বাংলাদেশ বিশ্বে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, আয়বৈষম্যের থেকেও একটি গভীরতর এবং সুদূরপ্রসারী সমস্যা বিদ্যমান: সম্পদবৈষম্য। এর অর্থ হলো, দেশের জনসংখ্যার একটি অতি নগণ্য অংশ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকানা ধারণ করে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সামান্য সম্পদের অধিকারী। এই অসমতা কেবল অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যই হুমকি নয়; বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথেও এক বড় অন্তরায়। বৈষম্য পরিমাপের বহুল প্রচলিত পদ্ধতি জিনি সহগ আমাদের দেশের অর্থনীতির এক হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৭১টি দেশের মধ্যে কেবল কয়েকটি দেশে আয়বৈষম্যের এই মাত্রা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে সম্পদবৈষম্যের চিত্র আরও ভয়াবহ। একই সময়ে সম্পদবৈষম্য শূন্য দশমিক ৮২ থেকে বেড়ে শূন্য দশমিক ৮৪-এ পৌঁছেছে। এই পরিসংখ্যানগুলো খানা আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়েছে। সম্পদের এই অসম বণ্টন এতটাই প্রকট যে শীর্ষ ১০ শতাংশ আয় উপার্জনকারী পরিবারও যে পরিমাণ সম্পদের হিসাব দিয়েছে, তা সাধারণ মানুষের সম্পদ ধারণার কল্পনারও বাইরে। বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং-২০১৮ অনুযায়ী, অতি ধনী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। সেই বছর এই বৃদ্ধির হার ছিল ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে কতজন অতি ধনী ব্যক্তি (যাদের ন্যূনতম সম্পদের পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন টাকা) বাংলাদেশে বসবাস করেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সম্পদের জিনি সহগ দেশে সম্পদের অত্যন্ত অসম বণ্টনের কথাই সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে। এই বৈষম্যের একটি বড় কারণ হলো আন্তপ্রজন্মগত উত্তরাধিকার। উচ্চ আয়ের পরিবারগুলো বংশপরম্পরায় সম্পদ অর্জন করে এবং তা তাদের সন্তানদের কাছে হস্তান্তরিত করে, যা সমাজে সম্পদের একটি স্থায়ী অসমতা তৈরি করে। এই একই প্রবণতা শিক্ষা এবং মানব পুঁজির ক্ষেত্রেও দেখা যায়, যেখানে সুবিধাগুলো মূলত নির্দিষ্ট কিছু পরিবারের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত থাকে।
আয় ও সম্পদবৈষম্য সৃষ্টি করে জাতীয় বাজেট কীভাবে ভূমিকা রেখেছে বা রাখছে, তা পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমেই বাজেট কাঠামোয় দৃষ্টি দিতে হবে, যেখানে দেখা যায় যে স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে (১৯৭২-১৯৭৫) গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগভিত্তিক অর্থনীতির পথে হাঁটলেও মনুষ্য ও প্রকৃতিসৃষ্ট বাধার কারণে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসন আমলে (১৯৭৫-১৯৯০) বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার প্রয়াসে সংস্কার আনা হলেও তহবিল সংকুলানের জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ সরকার দিতে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৭-৭৮ সালে সামরিক সরকারের দ্বিতীয় বাজেটে কোনো ধরনের বৈধকরণ ছাড়াই কালোটাকা লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে কেবল উন্নয়ন নয়, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় বাজেটের ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়ে। ১৯৯১ সালে জোট সরকার দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে মৌলিক বাজেট সংস্কারের সূচনা করে প্রথমবারের মতো মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) চালু করে, যা একটি আধুনিক করব্যবস্থা গড়ে তোলার ইঙ্গিত দিলেও বাজেট সুবিধাসমূহ ধনী ও স্বজনদের দিকে ধাবিত হয়। একই সময়ে আমদানিমূলক শুল্ক হ্রাস ও বাজার উন্মুক্ত করার নীতি গ্রহণ করা হলেও, সমাজসেবা খাতে বরাদ্দ সেই অনুপাতে বাড়েনি। রাজস্ব গঠন ও বৃহৎ প্রকল্পকেন্দ্রিক পরিকল্পনায় অধিক মনোযোগ দেওয়ায় ক্ষুদ্র কৃষক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের স্বার্থ রক্ষা কম গুরুত্ব পায়। ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে প্রবীণ ভাতা, বিধবা ও অনাথ ভাতা ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা হলেও, সেই সময়েও ধনী শ্রেণির জন্য বিশেষ সুবিধা, যেমন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ এবং কালোটাকার বৈধকরণের কৌশল এবং ধনিক শ্রেণি ও অঞ্চলমুখী উন্নয়ন প্রকল্প-অবকাঠামো জোর পায়। জোট সরকার রাজস্ব সংগ্রহ জোরদারের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে ধনীদের খুশি করার করনীতি নানা ছাড়-নিস্তারের জালে আবদ্ধ ছিল, যা ২০০৯ সালের পর দীর্ঘ এককদলীয় শাসনামলে সংসদে দাঁড়িয়েই ‘ব্যবসায়ীদের জন্য বাজেট ও আর্থিক নীতিপ্রণয়ন’ হয়েছে বলে বারবার ঘোষণা দেওয়া হয়। জ্বালানি-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় এবং বাজেটের বড় বড় অংশ ঋণ করে সেতু-ফ্লাইওভার ইত্যাদির ব্যয় হয় এবং কর-রাজস্বের অর্জিত আয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রতিরক্ষা-আইনশৃঙ্খলা এবং বড় ব্যবসায়ীদের ছাড় ও প্রণোদনায় ব্যয় হয়। ফলে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-আবাসনের মতো মৌলিক অধিকার-চাহিদা পূরণ ক্রমাগত সংকুচিত হয় এবং সামাজিক খাতের বরাদ্দ প্রয়োজন ও তুল্যবিচারে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি দূরের কথা প্রাপ্ত বরাদ্দও নানা ছলে-কৌশলে আর্থিকভাবে সক্ষমদের দিকে ধাবিত করা হয়। এমনকি ২০১০-এর দশকভর একাধিক বাজেটে ১০ শতাংশ হারে সরকারি তহবিলে অর্থ জমা না দিয়েই ঘুষ-দুর্নীতি-অপকর্মে অর্জিত কালোটাকা জমি, স্টক ও ব্যাংকে বিনিয়োগের সুযোগ বৈধ করা হয়। অর্থাৎ ধনী শ্রেণির সম্পদের বৈধতা প্রদান করে কর ফাঁকির সুযোগ বহাল রেখে সরকারের সাম্য প্রতিষ্ঠায় অস্বীকৃতি জানায়। ফলে সামগ্রিক গড় আয় বৃদ্ধি পেলেও দেশের সবচেয়ে ধনী শ্রেণির আয়ের অংশ ক্রমেই বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায় শীর্ষ ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী দেশে মোট আয়ের ৪১ শতাংশ ভোগ করে, যেখানে নিম্ন ১০ শতাংশ পায় মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ। দীর্ঘস্থায়ী আয়বৈষম্য সম্পদবৈষম্যকে আরও কঠিন করে তোলে। যারা কম আয় করে, তাদের পক্ষে সম্পদ অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে সামাজিক গতিশীলতা সীমিত হয়ে যায় এবং দরিদ্র মানুষেরা কখনোই উল্লেখযোগ্য সম্পদের মালিক হতে পারে না। বাংলাদেশে উত্তরাধিকার করের অনুপস্থিতি এই অবস্থাকে আরও প্রকট করে তোলে, যেখানে অনেক উন্নত দেশে এই ধরনের কর সম্পদবৈষম্য কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যদিও বাংলাদেশে সম্পদের ওপর একটি নামমাত্র সারচার্জ আরোপ করা হয়, তবে এর কার্যকারিতা খুবই সীমিত।
৫৪ বছরের বার্ষিক বাজেটের এই খেরোখাতা উপস্থাপনের কারণ জাতীয় বাজেট কীভাবে আয়-সম্পদবৈষম্যের কারিগর হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধানে দেখা যায়, মানুষের সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির আলোকে বিশ্বব্যাপী মূলগতভাবে ১৪ ধরনের বৈষম্য ও ১২ ধরনের দারিদ্র্য আছে।
