• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : কবিতায় বিপ্লবী স্বর


সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
প্রকাশিত: জুন ২১, ২০২৩, ১০:৪৭ এএম
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : কবিতায় বিপ্লবী স্বর

কবিতায় বিপ্লব সবাই আনতে পারেন না। যদিও প্রেমই হচ্ছে বিপ্লবের পূর্বশর্ত। অন্তরে প্রেম না থাকলে বিদ্রোহও আসে না। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন তেমনই একজন, প্রেমিক এবং বিপ্লবী। কবিতায় তিনি প্রেমের আদলে তুলে এনেছেন বিপ্লব বা বিদ্রোহ। ভালোবাসার মানুষকেও করে তুলেছেন বিপ্লবী। প্রখর দুপুরে দীপ্ত মিছিলে শামিল হয়েছেন একসঙ্গে। প্রেমিকার হাত ধরে রাজপথে হেঁটেছেন, স্লোগান তুলেছেন। তাই বলা যায়, বাংলা কবিতায় বিপ্লবের ধারায় কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, দিনেশ দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পর তার মতো কণ্ঠস্বর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।  

এই বিপ্লবের সূচনা যেন তার কিশোর বেলায়। তিনি লিখলেন ‘আমি ঈশ্বর আমি শয়তান’। এটি তার প্রথম কবিতা। হতে পারে কাঁচা হাতের লেখা। তবে আবেগ আর উদ্দীপনায় ভরা। জীবনদর্শন ও চিন্তাধারার ধার সুস্পষ্ট। ১৯৭৩ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশ হয় কবিতাটি। কিন্তু রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এই কবিতায় তার নাম প্রকাশ করেননি। নিজের কোনো বইয়ে স্থানও দেননি। অন্য প্রায় সব কবির মতো তিনিও পরিণত পর্যায়ে এসে নিজের কাঁচা লেখাটিকে আড়ালে রাখতে চেয়েছেন। তবে রুদ্রর প্রথম কবিতা হিসেবে কবিতাটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ওই কবিতায় কবি বলছেন—

আমায় যদি তুমি বলো ঈশ্বর,
আমি বলব, হ্যাঁ আমি তাই।
আমায় যদি বলো পাপী শয়তান,
আমি বলব, হ্যাঁ আমি তাই-ই।

সুতরাং এই কবিতা গুরুত্বপূর্ণ তার বিপ্লবের ধরন জানতে। কারণ, তিনি তখন মাত্র দশম শ্রেণির ছাত্র। (এক যে ছিল রুদ্র: রুবায়েত আমিন)

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর আবির্ভাব সত্তরের দশকে। দশকীয় চিন্তার বাইরে কবির সময়কালকে জানানোর জন্যই সত্তর দশককে উল্লেখ করতে হলো। কেননা, কবির কাল কোনো বিষয় নয়। তো সেই সময়ে সমাজ ও রাজনীতির উত্থান-পতন, পাওয়া, না-পাওয়া, সৃষ্টি-ধ্বংস, আশা-আশাভঙ্গের অস্থিরতায় যারা কলম ধরেছিলেন, যারা সেই সময়কে উপলব্ধি ও সৃজনশীল উন্মাদনা দ্বারা এক চিরন্তন প্রতীতি দান করেছেন; তাদের মধ্যে অন্যতম কবি তিনি।

শৈশব থেকে বিপ্লবের শুরু হলেও ভাষার লাগাম তিনি ধরতে পেরেছিলেন। যথাযথ শব্দকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন বিপ্লবী চেতনার হাতুড়ি পেটানোর মতোই। যৌবনে এসে তাই লিখতে পেরেছিলেন ‘ইশতেহার’-এর মতো কবিতা। কবি লিখেছেন—

আমাদের নারীরা জমিনে শস্য ফলায়
আর আমাদের পুরুষেরা শিকার করে ঘাই হরিণ।
আমরা সবাই মিলে খাই আর পান করি।
জ্বলন্ত আগুনকে ঘিরে সবাই আমরা নাচি
আর প্রশংসা করি পৃথিবীর।
আমরা আমাদের বিস্ময় আর সুন্দরগুলোকে বন্দনা করি।
(ইশতেহার)

