• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২০ মুহররম ১৪৪৫
ক্যারেন গ্রাহাম

আফগানিস্তান দখল হয়নি, হাতে তুলে দেয়া হয়েছে


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২১, ০৫:৩৬ পিএম
আফগানিস্তান দখল হয়নি,  হাতে তুলে দেয়া হয়েছে
ছবিতে দেখা যাচ্ছে তালেবান যোদ্ধাদের একাংশ

এটা কি করে সম্ভব, কয়েক সপ্তাহের ভেতর সামরিকভাবে দুর্বল ৮০ হাজার তালেবান যোদ্ধা সুসজ্জিত পদাতিক, বিমান ও পুলিশ বাহিনীর ৩ লাখ ৬শ ৯৯ জন আফগান সেনাকে হারিয়ে দিলো? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন এসে দাঁড়াতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা গত দুই দশক ধরে তাহলে আফগানিস্তানে কী করেছে?

এক সপ্তাহ আগেই বিবিসির প্রতিবেদনের বরাতে আমরা জানতে পারি ফাঁস হয়ে যাওয়া মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যে সতর্ক করা হয়েছিল, আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই হামলার শিকার হবে এবং তিন মাসের ভেতরেই আফগান সরকার বিদায় নেবে। যাক অতো সময় লাগেনি।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ন্যাটো, যুক্তরাজ্যসহ, গত ২০ বছরে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও সুসজ্জিত করার জন্য নিজেদের উজাড় করে ব্যয় করেছে, ৮৯ বিলিয়ন ডলার তো হবেই, এই সময়কালে অসংখ্য মার্কিন ও ব্রিটিশ জেনারেল গর্বভরে দাবি করেছেন যে তারা “আরো শক্তিশালী ও সক্ষম আফগান সেনাবাহিনী” তৈরি করেছেন।

বাস্তবতা এখন ভিন্ন চিত্রই উপস্থাপন করছে। একের পর এক প্রদেশ যখন তালেবান বাহিনী দখল করতে শুরু করে, তার কয়েক ঘন্টার ভেতরেই আফগান সামরিক কমান্ডাররা বিনা লড়াইয়ে আত্মসমর্পণ করে ফেলেন।

 

বাস্তবতা ভিন্ন সত্য তুলে ধরছে

সত্যি বলতে—দেশটিতে উচ্চহারে লাগাতার হতাহতের ইতিহাস, দেশত্যাগ ও দুর্নীতির কারণে আফগান কর্মকর্তারা আসলে জানেনই না যে তাদের কতজন সেনা আছে। এতে করে লাভ হয়েছিল গুটিকয়েক আফগান কমান্ডারের, তারা দিনের পর দিন এমন বাহিনীর জন্য বেতন উত্তোলন করে গেছেন যাদের বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই—তথাকথিত ‘অশরীরি সেনা’।

তবে তালেবানদের বিপরীতে আফগান সেনাবাহিনীর এমন দুর্বল প্রতিরোধ অনেককেই হতবাক করে দিয়েছে। রয়টার্স জানাচ্ছে, সেনাবাহিনীর একাংশ যখন যুদ্ধ না করার জন্য তালেবানদের সাথে সন্ধি করছে এবং তালেবানদের হাতে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র তুলে দিচ্ছে, তখন আরেকদল নিজেদের ঘাঁটি ছেড়ে পিঠটান দিয়েছে।

এমনকি মার্কিন কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, খোদ প্রাদেশিক গভর্নরদের কেউ কেউ নাকি, সম্ভবত রক্তপাত এড়াতে, নিরাপত্তা বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বা পালিয়ে যেতে বলেছেন, কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন পরাজয় অবশ্যসম্ভাবী। কিন্তু কার্যত কোন সমঝোতা ছাড়াই মনে হচ্ছে আফগান বাহিনী বরফের মতো গলে গেছে।

অথচ দেশটির ধারাবাহিক দুর্নীতি, দরিদ্র সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয়টি আমলে নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা ভালো করেই জানতেন—সামান্য বেতন, স্বল্প খাবার ও অনিয়মিত সরবরাহ নিয়ে সম্মুখসারির সেনারা, যাদের মধ্যে অনেকেই আবার মাসের পর মাস অথবা কয়েক বছর ধরে অনেক দূরের কোন ঘাঁটিতে দায়িত্ব পালন করছেন—তারা যে কোন মুহূর্তে নিজেদের অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যাবে।

