• ঢাকা
  • সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব : রুদ্রের কবিতা


সাদাত উল্লাহ খান
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২৩, ০৩:০৪ পিএম
সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব : রুদ্রের কবিতা

Like many areas of Sociology, the sociology of literature has a distinguished as will as uncertain history.
        (Diana Laureeuson and A. Swingewood. 1972

 

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৯৫৬-১৯৯১) স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের বাংলাদেশের প্রতিবাদী কণ্ঠ। কবি মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে অনেক কবিতা, গান, গল্প, একটি কাব্যনাট্য ও চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। তাঁর পরিচিতির শুরুতেই লেখা হয়, “বাংলা প্রতিবাদী কাব্যধারায় রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এক অনিবার্য নাম। মুক্তিযোদ্ধাত্তর বাংলাদেশের উত্তাল কালপর্বে আবির্ভূত এই কবি একাধারে দ্রোহ ও প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের নিবিষ্ট সাধক। মাটি, মানুষ ও ঐতিহ্যের প্রতি আমৃত্যু দায়বোধ তাঁর কাব্যের মৌল শক্তি। সকল অসাম্য, শোষণ, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উচ্চারণ তাঁকে পরিচিতি দিয়েছে ‘তারুণ্যের দীপ্র প্রতীক’-এ।” এই কবি ছিলেন সার্বিক অর্থে একজন জনদরদি ও মুক্তিকামী মানুষ, সমাজ পরিবর্তনের সৈনিক। তাঁর কবিতার লাইনে লাইনে রয়েছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং অন্যায়, অবিচার, অসাম্যের প্রতিবাদ। আমার এই সামান্য লেখার মূল লক্ষ্য তাঁর কবিতার সমাজতত্ত্ব। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার সমাজতত্ত্ব নিয়ে খুব বেশি বিশ্লেষণ দেখা যায় না। আমি এখানে কবির মাত্র একটি কবিতা ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ নিয়েই আলোচনা সীমিত রাখব।

আধুনিক সাহিত্য-সমালোচকরা দেখিয়েছেন যে একটা শিল্পের, একটা কবিতার একাধিক ব্যাখ্যা হতে পারে। একটা কবিতাকে নানা দিক থেকে, নানা মতবাদের আলোকে বিচার করা যেতে পারে। বর্তমানে সাহিত্য-সমালোচনার নানা মতবাদ, পদ্ধতি বিদ্যমান। যেমন আছে পাঠক/পাঠিকাকেন্দ্রিক সমালোচনা, আধুনিকতা/উত্তর-আধুনিকতা, কাঠামোবাদ/উত্তর-কাঠামোবাদ, বিনির্মাণ, মনবিচারমূলক সমালোচনা, নারীবাদী সমালোচনা, মার্কসবাদী সমালোচনা, সাংস্কৃতিক সাহিত্যতত্ত্ব বা নতুন ইতিহাসবাদী সমালোচনা, উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদী সমালোচনা, কুইয়ার মতবাদ বা সমকামী সমালোচনা এবং পরিবেশবাদী সমালোচনা। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতাকে তাই নানা দিক থেকে সমালোচনা করা যেতে পারে। শুধু একটি মতবাদের আলোকে রুদ্রের কবিতা বিচার করা যথার্থ বা সঠিক হবে না। তাই নানা দিক থেকে তাঁর কবিতা আলোচনা করার চেষ্টা করব।

সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিক বাংলা কবিতা নিয়ে সমালোচকদের বা পাঠক/পাঠিকার অভিযোগের কোনো শেষ নেই। আধুনিক বাংলা গদ্য কবিতার সঙ্গে পাঠকের দূরত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। সমালোচক, পাঠক/পাঠিকার অভিযোগ আধুনিক বাংলা গদ্য কবিতা পড়ে কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। তেমন কোনো অর্থ, বক্তব্য, আবেদন বা প্রাণশক্তি বহন করে না। পাঠক/পাঠিকার মনে বা মগজে কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। কবিতা পাঠক/পাঠিকার মনে ও চিন্তায় প্রভাব সৃষ্টি করতে পারছে তেমন লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না। ফলে সমালোচকদেরও সমালোচনার কোনো মাপকাঠি দেখতে পাওয়া যায় না। আধুনিক বাংলা গদ্য কবিতা পাঠক/পাঠিকার চিত্তে আবেদন তৈরির চেয়ে অভিযোগ বেশি জন্ম দিচ্ছে। 
  
