• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আজমত ব্যাপারির সনাতন স্বপ্ন পোড়ে বালু ওড়া ঘূর্ণি হাওয়ায়


শিল্পী নাজনীন
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৩, ০৯:২৫ এএম
আজমত ব্যাপারির সনাতন স্বপ্ন পোড়ে বালু ওড়া ঘূর্ণি হাওয়ায়
আজমত ব্যাপারির সনাতন স্বপ্ন পোড়ে বালু ওড়া ঘূর্ণি হাওয়ায়

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। সূর্যটা দারুণ লাল আগুনের চাকতি হয়ে নিজের মুখ শেষবারের মত দেখে নিচ্ছে প্রায় বুজে আসা ঝিলের ময়লা জলে। বড়শিতে শেষ টোপ গাঁথতে গাঁথতে সূর্যের প্রতিবিম্বটার দিকে ছানিপড়া চোখে একবার তাকালেন আজমত। লোকে বলে আজমত ব্যাপারি। কোনোকালে হয়তো কিছু একটা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আজমত, সেসব ঢের আগেই চুকেবুকে গেছে, আজমত নিজেই সেসব ভুলে গেছেন কবে। তবু নামটা টিকে গেছে তার। লোকে এখনও আজমত ব্যাপারি নামেই তাকে চেনে। শুনে বেশ লাগে আজমতের। বেশ একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক মনে হয় তখন নিজেকে। দাড়িতে হাত বুলিয়ে ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে সূর্যের প্রতিবিম্বটা আড়চোখে একবার দেখলেন আজমত। তাকালেন দারুণ আগুনরঙা সূর্যটার দিকে। ডুবুডুবু সূর্যের দিকে তাকিয়ে আজমত যেন নিজেকেই দেখতে পেলেন সহসা। নব্বই ছুঁই ছুঁই এই বয়সটাতে এসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী-ই-বা করার আছে এখন, ভেবে, ফুসফুস খালি করে অনেকটা বাতাস বের করে দিলেন আজমত। যে কোনো মুহূর্তে আজমতও ডুবে যাবেন অন্ধকারে, ঠিক ওই সূর্যটার মতনই। সূর্যটার মতন? আনমনে ক্ষণকাল ভাবলেন আজমত। থমকালেন। না। ঠিক বলা হল না। সূর্যটা ডুবে গেলেই অন্ধকারে ডুবে যাবে পৃথিবী, রাত নামবে তার বুকে। কিন্তু আজমতের মৃত্যুতে অন্ধকারে ডুববে না কিছুই।  রাতও নামবে না কোথাও। আলো জ্বলবে বরং। আজমতের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটে, যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় এই জমকালো বৈদুতিন আলোর নয়া জমানায়ও টিমটিমে বাতি জ্বালিয়ে রাতের অন্ধকারকে স্বাগত জানান আজমত, সেখানে দারুণ রোশনাই ফুটবে বরং। আজমতের তিন ছেলে সেখানে জ্বালিয়ে দেবে ঝাঁ-চকচক বিলেতি আলো, ডেভলপারদের সাহায্যে তারা মাস কয়েকেই তুলে ফেলবে আকাশছোঁয়া বহুতল ভবন। ঘেন্নায় থুঃ করে একদলা থুতু ফেললেন আজমত। তখনই বড়শিতে টান পড়ল হঠাৎ। টেনে তুললেন আজমত। শৌল । বেশ বড়। খুশি হয়ে উঠলেন দারুণ। কিন্তু দমে গেলেন মুহূর্তেই। লাউ কেনার টাকা নেই পকেটে। হুরি বেগম লাউ দিয়ে শৌল মাছের যে ঝোলটা করেন, সেটা স্রেফ অমৃত। কিন্তু বাজারে এখন একটা লাউ কমসে কম ষাট টাকা! অত টাকার যোগাড় আপাতত নাই তার। অতঃপর বেজার মুখে মাছটাকে বগলদাবা করে, বড়শিটা গুটিয়ে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন আজমত। বাড়ি! বাড়ি বলতে তো সেই একটুকরো ভিটে, তাতে টিনের চালের ছোট্ট একটা ঘর। তারও জায়গায় জায়গায় ফুটো। বৃষ্টি এলে জল পড়ে টুপটাপ, শীতে ঝরে কুয়াশা। তা ঝরুক। জীবনের কাছে আজমতের প্রত্যাশা বড় কম। চাওয়া অতি সামান্য। তাতেই সুখি তিনি, তৃপ্ত।

কী মাছ গো ব্যাপারি কাকা?

