• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

আমি যেভাবে ভেবেছি, সেভাবে আর কেউ ভাবেনি : সমরেশ মজুমদার


রনি অধিকারী
প্রকাশিত: মে ১০, ২০২৩, ০৬:৩৯ পিএম
আমি যেভাবে ভেবেছি, সেভাবে আর কেউ ভাবেনি : সমরেশ মজুমদার

কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ। তাঁর শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের কয়েরকাটা চা-বাগানে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় জলপাইগুড়ি জিলা স্কুল থেকে। তিনি বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে তিনি আনন্দবাজার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর প্রচণ্ড আসক্তি ছিল। তাঁর প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখাই হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে, আর সেখান থেকেই তাঁর লেখকজীবনের শুরু। তাঁর লেখা অন্যমাত্রা ছাপা হয়েছিল দেশ পত্রিকায় ১৯৬৭ সালে। সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয়েছিল দেশেই ১৯৭৬ সালে। তিনি শুধু তার লেখনী গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি থেকে গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাস লেখনীতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর ট্রিলজি উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁকে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী করেছে। অনেক অসাধারণ লেখনীর শব্দের এই রূপকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে সত্য আকাদেমী পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইয়াইএমএস পুরস্কার জয় করেছেন। চিত্রনাট্য লেখক হিসেবে জয় করেছেন বিএফজেএ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির এওয়ার্ড। সমরেশ কলকাতা ও বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা লেখক হিসেবে পাঠকমন জয় করেছেন। ৮ মে, ২০২৩ তিনি প্রয়াত হন। কথাসাহিত্যিক সমরেশের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কবি ও সাংবাদিক রনি অধিকারী


রনি অধিকারী : আপনার শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে জানতে চাই। আপনার ছোটবেলার গল্প বলুন।

সমরেশ মজুমদার : জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সের চা-বাগানে আমি জন্মেছিলাম। সেই চা-বাগানের বাড়ির পিছে সরু রাস্তা ছিল। তার নাম ছিল আসাম রোড। ওই রাস্তাটা আসামে গিয়েছিল। দুই পাশে জঙ্গল আর বড় বড় ইউক্যালিপটাস গাছ, শাল, সেগুনের গাছ। সারা দিন পাখি ডাকত। দু-একটা গাড়ি যেত। একবার যখন, বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। কোনো গাছ নেই। সব গাছ কেটে বাদ দিয়েছে। ওই সরু রাস্তা এখন এইট লেনের রাস্তা হয়েছে যেটাকে বলছে এশিয়ান হাইওয়ে। গাছগুলো নেই, পাখিগুলোও নেই। আজ আমিও ওখানে নেই। আমি আট-দশ বছর বয়সে ফুটবল খেলতাম। ফুটবল অনেক সময় পেতাম না। জাম্বুুরা দিয়ে ফুটবল খেলতাম। জাম্বুুরাকে আমরা বাতাবিলেবু বলতাম। সেই ফুটবল খেলার মাঠে দু-একজন দর্শক থাকত। তার মধ্যে একটি মেয়ে, মেয়েটির বয়স হয়তো সাত কি ছয়, তার পিঠে তার বাচ্চা ভাই কাপড়ে বাঁধা থাকত। তার মাথার ওপরে আব ছিল। মানে উঁচু একটা মাংসপিণ্ড। সে ছিল মদেসিয়া শ্রেণির শ্রমিকের মেয়ে। তার বাবা চা-বাগানে কাজ করত। আমরা তার সঙ্গে কথা বলতাম না। আমরা তখন ওর চেয়ে অনেক উচ্চ শ্রেণিতে ছিলাম আরকি। শুধু জানতাম ওই মেয়েটির নাম এতোয়ারি। উত্তরাধিকারেও কিন্তু এতোয়ারির কথা আছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর পার হয়েছে। আমি এত দিন এতোয়ারিকে দেখিনি। একবার আমি চা-বাগানে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধুরা ছিল, আড্ডা মারছি। আমি এই গল্পটাই বললাম, এতোয়ারির গল্প। সঙ্গে সঙ্গে সেই বাড়ির যে মহিলা তিনি বললেন, আপনি এতোয়ারির সঙ্গে দেখা করবেন? আমি বললাম, সে বেঁচে আছে? কী অদ্ভুত!
অদ্ভুত আরও একটি ব্যাপার ছিল। এতোয়ারিকে আনা হলো। প্রৌঢ়া একজন মহিলা এলেন। দেখলাম তার মাথায় আব নেই। অপারেট করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করছে মহিলা, কেমন আছিস? বলল, ভালো আছি। এই মানুষটাকে চিনতে পারছিস? আমার দিকে তাকাল, তাকিয়ে বলল, ও তো বাবলু। বাবলু আমার ডাক নাম। পঞ্চাশ বছর পর একজন প্রৌঢ়া আমাকে বলছে আমার নাম বাবলু। আমি একটু মজা করার জন্য বললাম, তোর বাবা হাঁড়িয়া খেত, মনে আছে? হাঁড়িয়া হচ্ছে দেশি মদ। সে বলে, তুই খাস? আমি বললাম, আমায় খাওয়াবি? আমার দিকে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। বলল, তুই হাঁড়িয়া খাস? পঞ্চাশ বছর আগে আমরা কোনো কথা বলতাম না। আমি বললাম, ঠিক আছে তোর বাড়িতে চল, আমাকে চা খাওয়াবি। বলে, নাহ। আমি বলি, কেন? বলে, আমার বদনাম হবে। ও চলে গেল। কিন্তু শুনে গেল আমি বিকেলবেলা ফিরে যাব। ফেরার সময় যখন গাড়িতে উঠছি, দেখলাম ও দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা বোতল, বোতলে হাঁড়িয়া।