আধুনিক বাংলা গদ্য কবিতা যত বেশি রাজনীতিবিহীন হচ্ছে, তত বেশি আবেদন, বক্তব্য ও মনোযোগ হারাচ্ছে। এটা কবিতার জন্য তেমন কোনো সুসংবাদ নয়। তাই কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন জোরালো আলোচনা দেখা যায় না। তবে বক্তব্যপ্রধান, আবেদনধর্মী ও রাজনৈতিক ধারার কবিতা এখনো মানুষের প্রাণের দাবি। রাজনৈতিক ধারার কবিতা, দ্রোহের কবিতা এখনো মানুষের ভাবায়, উদ্দীপ্ত করে, বিদ্রোহী করে তোলে, প্রতিবাদে সাহসী করে তোলে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে, আরও যথার্থ অর্থে বাংলা কবিতার ইতিহাসে রাজনৈতিক ধারা ও প্রতিবাদী কবিতা মানুষের মুক্তির মিছিলে, স্বাধীনতাসংগ্রামে সর্বদা আবেগ দিয়েছে। আবার স্বাধীনতাসংগ্রাম বাঙালি জীবনে একটা অনন্য ও ঐতিহাসিক ঘটনা। এ ঘটনা একই সঙ্গে যেমন আনন্দের তেমনি আবার বেদনার, কষ্টের, দুঃখের। এই আনন্দ ও বেদনার চিত্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে, বিশেষ করে বাংলা কবিতায় সর্বাধিক নান্দনিক উপায়ে তুলে ধরেছেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তাঁর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা। এই কবিতাতেই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে। এই কবিতার নানামুখী ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভব এবং সঙ্গে সঙ্গে জরুরি এ কথাও বলা যায়, এটি প্রতিবাদী কবিতার একটা অনন্য উদাহরণও বটে। আধুনিক বাংলা কবিতার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ—এই কবিতা সবকিছুর জবাব বলা যায়। কবি লিখেছেন ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই’। বাতাসে লাশের গন্ধ কেন? কারা এই লাশ ফেলেছে? কী কারণে বাংলার বাতাসে লাশের উপস্থিতি?

অনেক জীবনের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এই কবিতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, নির্যাতনের কথা। সংগ্রামের কথা, যুদ্ধের কথা কাব্যের মাধ্যমে কবি জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রামে যত নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে তারই বয়ান হলো এই কবিতা। এই কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে সব পাঠক/পাঠিকার মনের চোখে ভেসে ওঠে করুণ চিত্র। ধর্ষিতার চিৎকার যেন বাস্তবে আমরা শুনতে পাই। সমগ্র জাতির সামনে কবি প্রশ্ন তোলেন :
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?

কবির এই প্রশ্ন অত্যন্ত যৌক্তিক, বাস্তবিক ও প্রাসঙ্গিক। এ দেশে যখন সেই ধর্ষক, নিপীড়ক, রাজাকার, আলবদর বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় আসীন হয়—তখন কেমন লাগে? বাংলাদেশের এই চিত্র কবি তাঁর দূরদৃষ্টিতে কল্পনায় হয়তো দেখতে পেয়েছিলেন বলেই হয়তো এমন কবিতা রচনা করতে পেরেছেন। স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেন বেহাত হতে চলেছিল বলা যায়, এই কবিতা তারই প্রতিবাদ। পাঠক/পাঠিকার মনে প্রশ্ন জাগে, কবি কি তাঁর কবিতায় বাংলার ভবিষ্যৎ চিত্র দেখতে পেয়েছিলেন? এই কবিতা যেন বাংলার রাজনীতির মানচিত্র। স্বাধীনতার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাঁরা যেন খাঁচায় বন্দি। তাই তো কবি প্রশ্ন তোলেন: ‘স্বাধীনতা—একি তবে নষ্ট জন্ম?’

কাব্যপ্রেমী দেশপ্রেমী যেকোনো চিন্তাশীল মানুষকে এই কবিতা বড় ধরনের প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কেন এমন হলো? কবির বড় সার্থকতা সমগ্র জাতিকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করানো। এটা যেমন কবিতার শক্তি, তেমনি কবির ক্ষমতাও। তার এই কাব্যক্ষমতা ও প্রকাশক্ষমতা তাঁকে বাংলা কবিতার ইতিহাসে অনন্য স্থান ও সম্মান দিয়েছে।

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদের জন্যও যেন বড় শিক্ষক। তিনি রাজনীতির গতিবিধি অনেক দূর থেকে খুব স্পষ্ট করে দেখতে পেয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুরোনো শত্রুদের হাতে বন্দি। বাংলার স্বাধীনতা যেন বেহাত হতে চলেছে। তাই কবি দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছেন—জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন।