এ কবিতায় তিনি ধরতে চেয়েছেন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর পুরোটাই। মানবজাতির এক ধারাবাহিক অর্থনৈতিক বিকাশকে যেমনি তিনি এ কবিতায় ধরেছেন; তেমনই পুঁজিবাদের সংকট ও এর থেকে উত্তরণে নতুন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দিয়ে শেষ করেন তার অমর কবিতা। এ ধরনের কবিতা বাংলাদেশি সাহিত্যে এই প্রথম দেখলাম আমরা। ১১৯ লাইনের দীর্ঘ কবিতাটি সত্যিকার অর্থেই বাংলা কবিতার জগতে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তিনি। বাংলা সাহিত্যের সত্তর দশকে ‘মুকুটহীন সম্রাট’ ছিলেন। বিপ্লবী কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। সেই সময়ে তিনি দুই বাংলায় সমানভাবে জনপ্রিয় এবং শক্তিমান কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এমন কোনো আন্দোলন নেই, যেখানে কবির অংশগ্রহণ ছিল না। অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী কবিতা লিখেছেন। মুক্তমঞ্চে সেই প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি করে সাধারণ মানুষের ভেতরে প্রতিবাদী সত্তা জাগ্রত করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাই তাকে বাংলা কাব্য সাহিত্যের ‘প্রতিবাদী রোমান্টিক কবি’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৭ সালে তিনি লিখলেন—

এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
(বাতাসে লাশের গন্ধ)

একদিকে প্রেমিক, অন্যদিকে বিপ্লবী। তাই তো কবির ভীষণ এক খামখেয়ালির জীবন ছিল। মুক্ত স্বাধীন পাখির মতোই ডানা মেলে উড়তেন এখানে-সেখানে। ঘুরতেন পথে-ঘাটে, বনে-সমুদ্রে। এককথায় তিনি ছিলেন নিখাদ ভবঘুরে। পারিবারিক সচ্ছলতা ছিল; কিন্তু তিনি সে পথে যাননি। চাকরির প্রাতিষ্ঠানিকতায় নিজেকে বাঁধতে চাননি। তার কয়েকটা রিকশা ছিল, তা থেকে যা আয় হতো; তাতেই চলতেন অনায়াসে। এমনকি ঠিকাদারি করেছেন, নিজের গ্রামে চিংড়ির খামারও করেছেন। কিন্তু শৃঙ্খলহীন জীবনের কারণে সফলতা পাননি। পাঞ্জাবি আর জিন্স প্যান্টের যুগলবন্দি তখন বোধ হয় তিনি একাই ছিলেন। তার ছিল অতিমাত্রায় মদ্যপ্রীতি। প্রতি সন্ধ্যায় হাটখোলার নন্দের দোকানে হাজিরা দিতেই হতো। হুইস্কির বাংলাকরণ করেছিলেন ‘সোনালি শিশির’। এ নামে একটি গল্পও লিখেছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। এই গল্পের অন্যতম চরিত্র কিবরিয়া। গল্পে বলা হচ্ছে—‘বেশ কিছুদিন থেকে আমরা প্রায় প্রতিটি মদের ডাক নাম দিয়ে ফেলেছি। সোনালি শিশির হলো হুইস্কি। হানড্রেড পাইপার্স হলো বংশীবাদক। ব্ল্যাক ডগ—কালো কুত্তা। নেপোলিয়ন ব্র্যান্ডি—নেপো কাকা। জীন হলো পরী। আর বাংলা মদ হলো মাতৃভাষা।’ (সোনালি শিশির: রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচনাবলি-২, পৃ-৩৮৩) তার কয়েকটি গল্প হচ্ছে—ইতর, নিজস্ব লড়াই, শিরোনামহীন, নিঃসঙ্গতা প্রভৃতি।

