• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

বিগত ও নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৪, ১২:২৬ পিএম
বিগত ও নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি

অর্থনীতির বিশ্লেষণ‑প্রক্ষেপণের আগে বলে নেওয়া ভালো যে ২০২৩ সালে যেসব খাত‑ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতি সবচেয়ে ভুগেছে, সেখানে রয়েছে মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট ও ডলারের বিপরীতে ক্রমহ্রাসমান টাকার মান, খেলাপি ঋণ, বিদেশে অর্থ পাচার, বৈদেশিক মুদ্রার কম রিজার্ভ এবং দেশ‑বিদেশ থেকে সরকারের ক্রমবর্ধমান ঋণ গ্রহণ। এর মানে এই নয় যে অর্থনীতির অন্য খাত‑ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভালো গেছে। সামগ্রিকভাবে সামষ্টিক অর্থনীতি বলতে যা বোঝানো হয়, অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), মাথাপিছু জিডিপি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব খাত (রাজস্ব আহরণ, সরকারি ব্যয়, বাজেট ভারসাম্য ও অর্থায়ন), মুদ্রা ও আর্থিক খাত (মুদ্রানীতি ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা পরিস্থিতি, অভ্যন্তরীণ ঋণ, সুদের হার, পুঁজিবাজার), বৈদেশিক খাতের রপ্তানি ও আমদানি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিটেন্স, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য প্রভৃতি অনুষঙ্গের কোনোটিতেই ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ভালো ছিল না। সামষ্টিক অর্থনীতির এসব বিষয় নিয়ে ধরে ধরে প্রথাগতভাবে মূল্যায়ন করা আসলে অনেকের কাছে নেহাতই মূল্যহীন। কারণ, ভারী ভারী শব্দে গুরুগম্ভীর এই মূল্যায়নে কষ্টে দিন কাটানো বাংলাদেশের ৮০‑৮৫ শতাংশ মানুষের দিনযাপনের প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব না। তাই বিগত ও নতুন বছরের বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল্যায়ন ও প্রক্ষেপণ অন্যভাবে করা প্রয়োজন।

২০২২ সালের শেষার্ধে বিশ্বের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদের মাত্র তিনটি শব্দে ফেলে আসা বছরের অর্থনীতির মূল্যায়ন করতে বলা হলে তারা যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানি সংকটের ধাক্কার কথা উল্লেখ করেছিলেন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের নীতিনির্ধারক ও পরিকল্পক উল্লিখিত তিন সংকটের বিরুদ্ধে কার্যকর পদেক্ষপ নিয়ে তাদের নাগরিকদের ২০২৩ সালে কিছুটা স্বস্তি দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই সময়ে বিশ্বে যুদ্ধ কমেনি, জ্বালানি সংকটও দূর হয়নি। তারপরও সেসব দেশে নাগরিকদের ওপর চেপে বসা অসহনীয় মূল্যস্ফীতির চাপ অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক‑পরিকল্পকেরাও অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু উল্টোটা ঘটেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ দূর তো হয়ইনি, বরং বেড়েছে। কারণ, আমাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ছিল মোট জনসংখ্যার বড়জোর ২০ শতাংশের প্রতিনিধিত্বকারী ধনিক শ্রেণি তোষণ উপযোগী। এতে করে ধনিক শ্রেণির অর্থলিপ্সা আরও বেড়েছে, তারা আরও অধিক হারে ঘুষ‑দুর্নীতি‑কালোটাকা‑অর্থ পাচার আর মুনাফায় লিপ্ত হয়েছেন। তারপরও তারা ‘বুকভরা আক্ষেপ’ নিয়ে বছরটি শেষ করছেন। আর সাধারণ মানুষ সুদিনের আশা নিয়ে শুধু ‘শুকরিয়া’ করে গেছে। এই দুইয়ের মাঝে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফাঁদে পড়া আমাদের নীতিনির্ধারকেরা জনগণকে বছরজুড়ে আশার বাণী শুনিয়েছেন এবং যা বাস্তবায়ন না হওয়ায় শেষে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, আসলে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি অগভীর। ঢেউ বেশি ওঠে। তাই সামান্যতেই আমাদের অর্থনীতি কেঁপে ওঠে।’