রনি অধিকারী : উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ উপন্যাসে একটা চরিত্রের সঙ্গে আরেকটা চরিত্রের মিল খুঁজে পাই। এবং আপনার জীবনেরও অনেক মিল। কেন?

সমরেশ মজুমদার : হ্যাঁ, একটাই উপন্যাসের সঙ্গে মিল আছে। ওই উপন্যাসের মূল চরিত্র শহর থেকে দূরে চলে গিয়েছিল সমুদ্রের ধারে এক বাংলো কিনে। একা থাকতেন। তার কাছে একটি মেয়ে এলো। আশ্রয় মানে একটা রাতের আশ্রয়, পরদিন চলে যাবে। ওখানে কোনো হোটেল নেই। ভদ্রলোক মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার নাম কী। মেয়েটি বলেছিল আমি যে নামই বলব, আপনি সেটাকেই বিশ্বাস করবেন। আপনার না মেনে কোনো উপায় নেই। প্রশ্ন করা হয়েছিল, তোমার ঠিকানা কী? বলেছিল উত্তরে, আমি যা বলব তাই আপনি বিশ্বাস করবেন। আমাকে জায়গা দিন। আমার অতীতটাকে নিয়ে কেন টানছেন? এ ছাড়া যারা বলে অনিমেষের সঙ্গে আমার মিল আছে, বলতে পারেন অনিমেষের ভাবনার সঙ্গে আমার মিল আছে। অনিমেষের জীবনযাপনের সঙ্গে কোনো মিল নেই।

রনি অধিকারী : ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাস নিয়ে আপনার জীবনে রাজনৈতিক একটা অস্থিরতা ছিল। সেই গল্প বলুন।

