• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

অবন্তিকা কেন স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিলেন?


সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৪, ০৪:৩১ পিএম
অবন্তিকা কেন স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিলেন?

‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’ কবির কথাটি আমাদের সবারই আরাধনা। কে-ই বা অকারণে অকাতরে মরতে চায়? বাঁচার জন্য মানুষের সেকি আহাজারি; তা হাসপাতালে গেলেই বোঝা যায়। একটি দিন বা একটি ঘণ্টা বাঁচার জন্য লাখ লাখ টাকা ঢেলে দিচ্ছে আইসিইউ, সিসিইউ বা পিআইসিইউতে। তবে এর মধ্যেও ব্যতিক্রম কিছু মানুষ আছে। যারা মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সাহসিকতার সঙ্গে কাজটি করেও ফেলেন। কঠিন এই সিদ্ধান্তটি সবাই নিতে পারেন না। যারা পারেন, তারা সবার চেয়ে আলাদা। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? এ প্রশ্নের সহজ কোনো জবাব আমাদের কাছে নেই। যিনি আত্মহত্যা করেন, তিনিই কেবল বলতে পারবেন এর কারণ। তবে সে কারণ আর আমরা জানতে পারি না। জানার সুযোগও তেমন হয় না। পুলিশি তদন্তে, চিরকুটে বা লাইভে যতটুকু জানি, তা সমষ্টিগত কারণ না-ও হতে পারে। ব্যক্তির অন্তরে লুকানো সেই গোপন ব্যথা বা কথা কোনো কালেই জানা সম্ভব হয় না। সামাজিক অবহেলা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-অভিমান, ব্যক্তিগত ক্ষোভ, কর্মজীবনে হতাশা, জীবনের প্রতি অনীহা, প্রিয়জনের প্রতারণা মানুষকে আত্মহননের দিকে ধাবিত করে। ফলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে, ঘরের মধ্যে বিষপানে, গলায় রশি বা ওড়না পেঁচিয়ে, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে, উঁচু ভবন থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি আত্মহত্যা আমাদের সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ আত্মহত্যা করেছেন। কারণ হিসেবে একাকীত্ব, অভিমান এবং অপ্রাপ্তিকেই দায়ী করছেন অনেকে। তার কয়েকদিন পরই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা। সেখানে দুজনকে দায়ী করে গেছেন তিনি। তার সেই স্ট্যাটাস অনুযায়ী সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী এবং শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে আটক করেছে পুলিশ। এই আত্মহত্যার প্ররোচনায় তাদের প্রাথমিক সংশ্লিষ্টতাও পেয়েছে পুলিশ। ফলে এটি নিছক আত্মহত্যা নয়। এক ধরনের হত্যাও বটে।

যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবন্তিকাকে এতদিন বিমর্ষতার মধ্য দিয়ে যেতে হলো, সেই ঘটনার সমাধান অনেক আগেই হতে পারতো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্তরিকভাবে বিষয়টি দেখতে পারতো। তারই মধ্যে আবার উঠে এসেছে আম্মান সিদ্দিকীর প্রেমের প্রস্তাবের বিষয়টিও। অবন্তিকার পরিবার বা সহপাঠীদের ভাষ্যমতে, ডিপ্রেশনে থাকা অবন্তিকা দীর্ঘদিন সারভাইভ করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন নিজের ওপর। সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী এবং প্রক্টর দ্বীন ইসলামের তিরস্কার বা মানসিক হয়রানিও অবন্তিকার জীবনকে বিষিয়ে তুলেছিল হয়তো। এভাবে অনেক কিছুই আমরা অনুমান করে বলতে পারবো। তবে যথাযথ প্রমাণ পেলেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাবে। তাই এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক, এটা অন্তত কেউ চাইবো না। সবাই বলবো, এর সঠিক বিচার হওয়া উচিত। না হলে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি অভিভাবকদের আস্থা কমে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বিষবিদ্যালয়’ মনে হবে। অপরাধীরাও একের পর ঘটনার জন্ম দিতে উৎসাহী হয়ে উঠবে। তাই এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করছি।  

প্ররোচনা বা যে কোনো কারণেই হোক, চিকিৎসকরা আত্মহত্যার চেষ্টাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবেই বিবেচনা করেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশ আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে একধরনের অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। কিশোর-কিশোরী এবং যাদের বয়স পঁয়ত্রিশের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ। পুরুষদের মধ্যে আবার তরুণদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। পরীক্ষায় অকৃতকার্য, প্রেমে ব্যর্থ হলেও তারা আত্মহত্যা করে। বদ্ধ ঘরে, খোলা মাঠে, রেললাইনে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। এ দুটি ঘটনার আগে এরশাদ শিকদারের মেয়ে, নায়ক রিয়াজের শ্বশুর এবং মসজিদের ইমামের আত্মহত্যার ঘটনাও আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

