• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের সুবিধা ও করণীয়


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৩, ২০২৩, ০৫:২৬ পিএম
আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের সুবিধা ও করণীয়

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে সংস্কারের পদক্ষেপ ও এর অগ্রগতি মূল্যায়ন শেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রতিশ্রুত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি প্রদানের অনুমোদন দিয়েছে। বুধবার সংস্থাটির পর্ষদ ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের এই দ্বিতীয় কিস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের মোট ঋণের অংশ এই কিস্তিটি বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ সংকটে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।

২০২২ সালের জুলাইতে বাংলাদেশের আবেদন, গত ৩১ জানুয়ারি ঋণ অনুমোদনের পর ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তির অর্থ লাভ এবং তার ৯ মাস পরে বাংলাদেশ দ্বিতীয় কিস্তির এই অর্থ পেতে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা একটি দেশের জন্য কাম্য ঋণের অর্থ পেতে অনেকের কাছে অনেক বিলম্ব মনে হলেও বিষয়টি ঠিক না। বহুজাতিক সংস্থাগুলো মূলত এভাবেই ঋণ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ বরং অনেক আগেই ঋণের অর্থ পাচ্ছে। কারণ, তারা বাংলাদেশের ঋণের অর্থ ফেরত দেওয়া এবং আমাদের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রমাণ পেয়েছে। করোনা ভাইরাস ও রাশিয়া‑ইউক্রেন যুদ্ধ না হলে বাংলাদেশকে হয়তো এই ঋণ নিতেই হতো না।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ এই ঋণের জন্য আইএমএফের কাছে আবেদন করেছিল চরম সংকট পড়ে নয়, সংকটে যাতে পড়তে না হয়, সে জন্য। আমরা শ্রীলংকা-পাকিস্তানের মতো সংকটে পড়ে আইএমএফের কাছে ঋণ চাইনি। এমন হলে আমাদের ঋণ অনুমোদন হতে আরও অনেক সময় লাগতো। সংস্থাটির বোর্ডে ঋণ অনুমোদনের তিন দিনের মাথায় ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বাংলাদেশের রিজার্ভে জমা হয়েছে। এটিকে রেকর্ড বলা যায়। এতে করে আমাদের রিজার্ভ দ্রুত বেড়েছে।

আইএমএফ বলছে, দ্বিতীয় কিস্তির এই অর্থ অনুমোদনের আগে প্রথম কিস্তিতে দেওয়া ঋণের শর্তের কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা দেখতে হয়েছে সংস্থাটির রিভিউ মিশনকে। কিছু শর্ত অপূর্ণ থাকার কথা তখন রিভিউ মিশন জানিয়েছিল। বাংলাদেশও শর্ত অপূর্ণ থাকার কারণ তুলে ধরে তা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এসব প্রক্রিয়া সমাধান করেই কিস্তি ছাড় করা হলো।

এখানে উল্লেখ্য, গত অক্টোবরে সংস্থাটির রিভিউ মিশন বাংলাদেশের সঙ্গে করা সংস্কার চুক্তির ছয়টি শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চেয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক সে সময় গত জুন পর্যন্ত রিজার্ভের স্থিতি প্রত্যাশিত মাত্রায় ধরে রাখতে না পারা এবং জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায় কম হওয়া ছাড়া বাকি চারটি শর্ত পূরণ হওয়ার কথা জানিয়েছিল এবং জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী স্থিতিশীল সরকার সংস্কারের বাকি পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আহ্বান জানিয়েছিল। এরপর সবকিছু পর্যালোচনার পর রিভিউ মিশন দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছিল, যাকে আইএমএফ ‘স্টাফ লেবেল এগ্রিমেন্ট’ হিসেবে অভিহিত করে। এত সব প্রক্রিয়ার পর আইএমএফ পর্ষদ দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় চূড়ান্ত করল। এখন আবার ঋণচুক্তি অনুযায়ী ২০২৬ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে আরও চার কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। প্রতিবারই কিস্তি ছাড়ের আগে কিস্তির অর্থের ব্যবহার ও শর্ত বাস্তবায়ন দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আশা করি, আইএমএফের এই অর্থ বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর চাপ কমিয়ে বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে অত্যন্ত সহায়ক হবে। কারণ, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের চাপে রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেশ কমে গেছে, একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে টাকার দরেরও অনেক অবনমন হয়েছে।

আইএমএফের সঙ্গে করা এই ঋণের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আর্থিক ও রাজস্ব খাতে সংস্কারের পাশাপাশি ভর্তুকি কমিয়ে জ্বালানির দাম সমন্বয়ের পথে হাঁটার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ। শর্ত পালন করতে গিয়ে আমাদের জ্বালানি মূল্য বেড়েছে। এ ছাড়া বিনিময় হার বাজারমুখী করা, ৯ শতাংশ সুদহার তুলে দেওয়া, ব্যাংক ঋণের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্য প্রকাশ, রিজার্ভের হিসাব আইএমএফ স্বীকৃত পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী করা, মুদ্রানীতি আধুনিকায়ন করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নেওয়ার শর্ত রয়েছে। এসবের অনেক কিছু বাংলাদেশ পালন করেছে এবং করতে শুরু করেছে।

