• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

শহীদ মতিউরের বাবার স্মৃতিতে গণ-অভ্যুত্থান


বাশার খান
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২২, ০৬:৩৩ পিএম
শহীদ মতিউরের বাবার স্মৃতিতে গণ-অভ্যুত্থান

২৪ জানুয়ারি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান দিবস। বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতাসংগ্রামের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার ইতিহাসে গণ-অভ্যুত্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৬৯ সাল। আগরতলা মামলার প্রধান আসামি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যদের মুক্তি ও পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের দাবিতে আন্দোলনে প্রকম্পিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে সাধারণ মানুষ মিছিল বের করে। এতে ছাত্র-যুবক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক বাঙালি অংশ নেয়। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে এদিন ঢাকায় সচিবালয়ের সামনের রাজপথে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র কিশোর মতিউর রহমান এবং আরও কয়েকজন শহীদ হন। প্রতিবাদে সংগ্রামী জনতা সেদিন সচিবালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মানুষের বিক্ষোভের ঢল প্লাবিত করে ঢাকার পথ। অগ্নিরূপী জনতা আইয়ুব-মোনেম চক্রের দালাল, মন্ত্রী, এমপিদের বাড়ি এবং তাদের মুখপাত্র হিসাবে পরিচিত তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঢাকার পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

২৪ জানুয়ারি এই গণ-আন্দোলন ছিল অভূতপূর্ব ঘটনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট ঘটনা ও পরবর্তী ধারাবাহিকতায় সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা মামলার সব আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। আন্দোলনের তীব্রতা এবং এর ঐতিহাসিক ফলাফলের কারণে ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মতিউর রহমান মল্লিক

’৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ মতিউর (পুরো নাম মতিউর রহমান মল্লিক)-এর বাবা আজহার আলী মল্লিকের সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি লেখা ১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান দিবসে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘স্মৃতির মালায় একটি রক্তপলাশ’। বাবার নিষেধ উপেক্ষা করে এবং কৌশলে মায়ের চোখকে ফাঁকিয়ে দিয়ে সেদিন রাজপথে নেমেছিলেন কিশোর মতিউর। ইত্তেফাকের ওই প্রতিবেদনটি খুবই হৃদয়গ্রাহী ভাষায় পরিবেশন করা হয়। এখানে মতিউরের বাবার স্মৃতিচারণাটি হুবহু তুলে ধরা হল, যাতে পাঠক তখনকার বাস্তবতা এবং ছোট্ট ছেলে মতিউরের মিছিলে যাওয়ার যে তীব্র টান—তা অনুভব করতে পারেন।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়: ‘ফুলের মত নিষ্পাপ অথচ আগুনের মত জ্বলন্ত কিশোরটির নাম মতিউর—২৪শে জানুয়ারীতে বৃন্তচ্যুত কিশোর শহীদ মতিউর রহমান মল্লিক। তাহার পিতা জনাব আজহার আলী মল্লিক উনসত্তরের এই দিনটির স্মৃতিচারণা করিতেছিলেন।

সেদিন ছিল শুক্রবার।  সারা দেশব্যাপী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১১-দফার দাবীতে হরতাল। সকাল হইতেই মতিউর যেন অসম্ভব চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। সকালে একসঙ্গে বসিয়া নাস্তার সময় সে বারবার বলিতেছিল হরতালের কথা—“জানো মা, একটা রিকশা-সাইকেল পর্যন্ত বেরোয়নি আজ। এখান থেকে মিছিল বেরুবে।” এ খবরটার নতুনত্ব ছিল না কিছুই, কিন্তু বাবাকে শুনাইয়া মাকে খবরটা দেওয়ার অর্থ—“মা আমিও মিছিলে যাব, কিন্তু তুমি বাধা দিও না।” বাবা ধমক দিয়া উঠিলেন—মায়ের বুক কাঁপিয়া উঠিল অজানিত আশঙ্কায়। বাবা বাহির হইবার সময় মাকে বারবার বলিয়া গেলেন, “খেয়াল রেখো, মতিউর যেন না বেরোয় আজ।”

কিন্তু কিশোর মনটি ছটফট করিতেছে এক দুর্বার আকর্ষণে। মিছিল আর সংগ্রাম যাহাকে বার বার হাতছানি দিয়া ডাকিতেছে, মায়ের স্নেহ আর পিতার নিষেধের শাসন তাহাকে বাধিয়া রাখিবে কি করিয়া?

