• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

উন্মত্ততা ছাড়াই হোক বাঁধভাঙা আনন্দ


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: নভেম্বর ৩০, ২০২২, ০৫:০০ পিএম
উন্মত্ততা ছাড়াই হোক বাঁধভাঙা আনন্দ

চার বছর পর আসা বিশ্বকাপের উন্মাদনায় মেতেছে দেশ। ফুটবল উন্মাদনার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস, উল্লাস, বাঁধভাঙা আনন্দ; বিপরীতে আছে নানা হিসাব, ম্যাচকালীন উৎকণ্ঠা। ফুটবলপাগল জাতি অপেক্ষায় থাকে বিশ্বকাপের। এই সময়ে দেশের জায়গায়-জায়গায় প্রিয় দলের পতাকা ওড়ে, মিছিল হয় পতাকা নিয়ে, জার্সি ওঠে সমর্থকদের গায়ে। মানুষের উত্তেজনা সর্বজনীন রূপ পায়। আনন্দের অভিলাষে আসা উত্তেজনার বিপরীতে আছে আবার উন্মত্ততা। প্রবল প্রতিপক্ষ বিশেষ করে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা হয়ে পড়ে বিভক্ত। বাগবিতণ্ডা থেকে শুরু করে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে ইতোমধ্যে।

আনন্দের যে ফুটবল সেটা যদিও ফুটবল-বাণিজ্য। আমরা নিখাদ ক্রীড়াপ্রেমী হলেও ওই বাণিজ্যের একেকটা একক। আমাদের আবেগ এখানে পণ্য হয়ে যায়। যত উত্তেজনা তত বেশি বাণিজ্য। যত উচ্ছ্বাস তত বেশি লাভালাভের হিসাব। যদিও এখানে আমরা নিতান্ত দর্শক, তবু যাদের বাণিজ্যের লক্ষ্য তারা ঠিকই সেখান থেকে আদায় করে নিচ্ছে।

এই যে আমরা টেলিভিশনে খেলা দেখছি, পতাকা ওড়াচ্ছি, জার্সি পরছি সবখানেই রয়েছে বাণিজ্য; দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সকলের। দর্শক হিসেবে পছন্দের দলের জয় প্রত্যাশার বাইরে আমাদের প্রাপ্তি যেখানে নেই সেখানে এসব নিয়ে আমরা ভাবছি না, ভাবার দরকার হয়তো নেই। কিন্তু এই আনন্দ আর বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যের সঙ্গে কেন আমরা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছি, সেটা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে বৈকি!

গত ২০ নভেম্বর কাতারে বিশ্বকাপ শুরুর পর থেকে দেশে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে। বিভক্তি, বাগবিতণ্ডা থেকে মারামারির এসব ঘটনাকে কি বিশ্বকাপ উপভোগ বলা যায়? না, অবশ্যই না! এটা বিশ্বকাপ উন্মাদনার ন্যাক্কারজনক প্রকাশ। অনাকাঙ্ক্ষিত। এটা কেন হচ্ছে? কেন মানুষ এত বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ছে? কেন নিজের আবেগ সামলাতে পারছে না? খেলাকে কেন সম্পর্কের চাইতেও বেশি গুরুত্ব দিতে বসেছে? কেন এত অসহিষ্ণু ও সহিংস হয়ে ওঠছে মানুষ? এতগুলো প্রশ্ন! উত্তর খোঁজা উচিত সমাজবিজ্ঞানীদের, মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষকদের।