সমরেশ মজুমদার : সেটা ছিল ১৯৭৯—৮৪ সময়কাল। তখন বাম ফ্রন্ট সরকার প্রচুর ক্ষমতাধর। তীব্র মেজরিটিতে তারা আছেন। সেই সময় আমি যখন লিখলাম যে সিপিএম নকশাল আন্দোলনের পেছনে ছুরি মেরেছে। লেখাটা কিন্তু বেরোল আনন্দবাজারে, দেশ পত্রিকায়। লক্ষ লোক এই পত্রিকা পড়ে। এই লেখাটা লেখার সময় কিন্তু ভয় আসেনি মনের মধ্যে যে এটা লেখার পরের দিন আমাকে কেউ মারতে আসবে বা সরকার আমাকে জেলে পুরবে। উত্তরাধিকার বেরিয়েছে। যেখানে অনিমেষ জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় এসেছে। আন্দোলন দেখছে, আন্দোলনে নামেনি। বইমেলাতে উপ-মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি সম্পর্কে আমার বন্ধুর ভাই এবং একসময় আমাকে খুব দাদা দাদা বলত, অনেক দিন সম্পর্ক নেই। দেখামাত্রই সে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি উত্তরাধিকার লিখেছেন, এটা কমিউনিস্ট পার্টির দলিল। আপনি আপনার প্রকাশককে বলুন এটার একটা বিজ্ঞাপন দিতে। আমি পঞ্চাশ হাজার কপি সরকারের কাছ থেকে কিনব। তখন বইটা বিক্রি হয়েছে মাত্র পাঁচ শ কপি। আমি নতুন লেখক। আমি দৌড়ে দৌড়ে প্রকাশকের কাছে গিয়ে বললাম আপনি এটার বিজ্ঞাপন দিন। তখন প্রতি কপি বইয়ের দাম ছিল পঞ্চাশ টাকা বা চল্লিশ টাকা দাম। আমি একটা বই বিক্রি করলে আট টাকা পাই। পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি হলে চার লাখ টাকা পাব, ভাবা যায় না! উনি আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। উনি খুব প্রবীণ লেখকও ছিলেন, গজেন্দ্র কুমার মিত্র। উনি আমাকে বললেন, তুমি কি চাও এই পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি হয়েই বইটা শেষ হয়ে যাক? মানে? যেই আমি বলব, কমিউনিস্ট পার্টির দলিল তাতে যারা কমিউনিস্ট পার্টিকে পছন্দ করে না তারা এই বইটা পড়বে না, যারা সাহিত্য পছন্দ করে তারা ভাববে ম্যানিফেস্টো, পড়বে না। তুমি চাও তাই? মানে, পঞ্চাশ হাজার কপির বেশি তোমার বই বিক্রি হবে। আপনি কী বলছেন। তিনি হাসলেন। কী চাও? আমার হঠাৎ মনে হলো এই লোকটা আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আমি বললাম, থাক তাহলে। বিজ্ঞাপনটা আর বের করিনি। আজকে এই বইটার এক লাখের বেশি বিক্রি হয়েছে। গজেন্দ্র কুমার মিত্রের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি ছিল।  

কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারগ্রহীতা

রনি অধিকারী : ‘কালবেলা’ লেখার পেছনের অভিজ্ঞতা আমাদের বলুন।

সমরেশ মজুমদার : উত্তরাধিকার শেষ করলাম; আমি আর লিখতে পারছিলাম না। কারণ, এত বড় উপন্যাস লেখার আমার অভ্যাস ছিল না। একটা গল্প বানাবার ক্ষমতা ছিল না। উত্তরাধিকারের শেষে ছিল অনিমেষের পায়ে গুলি লেগেছে। সে মাটিতে পড়ে গেছে। এখানেই শেষ ছিল। পাঠকরা ভাবলেন যেহেতু আনন্দবাজার পত্রিকার কাগজ এবং তারা বুর্জোয়াদের দালাল তারা আমার লেখা বন্ধ করেছে। হাজার হাজার চিঠি আসতে লাগল, অভিযোগের পর অভিযোগ। সাত দিনের মাথায় সম্পাদক আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন তুমি এটা কী করলে? আমি তোমাকে বলেছি বন্ধ করতে? বন্ধ করলে কেন? তুমি আবার লেখ। ওই আবার লিখতে বলার কারণে কালবেলা লিখলাম।

রনি অধিকারী : কালবেলা, কালপুরুষ ও গর্ভধারিণী এই ট্রিওলজি একসময় ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। 

