বৌদ্ধপূর্ণিমা: মানবতা, শান্তি ও আত্মশুদ্ধির মহামিলন


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: মে ১১, ২০২৫, ০২:৫০ পিএম
বৌদ্ধপূর্ণিমা: মানবতা, শান্তি ও আত্মশুদ্ধির মহামিলন
ছবি: সংগৃহীত

বৌদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এটি গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বোধিপ্রাপ্তি (জ্ঞানলাভ) এবং মহাপরিনির্বাণ—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মরণে পালিত হয়। বিশ্বের প্রায় সব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশেই এই দিনটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবে উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশেও বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ঢাকা শহরের কিছু অঞ্চলে এটি অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়।

বৌদ্ধ ধর্মমতে, গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল লুম্বিনিতে (বর্তমানে নেপালে), বোধিপ্রাপ্তি হয়েছিল বোধগয়ায় (ভারতের বিহার রাজ্যে) এবং মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন কুশীনগরে (ভারত)। এই তিনটি ঘটনাই ঘটেছিল বৈশাখী পূর্ণিমায়। ফলে বৌদ্ধপূর্ণিমা শুধু বুদ্ধজন্মদিবসই নয়, বরং এটি বুদ্ধের জীবনের তিনটি মহান ঘটনার স্মৃতিবাহী দিন।এই কারণেই দিনটি পুণ্যতিথি হিসেবে পালন করা হয়।

বৌদ্ধপূর্ণিমা পালনের আগের দিন থেকেই বৌদ্ধ পরিবার ও সমাজে বিশেষ প্রস্তুতি শুরু হয়। ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা হয়। বৌদ্ধ বিহার ও ধর্মচর্চাকেন্দ্রগুলোতে সাজসজ্জা শুরু হয়। অনেকে উপবাস থাকেন বা নিরামিষ আহার করেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য পিন্ডদান বা দান দেওয়ার আয়োজন করা হয়।

দিনের শুরুতেই বৌদ্ধ বিহারে ধ্বনি তোলে ঘণ্টা ও ঢোলের। ভক্তরা ভোরে বুদ্ধমূর্তির সামনে ধূপ জ্বালান, ফুল দেন এবং প্রার্থনায় অংশ নেন।
“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধম্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি”—এই মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। বুদ্ধের জীবনের ঘটনা স্মরণ করে ধর্মোপদেশ পাঠ করা হয়।

এদিন বৌদ্ধরা দান ও পুণ্য অর্জনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। ভিক্ষুদের খাবার, বস্ত্র, ওষুধ বা অর্থ দান করা হয়। দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ ও সেবা দেওয়া হয়। কেউ কেউ পুরো দিন নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন এবং উপবাস পালন করেন।

অনেক ভক্ত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছ থেকে "পঞ্চশীল" (পাঁচটি নৈতিক শপথ) গ্রহণ করেন, যেমন- হত্যা করা থেকে বিরত থাকা, চুরি না করা, অসততা ও মিথ্যাচার না করা, মাদকাসক্তি থেকে বিরত থাকা, কামপ্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ। এই শপথ বুদ্ধের আদর্শ অনুসরণ করার অঙ্গীকার হিসেবেই ধরা হয়।

বৌদ্ধপূর্ণিমার রাতে আলোকসজ্জা ও প্রদীপ প্রজ্বালন একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। বুদ্ধের প্রতিকৃতিতে প্রদীপ দেওয়া হয়, যা অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের প্রতীক। বিহারে ও বাড়ির সামনে মোমবাতি ও ফানুশ জ্বালানো হয়। অনেক জায়গায় 'আকাশ প্রদীপ' উড়ানো হয়, যা আত্মশুদ্ধির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

বিভিন্ন বিহারে ও বৌদ্ধ সমিতির আয়োজনে ধর্মীয় আলোচনা, বুদ্ধগাথা পাঠ এবং বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। এতে বুদ্ধের জীবন, শিক্ষা ও দর্শন নিয়ে আলোচনা হয়। যুবক-যুবতীরা নাটক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বুদ্ধের জীবনচরিত উপস্থাপন করে।

এই দিনে বৌদ্ধরা শুধু নিজের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য শান্তি ও মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করেন।যুদ্ধ, দারিদ্র্য, রোগ ও বিদ্বেষ থেকে মুক্তির জন্য মঙ্গল কামনা করা হয়। বিভিন্ন স্থানে বিশেষ “বিশ্বশান্তি প্রার্থনা সভা” অনুষ্ঠিত হয়।

বৌদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে ছোটদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষা বিতরণ করা হয়। বুদ্ধের নীতিবাক্য, চরিত্র গঠন ও করুণাবোধ শেখানো হয়। প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, গান ও নৃত্য পরিবেশিত হয়।

বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবানসহ পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক আয়োজন দেখা যায়। জাতীয় বৌদ্ধ মহাসভা ও অন্যান্য সংগঠন দিনটি উপলক্ষে র‌্যালি, আলোচনাসভা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। রঙিন পোশাক পরা, মুখে হাসি আর অন্তরে পুণ্যসাধনার একটি দিন হয়ে ওঠে বৌদ্ধপূর্ণিমা।

বৌদ্ধপূর্ণিমা মানবতার, শান্তির ও আত্মশুদ্ধির এক মহামিলন। বুদ্ধের অহিংসা, মধ্যমপন্থা ও করুণার বাণী এই দিনে নতুনভাবে অনুরণিত হয়। এই দিনটি মানুষকে আত্মজিজ্ঞাসা ও মহত্ত্বের পথে চলার আহ্বান জানায়।

Link copied!