খেয়াল করলে দেখা যায়, দেশে ফুটবল সমর্থকদের বেশির ভাগই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা এ দুই দলে বিভক্ত। এ দুই দলের বাইরে আরও কিছু দেশের সমর্থক আছেন সত্য, তবে সংখ্যায় তারা নগণ্য। সংখ্যায় কম বলে তাদের উত্তেজনা বাইরে প্রকাশ হয় না। উত্তেজনাও ছড়ান না, মারামারিতেও অংশ নেন না। কিন্তু সকল সমস্যা এই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বিভক্তিতে। লাতিন শৈল্পিক ফুটবলের দুই উত্তরাধিকার ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। ফুটবলে তারা দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হলেও যুদ্ধে জড়ানোর অবস্থায় নেই। দেশ দুটির ফুটবলারদের মধ্যে নিজেদের ফুটবল নিয়ে ‘অহম’ থাকলেও ব্যক্তি-ব্যক্তির সম্পর্ক মধুর। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার এই সময়ের দুই মহাতারকা নেইমার জুনিয়র ও লিওনেল মেসির ব্যক্তিগত সম্পর্ক কতখানি নিবিড় সেটা মিডিয়ার কল্যাণে সকলেরই জানা। এমনকি এই বিশ্বকাপে একটা ম্যাচের পর লিওনেল মেসি কর্তৃক মেক্সিকোর জার্সি ও পতাকা পা দিয়ে মাড়িয়ে যাওয়ার যে বিতর্ক চলছে, সেখানেও ব্রাজিলের সাবেকদের কয়েকজন মেসির পক্ষই নিয়েছেন। কই তারা তো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেননি। এটাই ফুটবলের সৌন্দর্য। অথচ আমরা সেই সৌন্দর্য গ্রহণ করছিই-বা কতটুকু?

বিশ্বকাপ এলে দেশে মৌসুমি সমর্থক বেড়ে যায়। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার অনেক সমর্থক আছেন যারা নিজেদের দলের ফুটবলারদের নাম নিতে গেলে প্রতিপক্ষের কারও নামও বলে ফেলেন এমন অবস্থা। নিজেদের না চিনলেও দলের বিপক্ষে কেউ কিছু বললে সহ্য করতে পারেন না। প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েন; ব্যক্তিগতভাবে, গোষ্ঠীগতভাবে। কেন এমন হয়? এত অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার কী কারণ?

আমি ব্রাজিল ফুটবলের মুগ্ধ সমর্থক। ব্রাজিলের ফুটবলের প্রতি আলাদা আকর্ষণ অনুভব করি। বিশ্বকাপ ফুটবলকে আনন্দের একটা উপলক্ষ হিসেবে খেলার পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা উত্তেজনাকে ধারণ করি। এখানেই আনন্দ আমার। আমার পরিচিত, এমনকি আমার পরিবারের অনেকেই আর্জেন্টিনার সমর্থক। তারাও একইভাবে আনন্দ উপভোগ করেন। সামাজিক মাধ্যমে আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ দলের জয় কামনার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের হারও প্রত্যাশা করি। এই হার প্রত্যাশা ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিক থাকে যতক্ষণ ব্যক্তিগত আক্রমণে কেউ না জড়ায়। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, অনেকেই এখানে সীমা ছাড়িয়ে যায়। দলের সমর্থন করতে গিয়ে আক্রোশে ফেটে পড়ে, অশোভন শব্দ-বাক্য ব্যবহার করে, বাগবিতণ্ডায় জড়ায়।

সামাজিক মাধ্যমে এমন একশ্রেণির সমর্থক গজিয়েছে যারা ‘ফুটবলদ’ নামের কিম্ভূত শব্দ ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ‘বলদ’ ডাকে। এদের কেউ কেউ শিক্ষিত বলেও জানি। কিন্তু শিক্ষার এ কেমন অপচয়, ভব্যতার এ কেমন প্রকাশ! ভার্চুয়াল প্রতিপক্ষকে ঠেকাতে যেখানে পরিসংখ্যান ও যুক্তির দরকার, ঠাট্টা ও হাসি উদ্রেককারী শোভন শব্দ-বাক্যের দরকার, সেখানে তারা কেন এমন আচরণ করে, রহস্য বটেই। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত। কেউ কেউ আবার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মহাতারকাদের ছবি দিয়ে এমন সব কোলাজ করে, যেখানে হাসিঠাট্টার উপকরণের চেয়ে বেশি থাকে অপমান। মেসি ছাগল বেচতে দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে, নেইমার প্রতিপক্ষের কড়া ট্যাকলে ইনজুরিতে পড়লেও সেটা ‘অভিনয়’, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা ঝুলে আছে টয়লেটে; এসব ট্রল-মেম নয়, এগুলো নোংরামো। অনলাইনে এই ধরনের নোংরামোর প্রভাব পড়ছে অফলাইনে। তাই জায়গায়-জায়গায় বিভক্তি, বাগবিতণ্ডা, মারামারি। এগুলো থেকে বেরিয়ে আসা উচিত আমাদের।