মূল্যস্ফীতির বাইরে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখা, ডলার সংকট প্রশমন, ব্যাংক খাত ঠিক রাখা, রিজার্ভের ওপর চাপ কমানো এবং সামষ্টিক অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বলা বাহুল্য, অর্থনীতির উল্লিখিত চ্যালেঞ্জসমূহ উৎরাতে নীতিনির্ধারকেরা সচেষ্ট থাকলেও নানা কারণে ব্যর্থ হয়েছেন। যেমন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ইকোনমিক আউটলুকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ৬ শতাংশ। তবে ২০২২ সালে বৈশ্বিক জিডিপির পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে  হয়েছে ৩ শতাংশ। আইএমএফের মতে, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক জিডিপি আরও কমে ২ দশমিক ৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ হতে পারে। বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে উল্লিখিত তথ্যে তৃপ্তি বোধ করাই যায়। তবে মনে রাখতে হবে, প্রবৃদ্ধির এই পরিসংখ্যান জনগণের কাছে আসলে মূল্যহীন মনে হয়েছে। কারণ তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় আরও অনেক বেড়েছে, নুন আনতে গিয়ে তাদের পান্তা ফুরিয়ে গেছে। তাই তারা বছরভর প্রবৃদ্ধি প্রশ্নে তির্যক ভাষায় শুধু প্রশ্নই ছুড়েছেন, প্রবৃদ্ধি কি ধুয়ে খাওয়া যায়, নাকি প্রবৃদ্ধি মাথায় দেয়? প্রবৃদ্ধি নিয়ে নেতিবাচক এই ধারণার কারণ খুঁজলে দেখা যায়, প্রবৃদ্ধির সীমানা নির্ধারিত হয় যেসব উৎস-উপাদানে অর্থাৎ শ্রমশক্তি, শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা, বিনিয়োগের পরিমাণ ও গুণগত মান, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বাজার অবস্থার মানে; এসবে বাংলাদেশ ভালো করেনি ২০২৩ সালে।