এই তো। শৌল।

বেচবা নাকি?

উত্তর দিলেন না আজমত। পাশ কাটিয়ে চললেন নিজের পথে। ঠান্ডা পড়েছে বেশ। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি এই সময়টা ভারি খারাপ। নিওর পড়ে সন্ধ্যায় আর সকালে। মাথায় পড়লে আর রক্ষে নাই। শুরু হবে দমকা দমকা কাশি আর শ্বাসকষ্ট। এমনিতেই শ্বাসকষ্ট আছে তার। তার ওপর ঠান্ডা লাগলে জীবন ছ্যাড়াব্যাড়া করে ছাড়ে। আর তার মতো বয়স্ক শ্বাসকষ্টের রোগিদের বেশিরভাগই এই শীতের মৌসুমে অক্কা পায়, জন্মাবধি দেখে আসছেন আজমত। সাবধানের কোনো বিকল্প নাই তাই। তাছাড়া এই তক্কেল বেকুবটার সঙ্গে কথা বলার মোটেই ইচ্ছে নাই তার। তক্কেলের হাতে এখন ম্যালা কাঁচা টাকা। টাকার গরমে মাটিতে তার পা পড়ে না আজকাল। বেকুব। নিজের বাপ-দাদার ভিটেটাকে ডেভলপারের হাতে দিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ি তুলেছে সেখানে। সেখান থেকে খানকতক ফ্ল্যাট ভাগে পেয়ে নিজে একটায় উঠেছে, বাকিগুলো ভাড়া দিয়েছে। মাস গেলে সে এখন থোক টাকা পায় ভাড়া বাবদ। বহুত বাবুয়ানি তার এখন। উল্লুক। নিজের বাপ-দাদার ভিটেটা যে বারোয়ারি করে দিলি, সেই হিসেব নাই, টাকার গরম দেখাস! এরচে বরং বেশ্যাবৃত্তি ভালো! পছন্দের খদ্দেরের সঙ্গে ইচ্ছে হলেই শুয়ে টাকা কামানো! তাতে গায়ে বেশ্যার তকমা আঁটে বটে, তবু বাপ-দাদার ভিটেয় তো বারোয়ারি পায়ের ছাপ পড়ে না হামেশা! মনে মনেই তক্কেলকে কথাগুলো বলেন আজমত। মুখে রা করেন না আর। তার হাতে মাছ দেখে টাকার গরমে সেটা কিনে ফেলতে চায় তক্কেল! হারামজাদার সাহস কত! এই সেদিনও তাদের বাড়ির দাওয়ায় গিয়ে একমুঠো ভাতের জন্য বসে থাকত তক্কেল! এই কদিন আগেও তাদের হালের গরু নিয়ে তাদেরই ক্ষেতে চাষ করত তক্কেল আর তার বাপ নাদের শেখ! এখন নাদের শেখ নেই। তক্কেল তার বাপের ভিটেটাকে তুলে দিয়েছে ডেভলপারের হাতে। ভিটে নয়, তক্কেল তার মাকেই বরং তুলে দিয়েছে ভাড়াটে খদ্দেরদের হাতে। আজমতের তেমনই মনে হয়। আজমতের মৃত্যুর পর তার ছেলেরাও এমন কিছুই করবে, তাতে আজমতের নিজেরও সন্দেহ নাই যদিও।

কী কাকা? কথা কও না যে? মাছটা বেচবা না? বেচলে দিয়া যাও, পাঁচশ ট্যাকা দিতাছি!