শোভন শব্দ-বাক্য দিয়ে ভার্চুয়ালি বিশ্বকাপের আনন্দ উপভোগ করা যায়। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে সেটা করার চেষ্টা করেন। সংখ্যা যদিও কম, তবু তাদের চেষ্টা আছে। এর বাইরে প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রোশ মাথায় নিয়ে একশ্রেণির দর্শক বিশ্বকাপ উপভোগ করতে বসে। সংখ্যায় এরা অনেক, এবং এই সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে।

সম্প্রতি আর্জেন্টিনার পেশাদার লিগ কর্তৃপক্ষের টুইটার হ্যান্ডলে লিওনেল মেসির হাতে ফটোশপে একটা পতাকা ধরিয়ে দিয়ে একটা পোস্ট করা হয়েছে। এই পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অনেক গণমাধ্যম এটাকে বাংলাদেশের প্রতি আর্জেন্টিনার ‘ভার্চুয়াল উপহার’ আখ্যা দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। মিডিয়ার পেশাদারত্বের এমন অপচয়ে অবাক হতেই হয়। তেইশ বছরের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম শেষে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত যে পতাকা তার গায়ে লেগে আছে ত্রিশ লাখ শহিদের রক্ত আর দুই লাখ নারীর ওপর নিপীড়ন সেই পতাকার ফটোশপড ছবি আন্দোলিত করছে যাদেরকে, তারা কি পতাকার ওজন ধরতে পারছে না? এখানে মিডিয়ায় থাকা মানুষেরাও যে পেশাদারত্বে জায়গা থেকে সরে গিয়ে নিজেরাই প্রভাবিত হয়ে গেছে— সেটা কে বলবে। মিডিয়া সংশ্লিষ্টরা যদি ক্ষেত্রবিশেষে এমন আচরণ করে তাহলে সাধারণ দর্শকেরা যাবে কোথায়? দেশটির লিগ কর্তৃপক্ষের ‘সরল বিশ্বাসের’ সেই ভুলকে কেন গর্বের বিষয় বলে ভাববো আমরা? এখানে কি পতাকার মর্যাদা নিয়ে ভাবার জায়গা নেই আমাদের? থাকা তো উচিত! পতাকা নিয়ে এমন আলোচনার সময়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ফেসবুক পোস্টে আমি মন্তব্য করেছিলাম। এরপর সেখানে এবং আমার ভেরিফায়েড আইডিতে যেভাবে নিন্দামন্দ করল লোকজন তাতে সহিষ্ণুতা ছিল না। ওসবে উত্তেজনার রসদ থাকলেও এটাকে সাধারণ ব্যাপার বলে ধরে নিয়েছি।

বিশ্বকাপ ফুটবল চার বছর পর পর আসে। ফুটবলের এই সর্বোচ্চ আসরে আমাদের দেশ নেই। তবে আমরা দর্শকেরা আছি বিশ্বকাপে। তাই লিওনেল মেসির গোলের পর সারাদেশে মিছিল হয়, ব্রাজিলের জয়ের পর সারাদেশে উল্লাস হয়। এসব ঘটনার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফাও। সত্যিকার ঘটনা, ছবি ও ভিডিও প্রকাশে আমরা আনন্দিত হই। বিশ্বকাপ আমাদের একটা জায়গায় নিয়ে এসেছে, যা একান্তই ফুটবলের। আমরা হাজার মাইল দূরের একেক দেশের ফুটবলের ভক্ত।

আমরা ফুটবল অনুরাগী। তবে এই অনুরাগ যখন বিভক্তির কারণ হয় এবং এই বিভক্তি বিরাগের পথ ধরে বাগবিতণ্ডা, মারামারি পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। আমরা সতর্ক হবো, তবে কোন পথে? এখন পর্যন্ত সেই পথ জানা নেই! 

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

Link copied!