প্যান্ট খুলিয়া লুঙ্গি পরিল মতিউর। গায়ে হাফ শার্ট আর উহার উপর একটি পুলওভার। মা ভাবিলেন, যখন লুঙ্গি পরিয়াছে তখন বোধহয় ছেলে আর বাহিরে যাইবে না। কিন্তু হায়, নিশ্চিন্ত স্নেহ! মতিউর সকলের চক্ষু এড়াইয়া শরীক হইল মিছিলে। অজস্র সংগ্রামী মুখের ভিড়ে মিশিয়া গেল একটি কিশোর অবয়ব—সহস্র মুষ্ঠিবদ্ধ ঊর্ধ্বমুখী হাতের মধ্যে শানিত কৃপাণের মত শূন্যে উত্থিত হইল একটি কিশোরের মুষ্টি।

তারপর দুপুর সাড়ে এগারোটায় সেক্রেটারিয়েটে ভবনের পাশে পুলিশের গুলী। বিদ্যুৎবেগে গুলীবর্ষণের খবর ছড়াইয়া পড়িল ঢাকা নগরীতে, সে খবর আসিয়া পৌঁছিল গোপীবাগের রন্ধন গৃহেও। ভীতসন্ত্রস্ত মা খুঁজিলেন মতিউরকে। কিন্তু অভাগিনী মাতৃহৃদয় তো তখনও জানে না, মতিউর তাঁহার ডাক আর শুনিবে না কোনদিন। বিকাল পাঁচটায় ফিরিয়া আসিল রক্তাক্ত মতিউরের নিষ্প্রাণ দেহটি।

২০শে জানুয়ারী আসাদুজ্জামান যে মিছিলে শহীদ হইয়াছিলেন সে মিছিলেও ছিল মতিউর। সারাদিন ঘরে ফেরে নাই। বিকালে আসাদের মৃতদেহটি লইয়া ষ্টেশন হইতে গাড়ী ছাড়ার পর সারাদিনের অভুক্ত দেহটি লইয়া ভয়ে ভয়ে ঘরে ফিরিয়াছিল সে। বাবা ধমক দিলেন। ফুফু মারমুখী হইয়া উঠিলেন। সেই সন্ধ্যা হইতেই পড়া বন্ধ করিয়া দিল মতিউর। চুপচাপ গম্ভীর হইয়া কি যেন ভাবিত সে। পরদিন সন্ধ্যায় মায়ের কাছে গিয়া চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিয়াছিল—“যাদের জানাজায় অনেক লোক হয় তারা তো মহৎ, তাই না?”

—হ্যাঁ, তাই তো।—”

—জানো মা, আসাদের জানাজায় অনেক লোক হয়েছিলো।” তারপর অস্ফুট কণ্ঠে বলিয়াছিল, “আমার জানাজায়ও যদি অত লোক হয়, তাহলে খুব মজা হবে তাই না, মা?”

মা চমকাইয়া ছেলের মুখে হাত চাপা দিয়া বলিয়াছিলেন,

— “চুপ কর, চুপ কর হতভাগা ও কথা বলতে নেই।” মতিউরের সেই সন্ধ্যার অস্ফুট সংলাপটি সত্যে পরিণত করিয়া ২৪ জানুয়ারীর একটি রক্তপলাশ ফুল ইতিহাসের মালায় গাঁথা হইয়াছে।’

 

লেখক: সাংবাদিক এবং গবেষক

Link copied!