তবে শর্তের মধ্যে থাকা সেপ্টেম্বরের মধ্যে রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের সক্ষমতা অর্জন করা যায়নি। এটি অস্বাভাবিক কিছু না। গত ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রিজার্ভ হয় আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতির গ্রস হিসাবে ১৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে তা ২৪ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার।

যত দূর জানা গেছে, সুদের হার আইএমএফের নিজস্ব মুদ্রা স্পেশাল ড্রয়িং রাইটসের (এসডিআর) ভাসমান বা উন্মুক্ত হারের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। সব মিলিয়ে সুদের গড় হার হতে পারে ২ দশমিক ২ শতাংশ। এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি বা ইসিএফের প্রায় ১০৭ কোটি ডলার ঋণ হবে সুদমুক্ত। এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি বা ইইএফের সুদহার হবে ভাসমান (ফ্লোটিং) এসডিআরের সঙ্গে ১ শতাংশ। অন্যদিকে রেজিলিয়েন্স ট্রাস্ট ফ্যাসিলিটি বা আরসিএফের ১০০ কোটি ডলার ঋণের সুদহার হবে এসডিআর রেটের সঙ্গে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে যা দাঁড়ায়, তার মাধ্যমে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, এই ঋণ বাংলাদেশের জন্য বড় কোনো বোঝা হিসেবে দেখা দেবে না।

সুবিধা

আইএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) বাজেট সহায়তার অংশ হিসেবে ৪০ কোটি ডলার ঋণের অর্থ যোগ হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও বাড়বে বাংলাদেশের। আইএমএফের ঋণ অনুমোদনের ও ছাড়ের কারণে আমরা কম সুদে আর যে সব আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ প্রত্যাশা করছি, তারাও দ্রুত এগিয়ে আসবে। কারণ, চুলচেরা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার পরই মূলত আইএমএফ ঋণ দিয়ে থাকে। আইএমফের ঋণ প্রদান নীতিকে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোটামুটি একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে।

২০৩১ সালের মধ্যে সফলভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে অতীতের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে প্রবৃদ্ধির চাকাকে গতিশীল রাখতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যা সমাধান এবং পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ, উৎপাদন সুসংহত করা এবং জলবায়ু সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা। এই বাস্তবতায় এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় নেওয়া আগের উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিতা রাখতে আইএমএফের প্রদান করা অর্থ আমাদের আর্থিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আইএমএফের ঋণের কারণে বাংলাদেশকে হয়তো টাকা ছাপিয়ে ভর্তুকি দিতে হবে না। টাকা ছাপিয়ে ভর্তুকি দিলে প্রকৃত অর্থে অর্থনীতির খুব বেশি লাভ হয় না। বরং মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। একই সঙ্গে আইএমএফের ঋণের সুযোগে আমাদের বেশকিছু সংস্কারও সাধন হবে, যা করা আসলেই প্রয়োজন ছিল। কারণ, আমাদের অর্থনীতিতে বেশ কিছু সমস্যা ও দুর্বলতা রয়েছে। অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে এসব সমস্যা দূর করা প্রয়োজন। এই সংস্কার হয়তো সরাসরি জনগণের উপকারে আসবে না। তবে দিনশেষে এর সুফল জনগণ পাবে। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ কমবে, দক্ষতা বাড়বে, কম সুদে ঋণ পাওয়া যাবে।

এখানে একটি বিষয় বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতা ও উন্নতির কারণে আইএমএফ ঋণের শর্তে কঠিন কিছু আরোপ করতে পারেনি। এতে করে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের কোনো চাপ তৈরি হবে না। আর এই ঋণ মূলত ব্যালেন্স অব পেমেন্ট স্থিতিশীল করতে নেওয়া হচ্ছে। ফলে এই কিস্তির অর্থ ডলারের চাপ কিছুটা লাঘব করবে।

করণীয়

প্রাপ্ত ঋণের অর্থ সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করলে এবং আর্থিক ও রাজস্ব খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার কর্মসূচি ঠিকঠাক বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আবারও গতিশীল ধারায় ফিরে আসবে। মনে রাখতে হবে যে আইএফের ঋণের মোট অর্থ আমাদের বড়জোর সপ্তাহ দুয়েক টিকিয়ে রাখবে। তাই আমাদের চাহিদা কমাতে হবে, অর্থ খরচে সাশ্রয়ী ও হিসাবি হতে হবে এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ভালো করতে হবে। পাশাপাশি এক্সচেঞ্জ রেট ব্যবস্থাপনা ভালো করতে হবে এবং রাজস্ব বৃদ্ধি ও আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই মূলত বিশ্বব্যাপী অনেক ঝড় ও বিপদের মধ্যেও আমাদের অর্থনীতিকে এতদিন টিকিয়ে রেখেছে। আমার বিশ্বাস, সবকিছু সুন্দরভাবে চললে আমাদের কমপক্ষে ৭‑৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

Link copied!