রয়টার্সের মতে, “অনেক বছর ধরে, প্রতি মাসেই শতশত আফগান সেনা নিহত হয়েছে। তারপরও আন্তর্জাতিক সহায়তা না আসা পর্যন্ত সেনাবাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে গেছে, বায়ুযানে করে হতাহতদের সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা ও বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসক না থাকা সত্ত্বেও, অথচ এসব সেবা পশ্চিমা সেনাবাহিনীতে আবশ্যিক ব্যাপার। তাই যুদ্ধ শেষে আফগান সেনাদের সংকল্প উবে যায়।”

"আপনি কি এমন নেতাদের জন্য আপনার জীবন উৎসর্গ করবেন, যারা আপনাকে সময়মতো অর্থ দেয় না এবং যারা নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশী চিন্তিত?" নাম প্রকাশ না করার শর্তে, দ্বিতীয় সারির এক মার্কিন কর্মকর্তা এমন প্রশ্ন করেন। ঘটনা হলো—এটি একটি অনুভূতি যা তালেবানদের ভেতরে নেতারা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। একজন তালেবান কমান্ডার বলছিলেন, মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরুর পরপরই আফগান সরকারী বাহিনীর পতন শুরু হয়, যেন "আমেরিকানদের রক্ষা করা ছাড়া তাদের আর কোন আদর্শ ছিলো না।"

 

বাস্তবতা হলো আফগানিস্তান কখনই নিজের মতো হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলো না

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে সমাপ্তি টানার যে সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিয়েছেন, তাতে বিপরীত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উপহাসের সৃষ্টি হয় এবং ওরকম সিদ্ধান্তে অনেক বিশ্বনেতাও হতবাক হন।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমন প্রশ্নও উঠেছিল যে বাইডেন প্রশাসন কেন মনে করল, যুক্তরাষ্ট্রের উপর দুই দশক ধরে নির্ভরশীল আফগান বাহিনীকে এমন করে নিজেদের জিম্মায় ছেড়ে দেয়াটা নিরাপদ হবে?

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, কুড়ি বছর ধরে আকাশসীমা পাহারা, রসদ সরবরাহ, বিভিন্ন জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণ এবং এএনডিএসএফের (আফগান ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ফোর্সেস) জন্য স্থলযান ও বিমানের জন্য প্রশিক্ষণ সহায়তা সহ আরো বহু বিষয়ে বিস্তৃত প্রশিক্ষণ ও সমর্থন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ঘাঁটিগুলোতে সহায়তা দেয়া এবং পরিবহন পরিষেবা দিয়ে যাওয়ার কারণে আফগান সামরিক বাহিনী বিশ্বের যে কোন বাহিনীর সাথে তুলনীয় সমরশক্তি হয়ে উঠবে।

কিন্তু তা সত্য হয়নি—১০ বছরের প্রশিক্ষণ শেষে, ২০১০ সালে, মার্কিন সামরিক বাহিনী আফগান সেনাদের যুদ্ধ-প্রস্তুতি মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তথাকথিত ‘সিগার রিপোর্টে’ স্বীকার করা হয় তাদের পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতি “নেতৃত্ব, দুর্নীতি ও প্রেরণার মতো অধরা বিষয়গুলোকে পরিমাপে ব্যর্থ হয়েছে—এ বিষয়গুলো প্রকৃত যুদ্ধের সময় ইউনিটের কর্মী ও সরঞ্জাম ব্যবহারের যে ক্ষমতা তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।”

২০১৪ সালে এসেও আফগান বাহিনীতে বলার মতো কোন উন্নতি দেখা যায়নি। তাই ‘সিগার’ মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নজর সরানো হয় কমান্ড হেডকোয়ার্টারগুলোর দিকে।

আমি বিশ্বাস করি না যে, বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটিতে পশ্চিমা ধাঁচের সেনাবাহিনী তৈরি করা কোন বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ছিলো, তাছাড়া এসব দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি, উন্নত জাতিসত্ত্বার ধারণা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। দোষারোপের খেলা এখানে আসলে অকার্যকর।

 

ক্যারেন গ্রাহাম: পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক, ডিজিটাল জার্নাল

(মতামতটি ডিজিটাল জার্নালে প্রকাশিত হয় ১৫ আগস্ট ২০২১ তারিখে। সেখান থেকে “The Taliban didn’t take over Afghanistan — It was handed to them by the Afghans” শিরোনামের মতামতটি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন বিধান রিবেরু।)

 

Link copied!