• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

পরীক্ষায় পাসের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি


জান্নাতুল যূথী
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৩, ১১:৫৭ এএম
পরীক্ষায় পাসের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি

হার-জিত জীবনের অংশ। মানুষ হেরে গেলে সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আবারও নতুন উদ্যমে পথ চলা শুরু করে। এই স্বাভাবিক সত্যটা আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষই স্বীকার করতে নারাজ। মূলত আমাদের সমাজ বিজয়ীকে সাদরে গ্রহণ করলেও হেরে যাওয়া মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। যার ফল হয় ভয়াবহ!

বর্তমান সময়ে যান্ত্রিক শাসন এবং সভ্যতার দখলে জাতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার। ফলে এক স্থানের খবর দ্রুত অন্যত্র পৌঁছে  যাচ্ছে। আর ঘরের খবর যখন বাইরে ফলাও করা হচ্ছে তখন অন্যত্র চাপ বাড়তে থাকে। যে চাপ অনেকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। কেউবা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো পথ! এই ঘটনার অবতারণা এ কারণে যে, ৮ ফেব্রুয়ারি এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। যাতে অনেকেই খুব ভালো ফল করেছে, আবার কেউবা সন্তোষজনক ফল করতে পারেনি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অভিভাবকের রোষানলে পড়ছে অনেকেই। মনে রাখতে হবে, জীবনের এক একটি অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই অর্জনই যখন অন্যের জীবনকে বিপন্ন করতে উস্কানি দিচ্ছে, তখন এই আবেগ প্রকাশকে স্বাভাবিক বলা চলে না।

পড়াশোনা-পরীক্ষা জীবনের অংশ, কিন্তু সমগ্র জীবন নয়। এই একটি সূক্ষ্ম এবং গূঢ় সত্য আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দিই না। বরং নিজের সন্তান ভালো ফল করলে সেটা প্রকাশের ক্ষেত্রে না রাখি শালীনতা, না রাখি বিবেকের দায়। এর ফলে অন্য সন্তান যারা অপেক্ষাকৃত ভালো ফল করতে পারেনি তারা মানসিক ট্রমায় পড়ছে। আর যারা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে তারা পরিবার-সমাজের চাপে পড়ে জীবনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেকেই মত প্রকাশ করতেই পারেন, ‘আমার সন্তান ভালো ফল অর্জন করেছে, কেনই বা অন্যকে জানাবো না।’ এই বিষয়টি যে সত্য নয়, তা নয়। তবে মনে রাখতে হবে, আমরা মানুষ। ফলে সমাজের কিছু দায় আমাদের থাকেই। তারচেয়ে বড় কথা এই পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষই মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু পরিচর্যা, সুযোগের অভাবে হয়তো সবার মেধার সমান বিকাশ ঘটে না। তাই বলে কি বলা যাবে অন্যের মেধা কম! সে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেনি। বরং ফলাফলের ওপর ব্যক্তির জীবন কখনোই নির্ভর করে না।

যদি তাই হয় তাহলে ভাবুন, গ্রামের একটি অতি দরিদ্র সন্তান যখন তথাকথিত এ প্লাসধারী হচ্ছে তাকে কী বলবেন? সে না পেয়েছে যত্ন না পেয়েছে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ। ফলে জ্ঞানের পরিমাপ কখনও পরীক্ষার ফল দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। এটি একটি অ্যাকাডেমিক বিষয়। খেয়াল করলে দেখবেন রবীন্দ্রনাথ,  নজরুল, আরজ আলী মাতবর প্রমুখ সাহিত্যিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন। তবে কি আপনি-আমি বলবো তারা অজ্ঞ ছিলেন! এমনকি আইনস্টাইন, গ্যালিলিও তাদের বিদ্যার দৌড় কতটুকু? এই প্রশ্নগুলো একেবারেই অবান্তর। তবে আমাদের সমাজ কিছু অবান্তর বিষয় নিয়েই মাথা ঘামায় বেশি।

সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে হলে এ প্লাস অবশ্বম্ভাবি নয়। তার জন্য প্রকৃত জ্ঞানের চর্চা জরুরি। আজকের সমাজে এমনও অসংখ্য কিশোর, যুবক, তরুণ-তরুণীর দেখা মিলছে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও খুব সুন্দরভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক ডিভাইস বানিয়ে সাড়া জাগাচ্ছেন। তাদের মেধার কী পরিচয় দেবেন? ফলে সন্তানের একটি পরীক্ষায় ভালো বা খারাপ করার ওপর তার পুরো জীবন নির্ভর করে না। বরং অভিভাবক হিসেবে সন্তান কিভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে সামনের দিকে অগ্রসর হবে সেদিকে মনোনিবেশ করতে হবে। যে বা যারা শুধু সন্তানের ফলকে কেন্দ্র করে কটূক্তি, অপব্যাখ্যা দাঁড় করান বরং সেই ‘ভাইরাস’ থেকে নিজে এবং সন্তানকে দূরে রাখুন। যাতে কাঁচা মনে পচন না ধরে।

জীবনের পথ দীর্ঘ। আর এই দীর্ঘ পথ কখনোই সমান্তরাল নয়। এর উঁচু-নিচু পথে প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ পথে চলতে হয়। ফলে কেউ যখন কারো পথ বদলে দিতে পারে না তাই অন্যের কুকথায় মনোনিবেশ না করে নিজের কাজের ওপর ফোকাস করতে হবে। সন্তান যদি আপনার প্রত্যাশিত চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় তবে তাকে সঠিক পরিচর্যা দিন। যাতে পরবর্তী ধাপ বাধাহীনভাবে পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি করতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে সন্তানের পরীক্ষার ফল ঢাক পিটিয়ে বলার কিছু নেই। আপনার যদি একান্তই আবেগ উপচে পড়ে সর্বোচ্চ আপনি নিজের সন্তানের মঙ্গল কামনা করুন। সেই মঙ্গল চাওয়ার জন্য রেজাল্ট শিটের ছবি প্রকাশ করা বোকামি। ফলে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন। অন্য সন্তানদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করুন। আপনার অতি আবেগ অন্যের আদরের সন্তানকে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করছে। একপর্যায়ে সে আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।

গতকাল এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ঠাকুরগাঁওয়ের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। কি নির্মম এবং দুঃসহ ঘটনা সেই পিতামাতার জন্য! এই দুঃখ যেই বাবা-মায়ের সন্তান পৃথিবী থেকে চলে গেলেন তারাই অনুধাবন করতে পারবেন। কিন্তু এ সমাজেরও বোঝা দরকার। আর কতকাল মূর্খদের দলে থাকবে জাতি! আবেগ প্রকাশে যদি সংযত না হতে পারি আমরা তবে ঠাকুরগাঁও এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তাই নিজে সর্তক হোন অন্যকেও বিষয়টি সম্পর্কে জানান।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক।

Link copied!