কবি নিজেকে দাবি করতেন শব্দশ্রমিক হিসেবে। শব্দ নিয়েই তার যত খেলা। শব্দই তার বোমা ও বারুদ। শব্দই তার ফুল ও চকলেট। তাই তো কবি বলেছেন—

আমি সেই পোড়া ভিত ভেঙে জেগে উঠেছি জীবনে,
আমি সেই কালো ঘোড়ার লাগাম ধ’রে আছি টেনে।
বুকের ভাষাকে সাজিয়ে রণের সজ্জায়,
আমি বুনে দিই শব্দ-প্রেরণা মানুষের লোহু মজ্জায়।। 
(শব্দ-শ্রমিক)

ফলে তার বিষয় গণমুখী, ভাষা গতিশীল, চিত্রকল্প সহজবোধ্য, শব্দ বিচিত্রগামী। সেই হিসেবে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নিজেই পরিহার করেন তথাকথিত আধুনিকতার নাগপাশ। তিনি বলেন—

এখন কবিতা খাপখোলা তলোয়ার
এখন কবিতা মেদহীন ঋজু দেহ।
কবিতা এখন স্বপ্নের প্ররোচনা
কবিতা এখন বিশ্বাসী হাতিয়ার।।

শুধু তা-ই নয়, তার কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দ, উপমা, অলংকার পাঠান্তে ভিন্ন আবেশ এনে দিয়েছে। তিনি কবিতার পাশাপাশি গান, ছোটগল্প, কাব্যনাট্য ও চিত্রনাট্য লিখেছেন। উদ্ধার হয়েছে তার লেখা কিছু চিঠি। তবে কবি হিসেবেই তার ব্যাপক পরিচিত। স্বল্প আয়ুর জীবনে এক আকাশ ভালোবাসা রেখে গেছেন। তাই তো আমরা প্রতিনিয়ত আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখি। তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি—

ভালো আছি ভালো থেকো,
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।

এক আকাশ অভিমান নিয়ে ১৯৯১ সালের ২১ জুন আমাদের অকূল পাথারে ভাসিয়ে তিনি চলে গেছেন অজানার দেশে। কেননা, তার জীবন নিয়ন্ত্রিত ছিল না। নিজের ওপর যথেষ্ট অত্যাচার করতেন কবি। ফলে ধূমপান, মদ্যপান, খাবারে অনিয়মসহ সব মিলিয়ে দেখা দিয়েছিল পাকস্থলীর আলসার। পায়ের আঙুলে হয়েছিল বার্জার্স ডিজিজ। তিনি কখনোই এসবকে গুরুত্ব দেননি। অসুস্থতা নিয়ে ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যেতেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি নিয়মিত আসতেন নীলক্ষেত-বাবুপুরায় কবি অসীম সাহার ‘ইত্যাদি’তে। এ সময়টায় তিনি অনেক নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে তসলিমা নাসরিন লিখেছেন—কেউ তাকে সামান্য আশ্রয় দেয়নি। কেবল অসীম সাহা দিয়েছিল, নীলক্ষেতে তার টেবিলের বাঁ-পাশে রুদ্রকে একটা চেয়ার দিয়েছিল বসবার জন্য। রুদ্র সকাল, দুপুর, বিকেল ঐ একটি চেয়ারে নিমগ্ন বসে জীবন পার করতো।

কবিতার মতোই তার জীবনেও ছিল প্রেম এবং প্রতিবাদ। তার ভালোবাসা এখনো ভুলতে পারেননি তসলিমা নাসরিন। তার কবিতাও ভুলতে পারেননি প্রিয় পাঠক। বরং দিন দিন তার কবিতার প্রতি মোহ আরও বাড়ছে। ছড়িয়ে পড়ছে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা। বর্ণিল জীবনের আভায় আলোকিত হচ্ছে বাংলা সাহিত্য। প্রেমে কিংবা সংগ্রামে তার কবিতাই হয়ে উঠছে একমাত্র হাতিয়ার।

লেখক : কথাশিল্পী ও গণমাধ্যমকর্মী।

Link copied!