সমরেশ মজুমদার : ‘দৌড়’ লেখার পেছনে কোনো মজার অভিজ্ঞতা...একদিন দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ ডেকে বললেন, অনেক তো ওয়ানডে ম্যাচ খেললে এবার টেস্ট ম্যাচ খেল। মানে এবার তুমি একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লেখ। আমি আঁতকে উঠলাম। ‘দৌড়’ উপন্যাস লিখতে গিয়ে আমি দম হারিয়ে ফেলেছি। মনে হয়েছিল আমি আর লিখতে পারব না। লিখতে গিয়ে গল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে, এগোচ্ছে না। আসলে আমি ওই সময় অব্দি ছোটগল্প লিখতে অভ্যস্ত ছিলাম। ধারাবাহিক উপন্যাস সপ্তাহের পর সপ্তাহ লিখব, এটা অসম্ভব মনে হলো। মনে হলো আমার কাছে এত গল্প নেই। উনি বললেন, কেন পারবে না? নিজেকে নিয়েই লেখ। ওই যে কথা, তারপর ভেবেছি। আমি যেভাবে ভেবেছি, সেভাবে আর কেউ ভাবেনি। আমি যা দেখেছি, সেটা অন্য কেউ দেখেনি। তখন আমি আমার ভাবনাগুলো লিখতে শুরু করলাম। লেখাটা আমার আত্মজীবনী হয়নি। এতে আমার দেখা, অদেখা-জীবন আর মানুষ সম্পর্কে ধারণার জন্ম নিয়েছিল।

রনি অধিকারী : চলচ্চিত্রে একজন ঔপন্যাসিকের মূল গল্পের প্রতি কীভাবে অবিচার করা হয়?

সমরেশ মজুমদার : যেমন পথের পাঁচালী অলটাইম গ্রেট ফিল্ম। সত্যজিৎ রায়ের এটা একটা অনবদ্য ক্রিয়েশন। কিন্তু কেউ কেউ অখুশি। তার কারণ পথের পাঁচালীতে দুর্গা কখনো ট্রেন দেখেনি। ট্রেন দেখার আর্তি ছিল তার। ভাইকে বলত, অপু, আমাকে ট্রেন দেখাবি? দেখা হয়নি। একটা অতৃপ্তি নিয়ে সে চলে গেছে। পথের পাঁচালী ছবিতে সত্যজিৎ বাবু কিন্তু ট্রেন দেখালেন। দুই ভাইবোন দৌড়ে দৌড়ে কাশবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, দূরে ট্রেন। যারা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তারা এতে আপত্তি করেছে। উপন্যাসে যা নেই, তা কেন ছবিতে দেখানো হবে? আমি মনে করি দুটি আলাদা মিডিয়া। উপন্যাস আলাদা, ছবিও আলাদা।

রনি অধিকারী : আপনি আপনার তখনকার সেই সময়কে আর জীবনকে কীভাবে দেখেছেন?

সমরেশ মজুমদার : আমি সেই জীবনযাপন করিনি, তবে দেখেছি। কিন্তু আমার বন্ধুরা যারা এই জীবন-যাপন করেছে, তারা খুব দমন-পীড়নের মধ্যে ছিল। কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, কেউ জেল খেটেছে, কেউ আত্মগোপন করেছে দীর্ঘদিন। আবার জীবনে প্রেম ব্যাপারটা সিরিয়াস একটা ব্যাপার ছিল। যে সব বন্ধু আন্দোলন-সংগ্রাম করছে, তারা প্রেম করতে চাইত না। কারণ তারা জানত, প্রেম মানে পেছনে টানা। প্রেম মানে ঘরের বাঁধন। ফলে তারা এটাকে এড়িয়ে চলত। আর সে সময় প্রেম করা অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। হাতে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটা সহজ ছিল না। চুম্বন-টুম্বন তো ভাবাই যায় না। এ রকম একটা পরিস্থিতি ছিল! এই যে পরিস্থিতি ছিল তার মধ্যে কালবেলা শেষ করলাম।

রনি অধিকারী : আপনার উপন্যাসে মাওবাদী বা নকশালের কথা আছে। এটা কি আপনার জীবনের কঠিন বাস্তবতার অংশ?