২০২৩ সালটি যে শুধু বাংলাদেশিদের জন্য মন্দ ছিল, তা নয়। অনেক দেশের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। প্যারিসভিত্তিক বাজার গবেষণা সংস্থা ইপসস অনেক দিন ধরেই প্রতিবছরই বিশ্বব্যাপী একটি জরিপ করে প্রায় শেষ হতে যাওয়া বছরটি কেমন গেছে, তার আলোকে নতুন বছরটি কেমন হবে, তা জানতে। ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৩৪টি দেশের ১৮-ঊর্ধ্ব ২৫ হাজার ২৯২ জনকে নিয়ে করা এ‑সংক্রান্ত এক জরিপ শেষে ইপসস বলেছে, বিশ্বের ৩৪টি দেশের গড়ে ৭০ শতাংশই বলেছেন, ২০২৩ সাল খারাপ বছর ছিল এবং ৫৩ শতাংশের মতে, তাদের এবং তাদের পরিবারের জন্য ২০২৩ সাল ছিল খুবই খারাপ। ২০২২ সালে এই দুই হার ছিল যথাক্রমে ৭৩ ও ৫৬ শতাংশ। কোভিড-১৯ সংকটে বিপর্যস্ত ২০২০ সালের শেষার্ধ্বে এই সংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশ। অপরদিকে করোনার আগে ২০১৮ ও ১৯ সালে এই হার ছিল ৬২ ও ৬৫ শতাংশ। গত অক্টোবরে বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশে ওয়ার্ল্ড ভিশন ইন্টারন্যাশনাল ও ইপসসের পরিচালিত অন্য এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি ১০ জনের ৪ জন (৩৭ শতাংশ) মা‑বাবা ও অভিভাবক বলেছেন, তারা সন্তানদের দৈনিক প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিতে পারেননি এবং ২১ শতাংশ বলেছেন, তাদের সন্তান গত ৩০ দিন পেটে ক্ষুধা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। অধিকন্তু বিশ্বব্যাপী ৪৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বলেছেন, তারা ৩০ দিনের খাদ্য কেনার অর্থসংগ্রহে চিন্তিত ছিলেন, যা বাংলাদেশের মতো আয়ের দেশগুলোতে ৭৭ শতাংশ। ইপসসের এই পরিসংখ্যান মানুষের জীবনমানের হতাশাজনক এক চিত্রই তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশের সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কিছু তথ্য‑পরিসংখ্যান দেওয়া যায়, যেখানে সাধারণ মানুষের কষ্টে কাটানো দিনলিপির কিছুটা হলেও স্বীকৃতি মিলবে। বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, গত অক্টোবরে নিম্ন ও অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যে সময়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির তুলনায় ২ দশমিক ২৪ শতাংশ কম ছিল (বাংলাদেশের অর্থনীতির ৭০‑৮০ শতাংশ অদক্ষ ও নিম্ন আয়ের অনানুষ্ঠানিক খাতনির্ভর)। মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির কম হারের এই ধারা অনেক বছর ধরেই বিদ্যমান। বিশ্লেষকেরা বলেন, মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির হারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে বাধ্য করছে; তাদের বাড়তি মজুরির অর্ধেকের বেশি চলে যায় বেঁচে থাকার খাবার কিনতে, বাকিটা অন্য নিত্যপণ্যে। বিবিএসের মতে, বাংলাদেশে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম কমায় নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে হয়েছে, যা অক্টোবরে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছিল। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে, যা অক্টোবরে ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। নভেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ হয়েছে, যা অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। বিবিএসের পরিসংখ্যান সূত্রে আরও জানা যায়, দেশের চাল, শাকসবজি, মাছ ও হাঁস-মুরগির বেশির ভাগ সরবরাহ আসে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বাস গ্রামাঞ্চল থেকে। তারপরও ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৩৫ মাসের মধ্যে ৩১ মাস দেশের গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি শহর ও উপশহর অঞ্চলের চেয়ে বেশি ছিল। উপরন্তু গ্রামীণ অঞ্চলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল উচ্চ খাদ্যমূল্য। নভেম্বরে গ্রামাঞ্চলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, যা জাতীয় গড় ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশের চেয়েও বেশি। গ্রামাঞ্চলের মূল্যস্ফীতির চিত্র এটাই প্রমাণ করে, শহর‑উপশহরের অধিক অর্থের প্রবাহ দিয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষের খাদ্যবাড়তি মূল্য দিয়ে গ্রাস করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, বছরের মাঝামাঝি সরকারি বাজেটে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র দেড় শতাংশের সরকারি কর্মীবাহিনী বাড়তি বেতন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে পণ্যবাজারে গিয়ে আরও এক ধাপ গরিব করেছে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা, ব্যাংকগুলোয় ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, বিদেশে অর্থ পাচার, রিজার্ভের পরিমাণ, ডলারের সংকট, টাকার মূল্য, আমদানি‑রপ্তানি, রেমিট্যান্সের প্রবাহ, রাজস্ব আয়সহ সামষ্টিক অর্থনীতির খাত‑ক্ষেত্রগুলোর আরও অনেক তথ্য‑পরিসংখ্যান সহজেই এখানে  দেওয়া যায়, যা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় যথেষ্ট ভালো বলেও প্রতিভাত হবে এবং খাওয়া‑পরার চিন্তাহীন ধনিক শ্রেণি ওই পরিসংখ্যান দেখিয়ে জনগণকে বলতেই পারবে, ‘তোমরা তো বেহেশতে আছো’। সত্যি বলতে কি, এ নিয়ে জনগণের দ্বিমতের অবকাশ নেই। তবে তাদের কষ্টটা এখানেই যে, বাংলাদেশ অর্থনীতির অনেক অর্জন মুষ্টিমেয় শ্রেণির মূল্যবোধহীনতায় জনমনের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তাদের দৃষ্টিতে এখানে সরকার বাহাদুরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সব স্বাভাবিক থাকলেও রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকের আসনে বসে পড়া ব্যবসায়ী শ্রেণি বছর ভর রীতিমতো রুটিন করে মুনাফা চাহিদা মিটিয়েছে, নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন, ‘মুক্তবাজার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করা আমাদের কাজ নয়’; এখানে গড়ে প্রতিবছরের মতো ২০২৩ সালেও হয়তো ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন, ‘ধরিয়ে দিন, আমরা শাস্তি দেব’; এখানে গণমাধ্যমে প্রধান শিরোনাম হয়েছে, ২০০৮‑১৫ সময়কালে দেশের ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুট হয়েছে, নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন, ‘লুটের টাকা কোথায় গেছে, সেটি খুঁজে বের করুন’; এখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমেছে, নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন, ‘বৈশ্বিক কারণে রিজার্ভে ঘাটতি পড়েছে’; এখানে ক্রমবর্ধমান হারে সরকার দেশি‑বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে, নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন, ‘উন্নয়নকাজে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে’। বড় পর্দায় ২০২৩ সালজুড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আসলে এ সবই হয়েছে।