বৈষম্যের ধরনসমূহ হচ্ছে, আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য, শিক্ষাগত বৈষম্য, স্বাস্থ্যগত বৈষম্য, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য, প্রযুক্তিগত বৈষম্য, রাজনৈতিক বৈষম্য, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য, ভাষাগত বৈষম্য, বয়সভিত্তিক বৈষম্য, পেশাভিত্তিক বৈষম্য। আর দারিদ্র্যের ধরনে আছে পরিমাপযোগ্য দারিদ্র্য, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য, দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য, অস্থায়ী দারিদ্র্য, শ্রমজীবী দারিদ্র্য, প্রজন্মগত দারিদ্র্য, নগর দারিদ্র্য, গ্রামীণ দারিদ্র্য, নীতিনির্ভর দারিদ্র্য, পরিবেশজনিত দারিদ্র্য, সংঘাত-সন্ত্রাসপ্রবণ অঞ্চলের দারিদ্র্য, জলবায়ুজনিত দারিদ্র্য। এই মূল দারিদ্র্যের আবার উপধরন আছে, যেমন আয়ের দারিদ্র্য, ক্ষুধার দারিদ্র্য, কর্মহীনতার দারিদ্র্য, স্বল্পমজুরির দারিদ্র্য, আবাসনের দারিদ্র্য, অস্বচ্ছতা-উদ্ভূত দারিদ্র্য, শিশু দারিদ্র্য, প্রবীণ মানুষের দারিদ্র্য, নারীপ্রধান খানার দারিদ্র্য, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকের দারিদ্র্য, ভাসমান মানুষের দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধী মানুষের দারিদ্র্য, মঙ্গা এলাকার মানুষের দারিদ্র্য, বহিস্থ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য, বস্তিবাসী ও অতিস্বল্প আয়ের মানুষের দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা-উদ্ভূত দারিদ্র্য, প্রান্তিকতা থেকে উদ্ভূত দারিদ্র্য (অনানুষ্ঠানিক সেক্টর, আদিবাসী মানুষ, নিম্নবর্ণ-দলিত, পশ্চাৎপদ পেশা, চর-হাওর-বাঁওড়ের মানুষ), রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণে বাধাজনিত দারিদ্র্য, রাষ্ট্র-সরকার পরিচালনাকারীদের প্রতি আস্থাহীনতা-উদ্ভূত দারিদ্র্য এবং মানসকাঠামোর দারিদ্র্য।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে উপরিল্লিখিত সব ধরন-উপধরনের বৈষম্য ও দারিদ্র্য আছে এবং তা ক্রমবর্ধমান হারের বাড়ছে। বৈষম্য ও দারিদ্র্য বিষয়ে সরকারের ৫৪ বছরের বার্ষিক বাজেটের সাধারণ নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হলে ১৯৭৩-২০০৫ সাল পর্যন্ত খাদ্য গ্রহণ পদ্ধতির ভিত্তিতে দুই ধরনের দরিদ্র খানার তথ্য যথা নিরঙ্কুশ দরিদ্র ও চরম-হতদরিদ্র খানা এবং ১৯৯১-২০২২ সাল পর্যন্ত খানার মৌলিক চাহিদা পদ্ধতির ভিত্তিতে দুধরনের দরিদ্র খানার তথ্য যথা উচ্চ দারিদ্র্যসীমার নিচের খানা এবং নিম্নদারিদ্র্য সীমার নিচের খানার তথ্য প্রয়োজন। তবে সত্যিকার তথ্য ও প্রবণতা জানতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মৌলিক চাহিদা পদ্ধতির ভিত্তিতে খানার দারিদ্র্য হার ও খাদ্য গ্রহণ পদ্ধতিভিত্তিক খানার দারিদ্র্য হার জানা, যা ইচ্ছা করেই রাষ্ট্র লুকিয়ে রাখে। অথচ খানার আয়-ব্যয় জরিপে সরকার প্রকৃত দারিদ্র্য হারসংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য ঠিকই সংগ্রহ করে, কিন্তু প্রকাশ করে না। এমনিতেই সংজ্ঞায়নের চাতুরিতে সরকারি পরিসংখ্যানের দরিদ্র-দারিদ্র্যসংশ্লিষ্ট হার সঠিক নয়, তার ওপরে তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়। এই প্রবণতার পেছনে ধনীদের আরও ধনী করার রাষ্ট্রীয় পরিচালনা নীতি-দর্শন।
দীর্ঘকাল ধরে জাতীয় বাজেটের পরিকল্পনায় মূলত জিডিপি-উন্নয়ন এবং বড় প্রকল্পের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ঘাটতির হিসাব মেটাতে করহার কম রাখা, বাজেটের একটি বড় অংশ ঋণের ওপর নির্ভরশীল রাখা এবং অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ প্রদানের কারণে সরাসরি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগভিত্তিক অর্থনীতির পথে হাঁটলেও পরবর্তী সময়ে বেসরকারি খাতকে উদ্দীপিত করার প্রয়াসে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়, যা সামাজিক সাম্য বিধানে বাজেটের অবদানকে সীমিত করে।
