে এমন আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে আপাত মনে হচ্ছে এখনই এত কঠোর বিধিনিষেধে মধ্যে যাচ্ছে না বাংলাদেশ। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সংক্রমণ রোধে গত ৩ জানুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে সরকার। বৈঠক শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন ওমিক্রন রোধে কিছু সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে যেমন আছে টিকার সনদ ছাড়া রেস্টুরেন্টে খেতে না পারার কথা, তেমনি আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনই বন্ধ না করার সিদ্ধান্তের কথাটাও। মন্ত্রী বলছেন, শিক্ষার্থীরা করোনার টিকা যেন গ্রহণ করে সে কথাটা। সরকারের পক্ষ থেকে এজন্যে সর্বোচ্চ সহযোগিতার কথাও জানিয়েছেন মন্ত্রী। সবশেষ কথা মাস্ক পরা, এটার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে। কেবল স্বাস্থ্যমন্ত্রীই নন, শিক্ষামন্ত্রীও বলছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু রাখার কথা।

করোনার ওমিক্রন ধরন বাংলাদেশেও আঘাত হানতে পারে। এর মোকাবেলায় সরকারের এই প্রস্তুতিসভা। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আশঙ্কা মার্চ-এপ্রিলে আসতে পারে ওমিক্রনের হানা। আগেও এই মাসগুলোতে সংক্রমণ তুলনামূলক বেশি ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে সিদ্ধান্ত ওই সময়ের পরিস্থিতির ভিত্তিতে হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তবে আমরা চাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের মতো ওই পর্যায়ে যেন না যায় দেশ! কারণ এই করোনার কারণে ইতোমধ্যেই দেশে শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত। ক্লাস নেই, পরীক্ষা নেই, শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগও নেই। ফল শিক্ষায় অনাগ্রহ ও মেধার যথাযথ মূল্যায়ন নেই। এমন অবস্থা দীর্ঘমেয়াদী হতে থাকলে এই প্রজন্মের শিক্ষার্থী এবং দেশেরও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত!

করোনাকালে উত্তীর্ণদের নিজেদের কাছেই প্রাপ্ত সার্টিফিকেটের মূল্য কেমন, তা নিজেরা উপলব্ধি করছে। এটা উল্লেখের মতো শিক্ষার্থীর কাছে যে কাগুজে বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জেনেছি। যদিও জানি এবং তারাও জানে এটা তাদের ভুল নয়, পরিস্থিতির শিকার তারাও। তবে এই পরিস্থিতিজনিত ব্যাখ্যা কতজনেরই বা সান্ত্বনার উপলক্ষ নয়?

২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত এবং মৃত্যুহার বাড়লেও আগস্ট থেকে গণটিকা কার্যক্রম শুরুর পর তা কমতে শুরু করে। এভাবে কমতে কমতে সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে এই সংক্রমণের হার এক শতাংশের ঘরে ছিল। এখন এটা দুই বা তার কাছাকাছি রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী এবং আমাদের পাশের দেশ ভারতে ওমিক্রনের প্রভাবের কারণে এখন আমরা রীতিমতো উদ্বেগের মধ্যে। করোনার চোখ রাঙানি যখন একদিকে তখন আমাদের দেশে স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই, কেউ মাস্ক পর্যন্ত পরতেও আগ্রহী না, সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছে, দেশব্যাপী স্থানীয় সরকার নির্বাচনও হচ্ছে। এমন অবস্থায় ওমিক্রন খুব কম মানুষকেই ভাবাচ্ছে। সরকার বলছে তারা ভাবছে, তবে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করার মতো কোনো উদ্যোগ নাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি আছে দেশে, তবে তা কাগজে-কলমে। এখন না হয় সংক্রমণের হার দুই শতাংশ বা তার কিছুটা নিচে, কিন্তু করোনার ঊর্ধ্বগতি যখন ছিল তখনও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করার মতো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মাঝেমাঝে প্রেস রিলিজ দেওয়ার মতো অথবা সংবাদের উপাদান হওয়ার বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগ সারাদেশে ছিল, ছবি তোলা আর প্রেস রিলিজ দেওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যাওয়ার যেন দায়িত্ব শেষ! এভাবে কি সতর্কতা আর করোনা মোকাবেলা সম্ভব?

করোনার সংক্রমণ রোধে সরকার স্বাস্থ্যবিধি দিয়েছে, সময়ে-সময়ে নানা বিধিনিষেধ দিয়েছে, টিকা এনেছে, টিকাদান কার্যক্রম চলছে। তবে এই স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধ অমান্য করে যারা তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি, বা নেয়নি। অথচ এটাও জরুরি ছিল।

দেশে করোনার যখন চোখ রাঙানি, এদিকে আমাদের ভাবনায় শিক্ষাব্যবস্থা। করোনার সংক্রমণ ফের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে কী হবে আমাদের শিক্ষার্থীদের? নতুন বছরে শিক্ষার্থীরা নতুন বই পেয়েছে। তারা উচ্ছ্বসিত। তাদের এই উচ্ছ্বাস অভিভাবকদেরও ছুঁয়েছে। করোনার হানা যদি ফের রুদ্ধ করে দেয় শিক্ষার দ্বার, এ আনন্দ কি থাকবে কারও? থাকবে না! তাই সময় থাকতে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কঠোর হোন। সুস্থ-সুখী থাকতে স্বাস্থ্যবিধি মানুন, প্রয়োজনে মানাতে বাধ্য করুন!

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

Link copied!