তোর ম্যালা ট্যাকা, না রে তক্কেল?

তা তোমাগোর দোয়ায় আছে কিছু কাকা! বেচবা মাছ?

না। আমার তোর মতো অত ট্যাকা নাই রে তক্কেল। তয় রুচিটুকুন আছে। অইডাই সম্বল। মাছ বেচমু না, খামু।

বলে নিজের পথে হনহন হাঁটতে থাকেন আজমত। এই বয়সেও শরীর যথেষ্ট বল তার, কোনোদিন লাগামছাড়া জীবনযাপন করেননি তিনি, কখনো অতিরিক্ত খাবার তোলেননি মুখে। স্বল্পাহার আর পরিমিত জীবনযাত্রাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন, রেখেছে বয়সের তুলনায় যথেষ্ট শক্ত ও সুস্থ। শুধু বংশসূত্রে পাওয়া শ্বাসকষ্টটাই যা জ্বালিয়ে মারছে এই শেষ বয়সে এসে। নইলে অন্য অনেকের থেকে তিনি সুস্থ এখনো, বিশেষত তার নবাব স্বভাবের তিন পুত্তুরের চে। তেনাদের তিনবেলা খাবার নিয়ে যেমন বড়লোকি চাল, শরীরে রোগেরও তেমন দখলদারিত্ব। ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিসসহ আরও কী কী সব বাহারি নামের রোগ তারা বাগিয়ে বসেছে এই বয়সেই। ব্যাটাদের নুন আনতে পানতা ফুরোয়, কিন্তু ভাব-সাবে জমিদারি আছে ষোলো আনা। হুরি বেগম বরং ভালো আছে তাদের তুলনায়। কোমর নুয়ে এসেছে, শরীরে বাতের ব্যথা, তবু খালি চোখে এখনো দিব্যি সুতা পরায় সূঁচে, তিনবেলা ঠিকই আজমতকে রেঁধে-বেড়ে খাওয়ায় তিন ছেলে-বউয়ের মুখে ঝামা ঘসে।

মাছটা দেখে হুরি বেগমও খুশি হয়ে উঠলেন। পরমুহূর্তেই মুখ মলিন হল তার।

কী দিয়া খাইবা মাছ? লাউ তো আনো নাই?

লাউ আনমু ক্যামনে? ট্যাকা কই?

তয়?

আলু নাই ঘরে?

হ। আছে।

আলু দিয়া মাখা মাখা ঝোল রাইন্ধা ফালাও।

আইচ্ছা।

রাত্রি ঘন হওয়ার আগেই ধোঁয়া ওঠা শাদা ভাত আর শৌল মাছের ঝোল আজমতের সামনে রেখে নামাজে বসেন হুরি বেগম। আজমত একাই খেতে বসেন অগত্যা। অবশ্য বেশিরভাগ সময় একাই খান তিনি, হুরি বেগম কারও সামনে খেতে বসেন না সচরাচর, তার নাকি শরম করে তাতে। শাদা ভাতের সঙ্গে আলু দিয়ে রান্না করা গরম-মসলার দারুণ গন্ধ ছড়ানো শৌল মাছের গা-মাখা ঝোল অমৃতের মত লাগে আজমতের। ধীরে-সুস্থে খেতে থাকেন আজমত, ভরপেট খেলে সমস্যা হয় তার, শ্বাসকষ্ট বাড়ে, ফলে প্লেটে অল্প ভাত মেখে সময় নিয়ে খান, তাতে অল্পতেই খিদে মেটে, শ্বাসকষ্টটাও নিয়ন্ত্রণে থাকে খানিকটা। শোল মাছটা জব্বর রেঁধেছে হুরি বেগম। আরাম করে খাচ্ছিলেন আজমত। বাদ সাধল বড় ছেলে মোবারক আলী। ঘরের দাওয়ার নিচে দাঁড়িয়ে সে হাঁক ছাড়ল জোরে, আব্বাজান কি ঘুমাইছেননি?