১৯৯১ সালে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করা হলেও সমাজসেবা খাতে বরাদ্দ সেই অনুপাতে বাড়েনি। রাজস্ব গঠন ও বড় প্রকল্পকেন্দ্রিক পরিকল্পনায় বেশি মনোযোগ দেওয়ায় ক্ষুদ্র কৃষক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু হলেও ধনী শ্রেণির জন্য বিশেষ সুবিধা এবং কালোটাকার বৈধকরণ কৌশল অব্যাহত ছিল। দীর্ঘ একক দলীয় শাসনামলে জ্বালানি-বিদ্যুৎ, অবকাঠামোর বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সামাজিক খাতে বরাদ্দ তেমন বাড়েনি। বরং করনীতিতে আবার আয়-গোপন করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়, যা ধনী-সম্পদের বৈধীকরণ করে কর ফাঁকির সুযোগ বহাল রাখে এবং সরকারের আদর্শে সাম্য আনতে অপারগতার পরিচয় দেয়। ফলে সামগ্রিক গড় আয় বাড়লেও দেশের সবচেয়ে ধনী শ্রেণির আয়ের অংশ ক্রমেই বেড়েছে এবং নিম্নবিত্তের অংশ খুবই সামান্য। সরকারি রাজস্ব আহরণের দুর্বল কাঠামোও বৈষম্য বাড়িয়েছে।
কর-জিডিপি অনুপাত দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমুখী, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় সর্বনিম্ন। রাজস্ব জোগাড়ের এই দুর্বলতা বোঝায় বাজেটের ঘাটতি কেবল ঋণ এবং সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো করের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ অনিয়মপূর্ণ লেনদেন এবং রূপান্তরবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে এত দিন বড় আয়ের লোকেরা কর ফাঁকি দিয়ে আসছে, যার ফলে সরকার বিকল্প না পেয়ে বাড়তি করের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর চাপাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং এ খাতে বরাদ্দের অবস্থাও হতাশাজনক। বরাদ্দের একটি বড় অংশ পেনশন, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদ এবং কৃষি ভর্তুকির মতো খাতে চলে যায়, যা সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন সহায়ক নয়। অর্থনীতিতে কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব অপরিসীম হলেও বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো ঘাটতি দেখা যায়।
কৃষি খাতে বরাদ্দ হ্রাস পাওয়ায় এবং সাশ্রয়ী মূল্যের কৃষি উপকরণের অভাবে কৃষকরা সংকটের মুখে পড়ে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও বরাদ্দ অপ্রতুল, যা মানবসম্পদ উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে শিল্প, পরিবহন ও অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির ফলে অল্প সংখ্যক বৃহৎ ব্যবসায়ী ও নির্মাণ সংস্থা লাভবান হচ্ছে, কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন বাড়েনি।
তিন দশকের বর্ধনশীল জনগোষ্ঠীর অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময়কালে ৭৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীই দরিদ্র এবং ১৪ শতাংশ মূলত অতীতের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি-উদ্ভূত। একই সময়ে মধ্য-মধ্যবিত্ত জনসংখ্যার পরিমাণ বেড়েছে ২ কোটি ৭৬ লাখ। মধ্য-মধ্যবিত্তে বর্ধমান শতকরা ৬১ শতাংশ জনসংখ্যা গঠিত হয়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত গ্রুপে বৃদ্ধির কারণে। জনসংখ্যার এই প্রবণতা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ওপরে উঠতে দেয় না, আর মধ্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিম্ন-মধ্যবিত্তের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। এই অবস্থা সৃষ্টিতে জাতীয় সংসদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে উপস্থাপিত জাতীয় বাজেট মুখ্য ভূমিকা রখেছে। ফলে গত ৩০ বছরে যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৩৭ শতাংশ, ঠিক একই সময়ে নিম্ন-মধ্যবিত্তের বৃদ্ধির হার ৪৭ শতাংশ; আর অতীতের নিম্ন-মধ্যবিত্তদের এক বৃহৎ অংশ দারিদ্র্যের সমাজে ডুবে গেছে। বিত্তের এই অধঃপতনমুখী যাত্রা দেখে নির্মোহ যেকোনো মানুষই নিশ্চয় নির্দ্বিধায় বলবে, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছরের বাজেট রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ‘আয় ও সম্পদবৈষম্য বৃদ্ধির কারিগর’ পরীক্ষায় সফলভাবে প্রথম শ্রেণি নিয়ে পাস করেছে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।