সমরেশ মজুমদার : আমি অনেকটা অন্ধের মতো হস্তি দর্শন করেছি। কেউ বলছেন, শুঁড়টাই হাতি। কেউ বলছেন, লেজটাই হাতি। কেউ বলছেন, কানটাই হাতি। কেউ বলছেন, পা-টাই হাতি। কেউ বলছেন, পেটটাই হাতি। কিন্তু সমগ্র হাতির কথা কেউ বলেন না। এমনিভাবে যখন দেখছি, কারও সঙ্গে কারও মিলছে না, তখন কথার গড়মিল শুনে ধন্দ্বে পড়েছি। আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি চোখে যা দেখেছি, সেটাই লিখেছি। আমি যা শুনেছি সেটাই লিখেছি। আমি যা দেখেছি, সেটাও সাধারণ মানুষ দেখেছে। আমি যেটা শুনেছি, সেটাও সাধারণ মানুষ শুনেছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমি কখনো দ্বিমত করতে পেরেছি? যেমন ধরুন, আন্দোলনের সময় আমাদের পাশের বাসায় দুটো ছেলে এসেছে। ওরা বলছে, ‘মাসি মা, খুব খিদা পেয়েছে। রাতের বেলায় আমাদের কুড়িটা রুটি দেবেন? মহিলা বললেন, হ্যাঁ বাবা নিয়ে যাস।’ তখন নকশাল আন্দোলনের শুরু। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের একটা সমর্থন ছিল। সাধারণ মানুষ ভেবেছে, এই সব দামাল ছেলেরা দেশ আর মানুষের পরিবর্তন বয়ে আনবে। কিন্তু যেই এরা পুলিশকে মারতে আরম্ভ করল, যেই এরা গ্রামের মানুষ খুন করতে লাগল, যেই এরা বিদ্যাসাগরসহ নানাজনের মূর্তি ভাঙতে শুরু করল, অমনি জনসমর্থন কমতে শুরু করল। সাধারণ মানুষ বিমুখ হয়ে উঠল। মানুষ ভয় পেয়ে ওদের দেখে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এটা কি তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করেছে নাকি অন্য কোনো শক্তি তাদের মধ্যে লোক ঢুকিয়ে দিয়ে ইন্ধন জুগিয়েছিল সে সময়, সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু মূল কথা, যে মানুষ সমর্থন জুগিয়েছিল, পরে সেই মানুষই তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।

রনি অধিকারী : আপনি রাজনৈতিক দর্শন দিয়ে ‘অনিমেষে’কে কীভাবে মূূূল্যায়ন করবেন?

সমরেশ মজুমদার : অনিমেষের ভুল ভাঙল একসময়। যেটা করেছে সেটার জন্য দেশ তৈরি ছিল না। আন্দোলনের সময় যে বন্দুক নিয়ে লড়াই করতে যাচ্ছে, জানি না সে বন্দুকের ভেতর গুলি ছিল কি না। এমন একটা পরিবর্তনের জন্য দেশ তৈরি নয়, মানুষ তৈরি নয়। আমাদের মধ্যে কয়েকজনের ভেতরে যে আগুন আসছে সেটা সারাদেশে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারব না। এই ভ্রান্তিটা তো, একসময় ভাঙল। তবে কেউ কেউ সেই মতাদর্শে থেকে গেলেন। অনেকে অনেক সাফার করেছেন। অনেক নকশাল নেতা পরে সিপিএমের বড় বড় নেতা হয়েছেন।

রনি অধিকারী : বাংলা ভাষার মধ্যে বিদেশি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আপনি কিছু বলুন।