মোবারকের হাঁকে থমকালেন আজমত। মুখের ভাতটা পেটে চালান করে পানি খেলেন ঢকঢক। তারপর গলা তুলে বললেন, ঘুমাইলে কি বাত্তি জ্বলে ঘরে? খাইতে বসছি। ক্যান, কী হইছে, এই রাইতে আমার তোয়াজ ক্যান?

তুমার লগে দরকারি আলাপ আছিল আব্বাজান।

ভিত্রে আহো। খাইতে বসছি আমি।

বাতির টিমটিমে আলোয় আজমত ব্যাপারি দেখেন শুধু বড় ছেলে নয়, পেছনে মেজ আর ছোটও এসে বসে তার কুঁড়ে ঘরে পেতে রাখা ছোট্ট খেজুরপাতার পাটিটায়। তাদের দেখে একটু সরে বসেন আজমত। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে যায় তার। আহা। কত আদরের সন্তানেরা তার। কত যত্নে তাদের বড় করে তুলেছেন আজমত ব্যাপারি আর হুরি বেগম! কোলেপিঠে করে মানুষ করে তুলেছেন। অথচ আজ এক পৃথিবী সমান দূরত্ব এই সন্তানদের সঙ্গেই। বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে তারা। হাঁড়ি আলাদা, সুখ-দুঃখগুলোও কবে আলাদা হয়ে গেছে যে, টেরই পাননি আজমত আর হুরি বেগম। হঠাৎ একদিন চমকে দেখলেন ছেলেরা ঢের দূরে সরে গেছে, যোজন যোজন ফারাক তৈরি হয়েছে তাদের সঙ্গে! আজমত সহসাই একদিন আবিষ্কার করলেন সেই অনতিক্রম্য দূরত্ব, অপ্রতিরোধ্য বাধা । প্রথম প্রথম কষ্ট হয়েছিল ভীষণ। হুরি বেগম মানতেই চাইতেন না সেই রূঢ় বাস্তবতা, ঝগড়া করতেন ছেলে-বউদের সঙ্গে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলতেন। কিন্তু একসময় মানিয়ে নিলেন তিনিও, নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলেন পরিস্থিতির সঙ্গে। এখন ছেলেদের সামনেই রান্না করে দিব্যি ঘরে নিয়ে এসে পা ছড়িয়ে খেতে বসেন হুরি বেগম। ছেলেদের ঘরে কী রান্না হল, ভুলেও সে খবর নিতে যান না আর।

খাইছ তুমরা, বাপজানেরা? হাত ধুতে ধুতে বললেন আজমত।

হ আব্বাজান, খাইছি। সমস্বরে বলল তিনছেলেই।

শৌল মাছ রানছি, খাইয়া দেখ বাজানসগল, স্বাদ হইছে খুউব! নামাজ সেরে উঠতে উঠতে বললেন হুরি বেগম।

ছেলেরা উসখুস করে। তারা এসেছে জরুরি আলাপ সারতে। শৌল মাছে তাদের তখন মন নাই মোটেই। তারা বলে, তারা মাত্রই খেয়ে এসেছে, খাবে না আর। হুরি বেগম ওসবে কর্ণপাত করেন না, বাটিতে মাছ তুলে বাড়িয়ে দেন ছেলেদের দিকে। বলেন, টাটকা মাছ রানছি। খাইয়া দেখ। ভাত না খাইলে না খা, মাছই খা খালি।

অগত্যা খায় তারা। মায়ের রান্নার স্বাদ তাদের ক্ষণিকের জন্য ভুলিয়ে দেয় সব, মাছের সঙ্গে তাই খানিকটা ভাতও চেয়ে নিয়ে খায় শেষে।

কী দরকারি কথা কইবা, কও এইবার বাজানেরা, তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়ছি আমি, শীত লাগতাছে জব্বর!