ওপরে উল্লেখ করা তথ্য ও পরিসংখ্যানের আলোকে নতুন বছর ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি কেমন হবে, সে নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে প্রক্ষেপণ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ, সামষ্টিক অর্থনীতির আমদানি-রপ্তানি নির্ভরতা, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার দেশের অর্থনীতির ওপর ইতিমধ্যেই যথেষ্ট ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছে। উপরন্তু স্বজনতোষী ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ চর্চাকারী বাংলাদেশের ওপর বৈশ্বিক অর্থনীতির আসন্ন ও চলমান প্রভাব-অভিঘাত কেমন হবে, তা‑ও জানা কঠিন। এসব সত্ত্বেও বিশ্বের প্রভাবশালী ক্রেডিট রেটিং সংস্থা স্টান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর (এসঅ্যান্ডপি)‑এর গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্সের দৃষ্টিতে ২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ১০টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হবে, তা উল্লেখ করে বাংলাদেশ ২০২৪ সালের অর্থনীতির রাশিফল নিয়ে কিছু বলাই যায়। এসঅ্যান্ডপির মতে ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি‑মূল্যস্ফীতি কমবে, আমেরিকা ও ইউরোপে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে, চীনের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে, বছরের মাঝামাঝি উন্নত অর্থনীতির দেশেগুলোয় সুদের হার কমতে শুরু করবে, উদীয়মান অর্থনীতি দেশগুলো তুলনামূলকভাবে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে, মার্কিন ডলারের অবমূল্যায়ন হবে, ব্যাংকিং কার্যক্রমে সতর্কতামূলক নীতি অব্যাহত থাকবে, আবাসিক খাতে মূল্যপতন অব্যাহত থাকবে, নির্বাচনের কারণে নীতিগত অনিশ্চয়তা তৈরি হবে এবং জ্বালানি ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হওয়ায় এবং কয়েক দফায় ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার না বাড়ানোয় ২০২৪ সালের অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক গত অক্টোবরে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট, নিউ ফ্রন্টিয়ার্স ইন পভার্টি রিডাকশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির পূর্বাভাস দিয়ে জানিয়েছে, ২০২৪ সালে দেশের জিডিপি আরেক দফা কমবে, যা ২০২৫ সালে গিয়ে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যেই থাকবে এবং ২০২৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াবে।

সাধারণ মানুষের ‘যায় দিন ভালো’ দৃষ্টিতে দেখলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি অতীতের চেয়ে আরও কঠিন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, নতুন বছরের শুরুতেই নির্বাচন নামে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে একটি ‘কামড়াকামড়ি’ পর্ব আছে। এই পর্বে দীর্ঘদিন ধরে সীমাহীন মুনাফাকর্মের বাইরে থাকা ধনিক শ্রেণির একাংশ রাজনৈতিক অর্থনীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চাইবে, যার ওপরই মূলত আমাদের অর্থনীতির ভাগ্য নির্ভর করছে। নির্বাচনের ওই পর্বের পর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে জনগণ প্রবৃদ্ধির চুইয়ে পড়া অংশের ছিঁটেফোটা ভাগ পাবে। যদি নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়, তাহলে জনগণের অর্থভাগ্য লাটে উঠবে। আর যদি আমাদের রাজনৈতিক টানপোড়েন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশমুখী হয়, তাহলে ‘দিনে আয় দিনে ব্যয়’ মানুষের কপালে দুর্ভোগ আরও দীর্ঘতর হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিগন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যদি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নিষেধাজ্ঞা‑শর্তের বেড়াজাল চাপিয়ে দেয়, তাহলে বড় রকমের চাপের মুখে পড়বে দেশের অর্থনীতি। শোনা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার স্যাটেলাইট (ভৃত্য রাষ্ট্র) হিসেবে বিবেচিত ইউরোপ যদি সম্মিলিতভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে এই খাতে ক্ষতি হবে অন্তত ৪০‑৪৫ শতাংশ। ফলে রাষ্ট্রের রিজার্ভে আরও টান পড়বে, আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের জনগণের দৈনন্দিন টানাপোড়েনে আরও কিছু যোগ হবে। তবে নিষেধাজ্ঞাকালে যদি ইউটার্ন নিয়ে বাংলাদেশ ভারত, চীন ও রাশিয়ামুখী হয়ে ডলার‑নির্ভরতা কমায়, তাহলে নতুন বছরটি আমাদের জন্য ভয়ংকর কিছু হবে না। কারণ, বাংলাদেশ কৃষি ও কৃষকে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। উপরন্তু প্রবাসে কর্মরত লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি মাতৃভূমির সংকটে চিরকাল পাশে থেকেছে। ভয়াবহ করোনার সময় পুঁজিপতি গোষ্ঠী মুখ ঘুরিয়ে রাখলেও কৃষক‑প্রবাসীরাই আমাদের অর্থনীতি রক্ষা করেছে। পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যনির্ভর বর্তমানকালে যদিও এমন হয় না, তারপরও এই লেখার পরিশেষে এসে অনেকের মতো এই কামনাই রইল, নতুন বছরে বাংলাদেশের অতি মুনাফালোভীরা যেন মহাদুর্ভোগে থাকে, আর কৃষি‑কৃষক‑প্রবাসী যেন থাকে দুধে ও ভাতে।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

Link copied!