পত্রপত্রিকা সূত্রে জানা যায়, দেশে হত্যার তুলনায় প্রায় চারগুণ বেড়েছে আত্মহত্যার সংখ্যা। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আত্মখুনের মহোৎসব হয়েছিল। ফলে খুনের চেয়েও বেশি আত্মহত্যার পরিমাণ। এটা নিঃসন্দেহে ভাবার মতো বিষয়। তা ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যার প্রবণতাও যেন বাড়ছে। কেননা অবন্তিকার বানানো একটি ফেক আইডি, স্ক্রিনশট, মুচলেকা, বিভিন্নজনের কাছে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো এবং আত্মহত্যার স্ট্যাটাসও সংঘটিত হয়েছে এই তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণেই। এমনকি এই হত্যার খবরও ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে বা লাইভে এসে আত্মহত্যা করছেন। সেই আত্মহত্যার ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ছে কোমলমতি শিশু ও দুর্বলচিত্তের বৃদ্ধের মনে। আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেও মানুষ এ পথে ধাবিত হয়। কিন্তু কেন? সেই জবাব খোঁজার আগে আমাদের উচিত কাছের মানুষের প্রতি নজর রাখা। হতাশাগ্রস্ত স্বজনের পাশে দাঁড়ানো। তাকে সাহস দেওয়া, স্বপ্ন দেখানো। জীবনের মূল্য বা বেঁচে থাকার মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানানো। আমরা জানি, প্রত্যেক প্রাণীর জন্য মৃত্যু অবধারিত। তারপরও অপমৃত্যু কখনোই কাম্য নয়। কেননা আত্মহত্যা মোটেই ইতিবাচক নয়। আমাদের চোখ-কান খোলা রাখা উচিত। পরাজিতকে তিরস্কার না করে সহমর্মিতা দেখানো উচিত। ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ মন্ত্রে উজ্জীবিত করা উচিত। যে হতাশা, অবাস্তব প্রত্যাশা, অযৌক্তিক চাহিদার চাপ, একাকীত্ব, চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার পার্থক্যের জন্য নিজেকে দায়ী ভাবা, আশাহীনতা এমন অনেক কারণেই মানুষ নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছে। সেদিক বিবেচনা করে এখন সময় এসেছে সর্বস্তরের প্রতিটি বয়সের প্রত্যেক ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা শুরু করার।

মনে রাখতে হবে, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। নয় বুদ্ধিমানের কাজও। বারবার হেরে গিয়েও উঠে দাঁড়ানোই বীরত্ব। হেরে গিয়ে মরে গিয়ে মুক্তি পাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। কাপুরুষরা মরার আগেই মরে। কেননা তারা আত্মহত্যা করে। এমনকি জীবনভীতরাই আত্মহত্যা করে। তারা সুপুরুষ হতে পারে না। জীবনে যত জটিলতা, ততই সমাধান—এ মন্ত্রে বিশ্বাসী হলে কেউ জীবনের ওপর আস্থা হারাবে না। কথায় আছে, আত্মহননকারীর না আছে ইহকাল, না আছে পরকাল। সব ধর্মেই আত্মহত্যা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ধৈর্য ধারণের মধ্য দিয়ে বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে ওঠার মন্ত্র শেখানো হয়েছে। তাই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকেও সচেতন হতে হবে। পরিবারের কোনো সদস্য হতাশায় ভুগতে থাকলে তাকে সাপোর্ট দিতে হবে। সমাজের কেউ ডিপ্রেশনে থাকলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রকে নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বন্ধুমহলে কেউ বিপথগামী হলে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। একটি নিষ্পাপ জীবনকে মহাপাপের কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে। সর্বোপরি মানুষে মানুষে ভালোবাসা বাড়াতে হবে। দায়িত্বশীলতা, দায়বোধ, মমতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

যেহেতু আত্মহত্যা একধরনের মানসিক সমস্যাও বটে। তাই তার মানসিক উন্নতির জন্য যথাযথ চিকিৎসা বা কাউন্সেলিং জরুরি। পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের অন্তরে শুভ বোধ আসুক। চেতনা আসুক। আত্মহত্যার বদলে আত্মচেষ্টা জাগ্রত হোক। সবশেষে বলতে চাই, আর একটি ফুলও যেন অকালে ঝরে না যায়। বরং ফুল ফুটুক আপন সৌন্দর্যে—এ প্রত্যাশা বা কামনা হোক সবার। ভালো থাকুক সবার প্রিয়জন। হ্রাস পাক আত্মহত্যার প্রবণতা। অপরাধীরাও শাস্তি পাক। যারা প্ররোচিত করে থাকেন বিভিন্নভাবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী

Link copied!