• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

নারী ক্রিকেটে উদ্ভাসিত, বিজ্ঞাপনে উপেক্ষিত


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২, ০২:১৬ পিএম
নারী ক্রিকেটে উদ্ভাসিত, বিজ্ঞাপনে উপেক্ষিত

সাফল্য আছে। আবার আছে অপ্রাপ্তির হাহাকার! সেই অপ্রাপ্তি যতটা ক্রিকেটীয়, তার চেয়ে বেশি সামাজিক। প্রাতিষ্ঠানিক। এশিয়া কাপের মতো একটা ট্রফি এনে দিয়েছেন তারা বাংলাদেশকে। কিন্তু এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা কতটা মনে রেখেছেন নারী ক্রিকেটারদের সেই সাফল্যকে? এবার আবার বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করল তারা বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। তারপরও প্রশ্নটা সামনে চলে আসছে, দেশের নারী ক্রিকেটাররা কি তাদের প্রাপ্যটা পাচ্ছেন!

জোর গলায় নয়। মিনমিন করেও কেউ বলতে পারবেন না—পাচ্ছেন! ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টরা বলার চেষ্টা করেন, আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করছি, ওদের প্রাপ্যটুকু দিতে। সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে। ব্যস। তাতেই আমরা বলছি, আমাদের নারী ক্রিকেটও এগিয়ে যাচ্ছে।

হ্যাঁ, যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কতটা এগিয়ে দিতে পারছি? প্রশ্নটা সেখানে। সত্যি কথা হচ্ছে, এখনো দেশের নারী ক্রিকেট ভালো কোনো প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। যে কারণে নারী ক্রিকেট তার প্রাপ্য পরিচিতি পায়নি। গ্ল্যামার পায়নি। মর্যাদা পায়নি। কিন্তু তুলনামূলক পুরুষদের চেয়ে বড় সাফল্য এশিয়া কাপ জিতেছে তারা। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তাদের ঘিরে নিজেদের মাটিতে আবার এশিয়া কাপ জয়ের স্বপ্নও আমরা দেখছি। তারপরও প্রশ্ন, প্রাপ্য মর্যাদাটুকু পাচ্ছে কি তারা? এই যে সাফজয়ী নারী ফুটবলারদের নিয়ে কত উচ্ছ্বাস। কত আবেগ। এর সবকিছুই তাদের প্রাপ্য। সেটা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও সাফজয়ী নারীদের সবার আগে ৫০ লাখ টাকা অর্থ পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু প্রদীপের নিচে অন্ধকার! নারী ক্রিকেটারদের জন্য বিসিবির যা করার তা কি পুরোপুরি করছে? নারীদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো দরকার। খেলার মাঠ। জিম। সুইমিংপুল। ইনডোর সুযোগ-সুবিধা, এর কোনোটাই কি নারীদের জন্য, নারী ক্রিকেটের উন্নয়নে আলাদাভাবে করা হচ্ছে?

আত্মপক্ষ সমর্থনে ক্রিকেট কর্তারা একটা কথা বলতেই পারেন। ক্রিকেট শুধু একটা খেলা নয়। বিনোদন। সেই বিনোদনও এখন পুঁজিবাজার-সম্পৃক্ত। কারণ, ক্রিকেট যতটা খেলা তার চেয়ে বেশি পণ্য। সেই পণ্যটা বিক্রি করা হয় দর্শক বিনোদনের জন্য। তাই ক্রিকেট চালিত হয় পুঁজিবাদী শক্তির দ্বারা। সিদ্ধান্তও হয় বাণিজ্যিকভাবে। আর এটাও ঠিক, বাংলাদেশ ক্রিকেট এখনো ঝাঁ-চকচকে উঁচু স্তরে পৌঁছায়নি, যা স্যাটেলাইট টিভির মাধ্যমে দর্শকের কাছে বিক্রি হবে।কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ব্যাংক ব্যালান্স তো যথেষ্ট। সেখান থেকে নারী ক্রিকেটারদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানোর কথা ভাবা যায় না কি? 

নারী ক্রিকেটারদের সার্বিক উন্নতি, মর্যাদা, অধিকারকে গুরুত্ব দিতে হলে মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। যে ক্রিকেট বোর্ডে একজন নারী পরিচালক নেই, সেখানে নারীদের নিয়ে বিশেষভাবে পরিকল্পনা করবেন, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ, এই সমাজব্যবস্থায় একজন পুরুষের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন, একজন নারী ক্রিকেটারকে মাঠের লড়াই শুরু করার আগে মাঠের বাইরে কতগুলো লড়াই জিতে আসতে হয়।

ক্রিকেট আর ক্রিকেটাররা এখন বিজ্ঞাপনের বড় বাজার। কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনের বাজারেও নারী ক্রিকেটাররা উপেক্ষিত। এটা আমাদের সমাজের এক দ্বৈতচরিত্রের প্রকাশ! বিজ্ঞাপনে নারীদের উপস্থাপন যথেচ্ছার! তখন মনে হয় নারীই হচ্ছে চমৎকার বিজ্ঞাপনী শক্তি। কিন্তু কোনো নারী ক্রিকেটারকে বিজ্ঞাপনী মডেল করার সময় বলা হবে; না না! এদের এই আটপৌরে জীবনের চেহারা নিয়ে মডেল হয় না! দরকার মাদকতায় ভরা মায়াবী সৌন্দর্য। যাদের ঘিরে রূপকথার জাল বোনা যায়! এসব দেখে মনে হয়, তাহলে নারী ক্রিকেটারদের এই সব সাফল্য কি অন্তঃসারশূন্য? আবার তাই যদি হবে, তাহলে নারীরা ব্যর্থ হলেই কেন রব ওঠে; ’গেল গেল!’ কেন বলা হয়, ’এদের দিয়ে হবে না।’ আসলে এখনো আমাদের বিশ্বাস ঘরে খিল আঁটা আছে; ’ফুটবল, ক্রিকেট, হকি—এসব খেলা হচ্ছে পুরুষের।’ তাই পুরুষদের ব্যর্থতার পাশে নারীদের সাফল্যগুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু এখন সময় এসেছে; নারী ক্রিকেটারদের প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদাটুকু দেওয়ার। না হলে নারীদের এই বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন কিংবা তার আগে এশিয়া কাপ জয় ইতিহাস থেকে দূরে চলে যাবে। বিজয় উল্লাসের ছবি বিস্মৃত হয়ে যাবে। আর স্কোরকার্ড! রূপকথা হয়ে ক্রিকেট স্কোরবুকে পড়ে থাকবে!

 

লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক

Link copied!