ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক। সম্প্রতি ‘নিঃসঙ্গতা থেকে আত্মহত্যা’ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেওয়ান জামিলুর রহমান।
সংবাদ প্রকাশ: মানসিক স্বাস্থ্য বলতে আমরা মূলত কী বুঝি?
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ: মানসিক স্বাস্থ্য হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাস্থ্যের সর্বজনীন যে সংজ্ঞা রয়েছে, তাতে বলা হয়েছে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবেই ভালো থাকার নামই স্বাস্থ্য। অথচ আমরা স্বাস্থ্য বলতে শুধু শরীরটাকে বুঝি, মনটাকে গুরুত্ব দিই না। মানসিক স্বাস্থ্য এবং তার যত্ন নিয়ে আমাদের সচেতনতা কম। আমরা যেভাবে চুলের যত্ন নিই, মুখের যত্ন নিই, দাঁতের যত্ন নিই, ঠিক একইভাবে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া উচিত। আমাদের মনের স্বাস্থ্য, আমাদের আবেগের স্বাস্থ্য, আমাদের চিন্তন প্রক্রিয়া ও বুদ্ধিমত্তার স্বাস্থ্যই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য।
সংবাদ প্রকাশ: মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নিঃসঙ্গতা কতটা প্রভাব ফেলে?
হেলাল উদ্দিন আহমেদ: মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব মানেই আশপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়েই তার জীবন। গাছপালা, পশুপাখি, এটা তার পরিবেশ। আর আশপাশের মানুষজন-বন্ধুবান্ধব তার প্রতিবেশ। এই দুটি বিষয় থেকে যখন মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখনই সে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। আমরা অনেক সময় নিঃসঙ্গতাকে ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করি। একা থাকা মানেই কিন্তু নিঃসঙ্গতা না। আমরা এই চারপাশের অবস্থা অর্থাৎ পরিবেশ ও প্রতিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাটাই হচ্ছে নিঃসঙ্গতা। মানুষ বহুজনের মধ্যে থেকেও নিঃসঙ্গ হতে পারে, বিরহেও নিঃসঙ্গ থাকতে পারে অর্থাৎ নিঃসঙ্গতা হচ্ছে তার বোধের ব্যাপার। মানুষ যখন সমাজ থেকে নিজেকে আলাদা মনে করে, নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় মনে করে, যখন মনে করে চারপাশের সবকিছুর সঙ্গে তার সংযোগের বিচ্যুতি ঘটেছে, তখনই মানুষ নিঃসঙ্গ বোধ করে। এবং নিঃসঙ্গতা মানুষকে হতাশায় ফেলে দেয় আর হতাশা মানুষকে বিষণ্নতায় ফেলে দেয়। আর এ বিষণ্নতা আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান একটি কারণ হিসেবে বিজ্ঞান চিহ্নিত করেছে। ফলে নিঃসঙ্গতা আবশ্যই মানসিক সংকটের একটি প্রধান কারণ। মানসিক এই সংকট থেকে বিষণ্নতা হতে পারে। ফলে আত্মহত্যার মতো দুঃখজনক পরিণতির দিকে আমরা চলে যেতে পারি।
সংবাদ প্রকাশ: একাকী বসবাস করাটা কি আমাদের নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিতে পারে?
হেলাল উদ্দিন আহমেদ: আমি একা বসবাস করছি মানেই আমি নিঃসঙ্গ, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। আমি একা বসবাস করেও কিন্তু সামাজিকভাবে দক্ষ হতে পারি। সমাজের সঙ্গে আমার একটি সংযোগ রয়েছে, আমার আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। আমি সমাজের একজন, এটা আমি বিশ্বাস করি এবং সমাজকে ভালোবাসি। সমাজের ভেতরে থাকতে পেরে আমি নিজেকে সমাজের অংশ মনে করি। তখন কিন্তু আমি নিঃসঙ্গ নই। সুতরাং একজন মানুষ একা বসবাস করছেন মানেই তিনি নিঃসঙ্গ, এটা একটা ভুল সংজ্ঞা। মানুষ নিঃসঙ্গতাকে বোধ করছেন কি না, একাকিত্ববোধে ভুগছেন কি না, সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্যুত মনে করছেন কি না, সেটাই হচ্ছে তার নিঃসঙ্গতা। সুতরাং নিঃসঙ্গতা মানে একা বসবাস করা নয়। নিঃসঙ্গতা অর্থ চারপাশ থেকে নিজেকে বিচ্যুত করে রাখা।
সংবাদ প্রকাশ: বয়সভেদে একাকিত্বে ভোগার কোনো যোগসূত্র আছে কি না?
হেলাল উদ্দিন আহমেদ: যখন মানুষের বয়স হয়ে যায়, তখন সংগত কারণে অনেক সময় মানুষকে একা বসবাস করতে হয়। তার সন্তানরা কাজের তাগিদে বাইরে থাকেন আবার তিনি নিজেও অবসর সময় কাটান। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি খানিকটা একা হয়ে যান। সেই জায়গা থেকে তার মনে হয় সমাজের কাছে তার মূল্য কমে গেছে। বয়সজনিত কারণে মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে বয়স্কদের আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি। একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মোট আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল ৪৭ হাজার। এর ভেতরে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মানুষের বয়স ছিল ৬৫-এর ওপরে এবং ১৪ হাজার মানুষের বয়স ছিল ৬০-এর ওপরে। এই পরিসংখ্যান কিন্তু অ্যালার্মিং একটি বিষয়। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অল্পবয়সী যারা আছেন, তাদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১ জন সফল হয় আত্মহত্যা করতে। বাকি ৯৯ জন আত্মহত্যায় সফল হয় না। অন্যদিকে বয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রতি চার থেকে ছয়জনের মধ্যে একজন আত্মহত্যায় সফল হয়। ফলে বয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে সফল হওয়ার হার কিন্তু অনেক বেশি।
সংবাদ প্রকাশ: বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণগুলো মূলত কী?
হেলাল উদ্দিন আহমেদ: পশ্চিমা দেশের তুলনায় আমাদের দেশে গড় হিসাবে আত্মহত্যার হার কম। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার কম। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি। এবং বাংলাদেশ নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। যার অন্যতম কারণ যৌতুক, পারিবারিক জটিলতায়, সম্পর্কের অবনতি, পরীক্ষায় ব্যর্থতা এবং বিভিন্ন আর্থিক অনটন। অন্য একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা। এটিও আত্মহত্যার হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত হয়েছে।