স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে আমরা একটি অবিশ্বাস্য অন্ধকার গহ্বরের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। ১৯৭১ সালে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, তাদের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের যে চিত্রকল্প ছিল, তা শুধু পাকিস্তানি শাসন-শোষণের অবসান এবং সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর খেয়েপরে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামই ছিল না। আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মবর্ণ জাতিগোষ্ঠী পরিচয়ের বিভেদহীন ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলাম।
আমরা দেখেছি সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে যুদ্ধের ৯ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদর ইসলামের নামে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ যেসব অপকর্ম করেছে তার সিংহভাগের শিকার হয়েছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এখন আবার একই কায়দায় ইসলামের ঝাণ্ডা সামনে রেখে শুরু হয়েছে নিপীড়ন, নির্যাতন, জমি দখল, সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড। আমরা ইসলামের লেবাসধারীদের সীমাহীন আশকারা দিয়ে পুরো দেশটিকে মনে হয় এখন মূর্খ-অবিবেচক-ধর্মান্ধদের হাতে তুলে দিয়েছি।
আজ তারা অপ্রতিরোধ্য গতিতে দেশজুড়ে যে তাণ্ডব শুরু করেছে, তা সামাল দেওয়ার মতো ক্ষমতা প্রশাসন বা পুলিশ তথা সরকারের হাতে নেই। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় এই কারণেই, পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে একদল উগ্র-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাইকে ঘোষণা দিয়ে একজন কলেজশিক্ষককে হেনস্তা করতে উদ্যত, তখন উপস্থিত জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার তার দুইশত পুলিশের বাহিনী নিয়ে ঘটনা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা আক্রান্ত শিক্ষকের ‘অপরাধ’ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তার সুরক্ষা নিশ্চিত না করে ধর্মীয় উন্মাদ গোষ্ঠীর পক্ষ অবলম্বন করেছেন। এতে করে সেই ডিসি-এসপির অযোগ্যতাই শুধু প্রমাণিত হয় না, প্রকৃতপক্ষে সরকারের ঘোষিত নীতিমালার বিপক্ষে তাদের অবস্থানও স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রশাসন বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কি তাদের ব্যর্থতা বা দায়িত্বে অবহেলার জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?
শিক্ষাক্ষেত্রে এই পরিকল্পিত নৈরাজ্য সৃষ্টি শুধু গুণী, মেধাবী ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের বিতাড়িত করে নানা কায়দায় শিক্ষকের পদ বা তাদের সম্পত্তি দখলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই অচল করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপক প্রচার প্রসার সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামি মৌলবাদী গোষ্ঠী তাদের সাফল্যের ফলাফল পেতে শুরু করেছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ৮২.৯০ জন ছাত্র-ছাত্রী পাসের জন্য প্রয়োজনীয় ৪০ নম্বর তুলতে পারেনি। অন্যদিকে পোশাক পরিচ্ছদে, হিজাবে-বোরকায় দৃশ্যমান ইসলামি লেবাসের আধিক্য দেখা গেলেও শিক্ষার্থীদের নিম্নগামী মূল্যবোধ আশঙ্কাজনকভাবে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
আমরা বিভিন্ন সময়ে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সাম্প্রদায়িক হামলা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ যেকোনো সমস্যা সংকটকে পাশ কাটাবার জন্য উন্নয়নের ঢাকঢোল জোরেশোরে বাজিয়ে দিই। নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা-উত্তরকালে, বিশেষ করে বিগত এক দশকে যোগাযোগ ও বাণিজ্য, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। একমাত্র পদ্মা বহুমুখী সেতুকে বিবেচনায় নেওয়া হলেই যে অগ্রযাত্রা ও অহংকার, সাফল্য ও সম্ভাবনার চিত্র আমরা দেখতে পাই তা অভাবনীয় এবং অতুলনীয়। কিন্তু জনগণের সেই দীর্ঘ লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নের পরপরই যে দৃশ্য আমরা দেখি তাতে অনুমান করা যায় সেতু, সড়ক, বন্দর ও ভবন নির্মাণ উন্নয়নের কেবল একটি মাত্র দিক। অন্য প্রান্তে আমাদের মানসিক ও মানবিক, চিন্তা-চেতনা এবং বোধ বুদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো উন্নয়ন তো ঘটেইনি বরং বিগত পঞ্চাশ বছরে সর্বব্যাপী মূর্খতা ও ধর্মান্ধতা আমাদের প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে।
ভবিষ্যতে মেধা ও মননহীন এবং স্বাধীন চিন্তা-চেতনারহিত একটি প্রজন্ম তৈরি করার সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হতে চলেছে। এ জন্য অনুৎপাদনশীল শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে এবং বিজ্ঞান শিক্ষাকে ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে ক্রমেই অপ্রয়োজনীয় হিসাবে প্রতীয়মান করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। শিশুদের মধ্যে সুকৌশলে সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়িয়ে দেওয়া এবং পাঠ্যপুস্তক থেকে হেফাজতের ফরমুলা অনুসারে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শরৎচন্দ্র এমনি কি হুমায়ুন আজাদকে বাদ দিয়ে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হয়েছে।
মূর্খতা ও অন্ধত্ব যখন সংক্রামক রোগের মতো দ্রুত বিস্তার লাভ করছে, বিস্ময়ের ব্যাপার দেশের সেই ক্রান্তিকালে পদ-পদবি-পুরস্কার লোভী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছেন। মেরুদণ্ডহীন শিক্ষককূল সকল মান-অপমান তুচ্ছ করে নতজানু হতে হতে ধূলিকণায় পরিণত হয়েছেন। এমনকি গণমাধ্যমের একটি বড় অংশের উচ্ছিষ্টভোগী সাংবাদিক, সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতেও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছেন। দেশের মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ও অসাম্প্রদায়িক বিদ্যোৎসাহী মানুষ, ধর্মনিরপেক্ষ ছাত্র-শিক্ষক-সাংস্কৃতিক কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধকে যারা জীবনের যাপনের অংশ মনে করেন, তারা যদি সম্মিলিতভাবে কূপমণ্ডূকতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থ হন, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন একটি পশ্চাৎপদ জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হব। উন্নয়নের কোনো মহাসড়কই তখন আমাদের সুন্দর জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে না, ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন সমাজে ইট সিমেন্টের কোনো সেতুই মানুষের ভেতরে মানবতার সেতুবন্ধ রচনা করতে সমর্থ হবে না। আমরা যে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় গেছি সে কথা দ্রুত বুঝতে পারা জরুরি।
আপনার মতামত লিখুন :