ছেলেদের খাওয়া দেখতে দেখতে অতীত দিনগুলো মনে পড়তেই, দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলেন আজমত। বাপের কথায় ছেলেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে পরস্পর। মেজ ছেলে মনজিল আর ছোট ছেলে মোকসেদ বড় ভাই মোবারকের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমিই আব্বাজানরে ঘটনা খুইলা কও ভাইজান।

অগত্যা চোখে প্রশ্ন নিয়ে বড় ছেলে মোবারকের দিকে তাকান আজমত। চোখের দৃষ্টি অনেকটাই ঝাপসা এখন, টিমটিমে কুপির আলোয় মোবারকের মুখটা আরো ঝাপসা লাগে তার কাছে। তবু মোবারকের মুখের ওপর দুলতে থাকা অস্বস্তির পর্দাটা বেশ স্পষ্টই দেখতে পান তিনি। মোবারক ইতস্তত করে। মা আর ভাইদের দিকে তাকিয়ে খানিকটা সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করে সে। তারপর অনাবশ্যক গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, আব্বাজান, যুগ বদলায়া যাইতাছে। আমাগোরেও তো যুগের লগে তাল মিলায়াই চলন লাগব। না হইলে তো আমরাই পিছনে পইড়া যাইতাছি সগ্গলের থন।

কী কইবার চাও সিডা কও তো বাজান। প্যাচাল ভালা লাগে না এখুন।

আব্বাজান, আইজ খবির চাচা আইছিল।

কী কয় সে? আমার কাছে না আইসা সে চোরের লাহান তুমাগের কাছে আসে ক্যান?

আপনের কাছে আইতে চাচার নাকি ডর করে। চাচা কইতাছিল, তার চেনাজানা এক বড় পার্টি আছে, তারা আমাগোর জমির ওপর বিরাট বিল্ডিং করতে চায়। তারা আমাগের মেলাগুলো ফিলাট তো দিবোই, লগে নগদ ট্যাকাও দিবো ঢের!

এই কথা কইবার লাইগা তুমরা এই শীতের রাইতে দল বাঁইধা আইছ? আমি তো তুমাগের ম্যালাবার কইছি বাপ, আমার বাপ-দাদা চৌইদ্দপুরুষের এই ভিটাখান আমি বাঁইচা থাকতে কোনো বারোয়ারি লোকের হাতে তুইলা দিবার পারুম না। তুমরা তো ম্যালাদিন সবুর করছো বাজানেরা, আর কয়টা দিন সবুর করবার পারবা না? আমার বয়স তো কম হয় নাই বাজান, মরার আর বেশি দেরি নাই। আর অল্প কিছুদিন সবুর কর, আমি মরার পর তো তুমরাই পাইবা সব, তহুন যারে খুশি দিয়ো, বিরাট বড় বিল্ডিং উঠাইয়ো, আমি দেখবারও আসমু না, বাধাও দিবারও আসমু না।

এরপরে আর কথা চলে না। ছেলেরা বিরসবদনে এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ে। চলে যায় অগত্যা তখনকার মতো। আজমত শুয়ে পড়েন। এই নাটক আজ নতুন নয়। অনেকদিন ধরেই চলছে। অনেক বছর। ছেলেদেরও দোষ নাই আদতে। লেখাপড়া বিশেষ শেখেনি তারা কেউই। আয়-রোজগার ভালো নয় তাদের। সংসার আর সন্তান নিয়ে হিমশিম অবস্থা সবারই। ভালো থাকতে, ভালো পরতে কে না চায় জগতে! চারদিকে লোভের হাতছানি, প্রাচুর্যের প্রলোভন। সেসব অগ্রাহ্য করা সহজ তো নয়। ছেলেদের মন্ত্রণা দেয়ার লোকেরও অভাব নাই। দিন-রাত্রি ফুঁসলাচ্ছে তাদের, বাপকে চাপ দিয়ে ভিটেটুকু ডেভলপারের হাতে তুলে দিলেই যেন শান্তি নামবে পৃথিবী জুড়ে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আজমত। আজানের শব্দে ধড়মড়িয়ে বসলেন উঠে। বুকের ভেতর ধড়ফড়ানিটা খানিক সয়ে এলে বিছানা ছাড়লেন।