সমরেশ মজুমদার : এটা নিয়ে কোনো আন্দোলন হয়নি বলে। এটার উন্নয়ন করার ভাবনার কথা কেউ ভাবেনি বলে। অবশ্য আমরা একমত হয়েছি। ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করি। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানগুলো গাই, ১৯৫২ সালে যে শহীদরা প্রাণ দিয়েছিলেন, তারা কেন প্রাণ দিয়েছিল, ভাষাকে বাঁচাবার জন্য। একটা সম্মান রাখার জন্য জীবন দিয়েছিল। উর্দুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আমরা সারা বছর ধরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন কিন্তু এটা নিয়ে ভাবিই না। আমরা একটা দিন ভাবি, যেটা ২১ ফেব্রুয়ারি। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের বেলায় ভাবি। তাহলে, আমরা ভাষা নিয়ে ভাবছি না। এই ভাবছি না বলে আমাদের এই বাংলা ভাষায় অদ্ভুত অরাজকতা; অর্থাৎ আগাছা ঢুকে গেছে। কেন এই ভাষায় এতো উর্দু-আরবি-ফারসি ঢুকল? যে উর্দুর জন্য ৫২ সালে মানুষ আত্মত্যাগ করলেন, সেই উর্দু শব্দ কেন বাংলাদেশের ভাষায় ঢুকল, বাংলা ভাষায় ঢুকল। এটা নিয়ে কেউ ভাবেননি, কোনো কথা বলেননি। আমার একটা প্রস্তাব ছিল, একটা কমিটি তৈরি করে বাংলা ভাষার একটা স্ট্যান্ডার্ড চেহারা দেওয়া হোক। এটা আগের চেয়ে ডেভেলপড এবং আগাছাগুলোকে ঝেড়ে ফেলা হোক।

রনি অধিকারী : ‘আঞ্চলিক ভাষা’ নিয়ে আপনার মতামত কী?

সমরেশ মজুমদার : ‘ইমদাদুল হক মিলন’ যে বাংলা লেখেন, হুমায়ূন সে বাংলা লেখেন না। সুনীল, শীর্ষেন্দু যে বাংলা লেখেন, সে বাংলায় কিন্তু হুমায়ূন লেখেন না। আবার হক সাহেব যে বাংলা লেখেন, সে বাংলা কিন্তু আমাদের অনেকেই লেখে না। এটা কেন হচ্ছে? একটা ঠিকঠাক বাংলা তৈরি হচ্ছে না। আমি আঞ্চলিক ভাষার কথা বলছি না। আঞ্চলিক ভাষায় মানুষ তো কথা বলবেই, কেননা এটা তার মায়ের ভাষা। আঞ্চলিক বাংলা যদি তার মায়ের ভাষা হয়, তাহলে বাংলা কি তার বাবার ভাষা? আমি বলি, একটা হচ্ছে ঘরের ভাষা, আর একটা কাজের ভাষা। ঘরের ভাষায় একজন, সে নিজের মায়ের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে।

রনি অধিকারী : আপনার সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে কার লেখা আপনার ভালো লাগে?

সমরেশ মজুমদার : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা খুবই ভালো লাগে। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ লেখা, আত্মস্থ লেখা। আর এপার বাংলায় আমার বয়ঃকনিষ্ঠ কিন্তু আমার অত্যন্ত বন্ধু ছিল হুমায়ূন আহমেদ। যদিও ও খুব মজা করে বলত, সমরেশদা যারা ষোলো বছর বয়সে হুমায়ূন পড়ে না, সে বাঙালি না। আর যে চব্বিশের পর হুমায়ূন পড়ে, সে বাঙালি না। খুব মজা করে বলত, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম না। কেননা, ওর অনেক লেখার মধ্যে এত বেশি আবেগ থাকত, আমার খুব ভালো লাগত। তারপরে মিলনের কিছু লেখা আমার ভীষণ রকম ভালো লাগে, শামসুল হক সাহেবের লেখা ভালো লাগে। কিন্তু কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে। হুমায়ূন যেভাবে পাঠক পেয়েছিলেন, পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন এবং হুমায়ূন চলে যাওয়ার পরও সেই জনপ্রিয়তা একটুও কমেছে বলে আমার মনে হয় না।

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!