বাংলার রাজনৈতিক আকাশে শকুনের চক্র সংঘবদ্ধ হয়েছে স্বাধীনতার ফসল টুকরো টুকরো করে গিলে খাচ্ছে কবি টের পেয়েছেন। তাই কবির বড় ভাবনা। বাংলার রাজনীতিতে কালো মেঘের উপস্থিতি কবি জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব কাব্যের মাধ্যমে কবি চমৎকারভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এখানেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে, বিশেষত বাংলা কবিতায় রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর আলাদা স্থান ও মর্যাদা। বাংলা কবিতায় কবি নজরুলের পরে দ্রোহী কবিতায় কবি রুদ্রই একমাত্র ব্যক্তিত্ব—যাঁর কবিতা মানুষকে সমানভাবে আন্দোলিত করে—জাগ্রত করে এবং দেশপ্রেমে উৎসাহিত করে। এই একটি কবিতাই—সমগ্র বাংলা কবিতাকে সম্মানের আসনে নিয়ে আসে। কবিতার আবেদন, কবিতার বক্তব্য, কবিতার প্রাণশক্তি অবশ্যই পাঠক/পাঠিকাকে আকর্ষণ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বলা যায়, কবিতা যেমন প্রতিবাদ, তেমনি প্রেরণার উৎসও। তাই রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ও তাঁর কবিতা আমাদের শক্তি, সাহস, প্রেরণা ও প্রতিবাদের উৎস।

সমাজের করুণ চিত্র কবি চমৎকারভাবে অঙ্কন করেছেন। স্বাধীনতার জন্য একদল মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন। আবার সমাজের অন্য একদল মানুষ মানুষের রক্ত, মাংস শোষণ করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছে। একদল জান-প্রাণ দিচ্ছে আবার অন্য দল রক্ত শোষণ করছে। এই যে সমাজের বিপরীত চিত্র কবির চিন্তায় সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে। কবি লিখেছেন:
  মাটিতে রক্তের দাগ—
  চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।

পরাধীন যুগে সমাজের চিত্র ভয়াবহ ছিল। তবে ঔপনিবেশিক যুগের পর স্বাধীনতার যুগেও কি মারাত্মক চিত্র। এই ভয়াবহ চিত্র কবির সহ্য হয় না। এই স্বাধীনতা নিয়ে কবি উদ্বেগে আছেন, উৎকণ্ঠায় আছেন। সেই উৎকণ্ঠায় কবি যেন বিচলিত। কবি বলেন:
        
এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার গুম আসে না
    তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুন চিৎকার
    নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,
    মুন্ডুহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর
    ভেসে উঠে চোখের ভেতরে—আমি ঘুমুতে পারি না,
                আমি ঘুমুতে পারি না।

বাঙালি কি বুঝতে পেরেছে স্বাধীনতার মূল্য? কত বোন, কত মা প্রাণ দিয়েছে, লাশ কুকুরে খেয়েছে—নদীর পানিতে ভেসে গিয়েছে। তাই বাতাসে লাশের গন্ধ। এই গন্ধের দাম অনেক— মূল্য দিয়ে বিচার করা যাবে না। অর্থ দিয়ে কোনো বিনিময় হবে না। এই কথা, দুঃখ, বেদনা, যন্ত্রণা কবিকে ঘুমুতে দেয় না। স্বাধীনতার জন্য যে সবকিছু হারিয়েছে—সব প্রিয়জনকে হারাতে হয়েছে। এমন সব হারানোর ফসল স্বাধীনতা। তাই কবি লিখেছেন:
স্বাধীনতা—সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।

স্বাধীনতার এই অমূল্য ফসল কি দেশবাসী ভোগ করতে পারছেন? সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর ভোগবিলাসে যাচ্ছে? এই স্বাধীনতা কি আমরা অর্থবহ করতে পারছি? সেই পুরোনো শকুন রাজনীতির আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে—তাই কবির মতো সমগ্র জাতি ঘুমাতে পারছে না। এখনো সত্যিই বাতাসে লাশের গন্ধ। তাই তো লাশের গন্ধে ঘুম আসে না। সত্যিই ঘুম কি আসতে পারে? বাঙালি সমাজ এখনো নির্ঘুম আছে। বাতাসে নয় এখন সমাজের সর্বত্র লাশের গন্ধ। গন্ধ আর গন্ধ।
 

Link copied!