কী যে ছিনাল যুগ আইলো দ্যাশে! শালা! ভোরের আজান ভারি মিঠে সুর হয়ে কানে বাজত আগে, মনে ভক্তির ভাব জাগত দারুণ। আর এখন! মাইকের প্রচণ্ড শব্দ কানে তালা লাগিয়ে দেয়, বুকের ভেতর ভয় ধরিয়ে দেয় হঠাৎ ঘুমে! কত যে ছিনালি দেখন বাকি আছে আরো এই জন্মে! ওযু সেরে কুলি ফেলতে ফেলতে ভাবলেন আজমত। মসজিদে যান না তিনি বহুকাল। ঘরের কোনায় কোনায় মসজিদ এখন, ক্ষমতার বাহাদুরি আর পয়সার জোড় দেখাতে যে যেখানে ইচ্ছে মসজিদ তুলছে আর মাইক লাগাচ্ছে, বেকুবের দল সব। দলাদলি এড়িয়ে চলেন আজমত, নিজের ভিটেই মসজিদ তার কাছে, নিজের ভিটেই স্বর্গ। নিজের ভিটের মরে আসা বকুল গাছটার তলায় গামছা বিছিয়ে একাই নামাজ সারেন আজমত। আল্লাহর কাছে পানাহ চান ভেজা চোখে।

খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ি চিবিয়ে ভোরের মিষ্টি রোদে বেরোলেন আজমত। বহুদিন বাদে চারপাশটা ভালো করে দেখলেন মনোযোগ দিয়ে। চারিদিকে শুধু দালান আর দালান। বিশাল দৈত্য যেন একেকটা। হা করে যেন গিলে খাবে আজমতকে। থমকে দাঁড়ালেন আজমত। আহা। সামনের ওই উঁচু উঁচু দালানগুলো! ওখানে ছিল মুন্সিদের বিশাল শান বাঁধানো দীঘি। মুন্সিবাড়ির সবাই শহরে থাকত, এখানকার বিশাল বাগানবাড়িটা খালিই থাকত প্রায় সারা বছর। এখানকার পাট চুকিয়ে তারা সেই কবেই শহরে চলে গেছে। তাদের চিহ্নও নাই আর। এখন বড় বড় বিল্ডিং উঠেছে সেখানে। ডেভলপাররা দেদারসে ফ্ল্যাট বিক্রি করছে চড়া চামে, কে বলবে এখানে কোনোকালে অজপাড়া-গাঁ ছিল! বেশিরভাগই ছিল ধানি জমি আর ডোবা-নালা। দিনের বেলায়ও একা এদিকে আসতে সাহস পেতেন না আজমতেরা, গা ছমছম করত ভয়ে। নাই। সেসবের কোনো চিহ্নও নাই আর। সব ভরাট হয়ে গেছে। সব গিলে খেয়েছে শহর নামক এক লোভি দৈত্য। আজমতের পায়ের ঠিক নিচেই ছিল ইয়াছিন মোল্লার দশবিঘা দাগের ধানি জমি। অভ্যাসবশে একে একে সব বেচে খেয়েছিল ইয়াসিন মোল্লা। একটা করে জমি বিক্রি করত আর ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বসে বসে খেত। সবশেষে নিজের ভিটেটাও বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে অনেক দূরের কোনো গ্রামে। তার ছেলেরা এখন এইসব নির্মিয়মান বিল্ডিংয়ে শ্রমিকের কাজ করে, জন খাটে। এখানকার আদি বাসিন্দাদের বেশিরভাগেরই ভাগ্য এই ইয়াসিন মোল্লার মতই। যারা মাটি কামড়ে এখনো পড়ে আছে তারা সবাই তক্কেলের মতো নিজ ভিটেয় আশ্রিতের মতো আছে। ডেভলপারের মোটা টাকার হাতছানিকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি কেউই। আজমত একা স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছেন এতকাল। ছেলেরাও সঙ্গে নেই তার। তারাও যেন ডেভলপারেদেরই সাগরেদ বনে গেছে, তাদের কথা-বার্তায় তেমনই মনে হয় আজমতের। বাপের ভিটে-লাগোয়া পুকুরটা ভরাট করে নিজেদের থাকার জন্য আলাদা ইটের ঘর তুলেও সাধ মেটেনি তাদের, মন ভরেনি ছেলে-বউদের। তাদের বড় দালান চাই। ফ্ল্যাট বাড়ি চাই। আজমতের বড় আফসোস হয় আজকাল। কেন যে লেখাপড়াটা শেখেননি ছেলেবেলায়! তার বাপ যখন পানির দরে একের পর এক ধানি জমি বিক্রি করে দিচ্ছিলেন ভূমিদস্যুদের কাছে, কেন যে তাকে তখন থামাননি আজমত! যখন বুঝলেন আজমত, তখন আর সময় ছিল না। ততদিনে ধানি জমি সব হাতছাড়া হয়ে গেছে তাদের, বাপজান ততদিনে সব দেনা-পাওনা চুকিয়ে বিদায় নিয়েছেন জীবন থেকে, নিজের বলতে তখন ভিটেটুকু ছাড়া আর কিছুই নাই আজমতের। তবু, এত বিরুদ্ধস্রোতে দাঁড়িয়েও সেই ভিটেটুকুই পরম মমতায় আগলে রেখেছিলেন আজমত। ছোটখাট ব্যবসার সামান্য আয়-রোজগারেও ছেলেদের পড়াশোনা শেখানোর চেষ্টা বড় কম করেননি তিনি। কিন্তু কাজ হয়নি। পড়াশোনায় মন ছিল না ছেলেদের কারোরই। চুলে টেরি কেটে, হাওয়াই চপ্পল পায়ে বাবুয়ানিতেই বেলা গেছে তাদের। এখন বাবুদের নজর এই ভিটেটার দিকে। ডেভলপারের হাতে এটুকু দিতে পারলেই যেন সব সমস্যা মিটে যাবে, নবাবি চালে চলতে পারবে তারা, তেমন-ই ভাবগতিক তাদের। বেকুবের দল বোঝে না, বসে খেলে রাজার গোলা-ও ফুরিয়ে আসে একসময়। আহা। আজমতের বাপের কী যে উর্বরা ধানি জমি ছিল সব! সোনা ফলত সবগুলোয়। বাপের বোকামিতে সব খুইয়েছেন আজমত। এখন যদি থাকত সেসব জমি, কয়েক কোটি টাকা দাম হত একেকটার। এখন শতকের হিশেব। তার বাপ বিক্রি করেছিলেন বিশহাজার টাকা