ড. মো. আইনুল ইসলাম
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি আপাতদৃষ্টে আকর্ষণীয় মনে হলেও, এটি আসলে একটি বিভ্রান্তিকর কৌশল। এটি এমন একটি সরলীকৃত আখ্যান, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল কারণগুলোকে উপেক্ষা করে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৮৭০ থেকে ১৮৯০ সালের ‘গিল্ডেড এজ’-এর দিকে তাকিয়ে ট্রাম্প হয়তো সেই সময়ের প্রগতিশীল আয়করের অনুপস্থিতি এবং শুল্ক-নির্ভরতাকে আদর্শ মনে করেন। কিন্তু আপাদমস্তক ক্রমবর্ধমান মুনাফায় বিশ্বাসী ব্যবসায়ী ও ধনীদের প্রতিনিধি ডোনাল্ড ট্রাম্প ভুলে যাচ্ছেন যে সেই যুগের শিল্পবিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি ছিল শক্তিশালী সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্ব। যুক্তরাষ্ট্রের ১৯ শতকের শিল্পবিপ্লব কেবল উচ্চ শুল্ক বা ট্যারিফের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। এর পেছনে কাজ করেছিল একটি সুচিন্তিত ও বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, যা আজকের মুক্তবাজার অর্থনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। ‘আমেরিকান স্কুল অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’র মূলমন্ত্র ছিল একটি মিশ্র অর্থনীতি, যেখানে সরকার শুধু একজন দর্শক নয়, বরং একটি সক্রিয় শক্তি হিসেবে কাজ করত। সরকার সে সময় খাল, রেলপথ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে ব্যাপক বিনিয়োগ করত। এই বিনিয়োগের উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন ছিল না, বরং ন্যূনতম খরচে পরিষেবা প্রদান করা। এর ফলে বেসরকারি খাতের ব্যবসার খরচ কমে যেত এবং যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা লাভ করত। পাশাপাশি সে সময় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি ছিল ‘উচ্চ মজুরির অর্থনীতি’। সে সময়ের নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন যে একটি দক্ষ, সুস্থ ও সুশিক্ষিত কর্মীবাহিনী অধিক উৎপাদনশীল, যা কেবল মজুরি বৃদ্ধির মাধ্যমেই নয়, বরং জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়েও অর্জন করা যায়। বিনা মূল্যে শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য উদ্যোগের মাধ্যমে শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা হয়, যা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ বাঁচিয়ে দিত। এসব নীতির মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র একসময় শিল্পে বিশ্বসেরা হয়ে ওঠে।
ওই সময়ের প্রেক্ষপটে ট্রাম্পের আজকের নীতি আসলে শিল্প পুনর্জাগরণের পুরোপুরি অন্তরায়। কেননা, ট্রাম্পের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এই ঐতিহাসিক নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি ট্যারিফকে একমাত্র সমাধান হিসেবে তুলে ধরছেন এবং এটিকে ব্যবহার করছেন ধনীদের ওপর থেকে প্রগতিশীল করের বোঝা কমানোর হাতিয়ার হিসেবে। তার এই পরিকল্পনা কোনো শিল্প পুনর্জাগরণের জন্য নয়, বরং ধনীদের আরও ধনী করার একটি কৌশল। তিনি যে গিল্ডেড এজের প্রশংসা করেন, তা সবার জন্য সমৃদ্ধির যুগ ছিল না। বরং এটি ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য ও একচেটিয়া ব্যবসার যুগ। সেই সময়ের অসাম্য দূর করতে ১৯১৩ সালে প্রগতিশীল আয়কর চালু করা হয়, যার লক্ষ্য ছিল কেবল ধনীদের অ-উপার্জিত আয়ের ওপর কর বসানো। ট্রাম্পের বর্তমান নীতিগুলো যেমন সরকারি সম্পদ বেসরকারীকরণ, নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করা এবং কর কমানো প্রকৃত অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পকে পঙ্গু করে দিয়েছে, দিচ্ছে। ঋণের বিস্তার, আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার বর্ধিত খরচ একটি অসহনীয় বোঝা তৈরি করেছে। এই আর্থিকীকরণ বা ফাইন্যান্সিশিয়ালাইজেশন-ই যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পহীনতার মূল কারণ, ট্যারিফের অভাব নয়। এখানে সবচেয়ে বড় বিদ্রূপ হলো, ট্রাম্প যে চীনকে শাস্তি দিতে চান, সেই চীনই কিন্তু অনেক দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো শিল্পনীতির অনুসরণ করছে। চীনের সরকার অবকাঠামোতে বড় আকারের সরকারি বিনিয়োগ, কম খরচে পরিষেবা এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের শিল্পকে শক্তিশালী করছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদরাসহ বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতি যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যাকে আরও জটিল করবে। এটি ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম বাড়াবে এবং সরবরাহ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করবে, যার ফলে কর্মসংস্থান কমবে এবং ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এটি মার্কিন অর্থনীতিকে রেন্টিয়ার আয় থেকে মুক্ত করবে না, বরং এমন একটি ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে, যা অল্প কিছু মানুষের মূলধনী লাভকে অগ্রাধিকার দেয়। এই অর্থে ট্রাম্পের ট্যারিফ কোনো নতুন পথের দিশা নয়, বরং একটি পশ্চাৎপদ পদক্ষেপ। সত্যিকারের শিল্প পুনর্জাগরণের জন্য প্রয়োজন এমন নীতি, যা মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমাবে এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতাকে উৎসাহিত করবে। শুধু ট্যারিফ চাপিয়ে দিয়ে শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা হবে একটি ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে এক মোহময়ী প্রচেষ্টা, যা যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে সহজেই পরিষ্কার হবে।
২০২৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুসারে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতি মার্কিন অর্থনীতিতে শিল্প পুনর্জাগরণের কাক্সিক্ষত ইতিবাচক ফল দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং এটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে নতুন কিছু অর্থনৈতিক বিপদ ডেকে আনছে। আপাতদৃষ্টে বেকারত্বের হার জুলাই মাসে ৪ দশমিক ২ শতাংশের কাছাকাছি স্থিতিশীল মনে হলেও, এর পেছনের কারণ ভিন্ন। প্রকৃত কর্মসংস্থান বৃদ্ধির চেয়ে শ্রমশক্তির সংকোচন এবং চাকরির সংখ্যা উপাত্তের নিম্নমুখী সংশোধন এই কম বেকারত্বের প্রধান কারণ। জুলাই মাসে মাত্র ৭৩ হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়েছে, যা শ্রমবাজারের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে। এই শ্লথ প্রবণতার মূল কারণ হলো কঠোর অভিবাসন নীতি, যা অভিবাসী শ্রমিকের প্রবাহকে প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে কৃষি, নির্মাণ, উৎপাদন ও সেবা খাতের মতো অভিবাসীনির্ভর শিল্পগুলোতে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে, যা মজুরি ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করছে। এই শ্রম সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতির সরাসরি প্রভাব, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও তীব্র করে তুলছে। আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ আরোপের ফলে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি জুলাইয়ে বছরওয়ারি ২.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ফেডারেল রিজার্ভের ২ শতাংশ লক্ষ্যের এখনো ওপরে। একই সময়ে উৎপাদক মূল্য সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও মূল্যস্ফীতির ইঙ্গিত দেয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ট্যাম্প ট্যারিফ প্যাকেজ সামগ্রিকভাবে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি যোগ করতে পারে, যা কিছু অর্থনীতিবিদের অনুমানে ২.২ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এই দ্বিমুখী চাপ, অর্থাৎ ট্যারিফ এবং শ্রম সংকটের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি, মার্কিন অর্থনীতিকে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে এখন সেখানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতি দেশীয় শিল্পকে সাময়িক সুরক্ষা দিলেও, তা একই সঙ্গে ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপাচ্ছে এবং মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করছে। এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি, অর্থাৎ শ্রমশক্তির ধারাবাহিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। শিল্প পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখালেও, বাস্তবতা হলো ট্রাম্পের নীতিগুলো অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং বৈষম্যকেই আরও বাড়িয়ে তুলছে, যা বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির মানদণ্ডে তার নীতির কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দহরম-মহরম করা দেশগুলোকেও সতর্ক এক বার্তা দিচ্ছে।
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়