বিঘা! অথচ এখন একেক শতাংশ বিক্রি হচ্ছে বিশ লাখে! মাঝে মাঝে ভীষণ আফসোস হয় আজমতের। বাপের ওপর রাগ হয় প্রচণ্ড। পরক্ষণেই নিভে যায় আগুন। আহা। তিনি একা তো নন। এ তল্লাটের ভূমির প্রকৃত মালিক যারা ছিল, সবার দশাই তার বাপের মতোই। উচ্ছেদ হয়ে গেছে তারা সবাই সময়ের নিদারুণ রোষে। দক্ষিণদিকের আলিশান দশতলা দালানটার দিকে তাকিয়ে চোখে জল আসে আজমতের। ওখানে তার দাদা আর দাদার বাপের কবর ছিল এককালে। ধানি জমি খানিকটা উঁচু থাকায় ওখানেই কবর দেয়া হয়েছিল তাদের। সেটাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন তার বাপ করিম ব্যাপারি। দালানটার দিকে তাকিয়ে বুকটা টনটন করে আজমতের। মনে হয়, তার দাদাজান আর বড় বাপজানের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যেন দৈত্যটা। আজমতের মনে হয়, সদ্য গড়ে ওঠা বহুতল এই  দালানগুলো, এই লোকালয়, হঠাৎ ঝাঁকের কইয়ের মতো ভেসে আসা এইসব কৃত্রিম আচারনিষ্ঠ অপরিচিত সব মানুষজন, এরা সবাই যেন আজমত আর তার বাপ-দাদাদের বুকের ওপর ক্রমশ চেপে বসছে জগদ্দল পাহাড় হয়ে। আজমতের হাঁসফাঁস লাগে, দমবন্ধ হয়ে আসতে চায়। ঘোলা চোখে ব্যাঙের ছাতার মত সদ্য গজিয়ে ওঠা দালানগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়, দালান নয়, বরং আকাশ ছোঁয়া একেকটি কবর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। নির্মিয়মান সারি সারি কবরগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আজমতের। কাঁধের গামছা টেনে নিয়ে নিজের ঘোলাটে চোখ সাবধানে মুছে নেন আজমত। বুকের ভেতর একটা বোবা কান্না গুমড়ে ওঠে তার। উত্তরে হাঁটেন আজমত। সকালের রোদটা মিষ্টি এখনো। শ্লথ পায়ে প্রায় বুজে আসা ঝিলের পাশে গিয়ে বসেন আবার। বড়শি থাকলে মাছ ধরার চেষ্টা করা যেত। মনে মনে একবার আফসোস করেন আজমত। পরক্ষণেই ঝেড়ে ফেলেন সেটা মন থেকে। কী হবে আর মাছ ধরে। কদিন বাদেই ঝিলটাও ভরাট হয়ে যাবে পুরোপুরি। আকাশছোঁয়া দালান উঠবে এখানেও। তখন কোথায় মাছ ধরবেন আজমত? কোথায়ই-বা বসে দু দণ্ড জিরোবেন, ভাববেন বসে তার নিতান্তই বাজে কাজে খরচ হয়ে যাওয়া পুরো একটি জীবনের কথা! ভেবে থই পান না আজমত। ঝিলের নোংরা জলে তাকিয়ে দেখেন দারুণ ঝকঝকে সূর্যটা কেমন উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে দিয়ে হাসছে রঙধনু রঙে। মুহূ্র্তে বিষাদে মুষড়ে পড়েন আজমত। জগত হাসছে। হাসছে চারপাশ। আজমতের বিষাদে মোটেই বিষণ্ণ নয় তারা। শুধু আধবোজা ওই ঝিলটাই তার মরে আসা নোংরা শরীর নিয়ে আজমতের ঘোলা চোখে চোখ রেখে কী যেন বলতে চায়। মৃত্যুযন্ত্রণায় যেন গোঙায়। আজমতের কানে স্পষ্ট বাজে ঝিলটার অস্ফুট গোঙানি। কান চেপে ধরে উঠে পড়েন আজমত। ধীর পায়ে বাড়ির পথ ধরেন। আর বেশিদিন নেই। মরে আসা ওই ঝিলটার বুকের ওপরও গড়ে উঠবে ঝাঁ-চকচকে বহুতল কবর। তার নিচে চাপা পড়বে আজমতের জরাজীর্ণ সংস্কার, সনাতন স্বপ্ন। বুক চিরে বের হওয়া দীর্ঘশ্বাসটা সাবধানে হাওয়ায় ছেড়ে দেন আজমত। পায়ের নিচে বালু তেতে উঠেছে ততক্ষণে, একসময় যেখানে ঝরাপাতার মর্মর বাজত হাওয়ায়, বেজে উঠত হাওয়ার নূপুর। আজ সেখানে বালু ওড়ে, ধূলো। কাশির দমক ওঠে আজমতের। বুকটা ভেঙে যেতে চায় সহসা। আজমত ক্রমবর্ধমান এই কংক্রিটের দৈত্যের হাত থেকে পালাতে চান।  মুহূর্তেই ধেয়ে আসা হাওয়া লুফে নেয় তার বাহুল্য দীর্ঘশ্বাস। ঘূর্ণি তুলে ওড়ে, আজমতের চারপাশে অকারণে ঘোরে।

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!