• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

ইউসুফ মুহম্মদের ‘নেহাই’


মুহাম্মদ ইসহাক
প্রকাশিত: জুন ১০, ২০২২, ০২:১৪ পিএম
ইউসুফ মুহম্মদের ‘নেহাই’

মনের আবেগ ও হৃদয়ের মর্মকথার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবির কবিতায়। যেখানে জড়িয়ে রয়েছে মানবজাতির নানান অনুষঙ্গ। প্রেম-বিরহ-প্রকৃতি ও মানবতার অপরূপ দৃশ্যের মেলবন্ধন ঘটেছে এ দোঁহা-কাব্যগ্রন্থে। নদী, সাগর-মহাসাগর, পাহাড় -পর্বত এবং সমাজ-সংস্কৃতি তথা মানুষ তাঁর কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। শোকগাথা ও সুখস্মৃতির সমন্বয়ে মানুষের জীবন এক কালচক্রে বন্দি। সমুদ্রের ঢেউ, পাখির গান, বৃক্ষের সমারোহ ও বনজঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে এ ধরণি। এ সম্পর্কে কবি লিখেছেন,

“প্রকৃতি আমাকে ডাকে,

পাখিদের প্রেম লিখে দগ্ধ-প্রাণ পাখিদের কেউ নই,

তাদের অভিসম্পাত দেবো,

মানুষের মায়ালোকে অহেতুক যারা করে হইচই।”  (পৃ. ৫১)

 

‘নেহাই’ কাব্যগ্রন্থটি অমর একুশে বইমেলা ২০২২ সালে প্রকাশিত। এটি দোঁহার চতুর্থ অংশ। এর পূর্বে ইউসুফ মুহম্মদের আরো তিনটি দোঁহা-কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘নেহাই’  কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। বইটির ভেতরের অঙ্গসজ্জায় ও প্রচ্ছেদে ব্যবহৃত ছবি এঁকেছেন ভারতের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অভিজিৎ মুখার্জি। কবির  অসাধারণ সৃজনশীল চিন্তার প্রতিফলনের সাথে এসব ছবির অভিযোজন কবির বোধের উজ্জ্বল উৎসারে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে । কবি দোঁহা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন। তিনি আজ থেকে বিশ বছর পূর্বে ২০০২ সালে চন্দ্রকান্ত বৃষ্টির নিঃসঙ্গ দোঁহা -১ প্রকাশ করেন। ২০০৫ সালে দোঁহা -২ ও ২০১৯ সালে দোঁহার তৃতীয় অংশ শুধু দোঁহা নামে প্রকাশ পায়। কবি কবিতা ও সাহিত্যচর্চায় কতটা মনোযোগী, তা টের পাওয়া যায়  তাঁর শব্দচয়নের দক্ষতা থেকে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও আশা-নিরাশা-প্রত্যাশা নিয়ে মানবজীবন। কবি বলেছেন, 

 

“অকাল বর্ষণে বৃক্ষ-জাগে, কে শুনিবে এই অবেলার ডাক

সাঁঝের বেলার দুঃখগুলো একলা-নীরব; বুকের পারেই থাক।” (পৃ. ৪১)

 

দোঁহা একধরনের মরমিবাদ বা মরমি সংগীত বা মরমি কবিতা। তাতে আধ্যাত্মিক জগতের নিভৃতচারী মানুষ ও মানবতাবাদের মর্মবাণী বিস্ত‍ৃত। লালনের দর্শন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবদর্শন কিংবা শ্রী চৈতন্যের কীর্তনে ফুটে উঠেছে মানুষের অন্তরতমের বাণী। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে মানবসেবাকে প্রাধান্য দেওয়াই এ বাণীর লক্ষ্য। 

 

দোঁহা মূলত সমম্বয়বাদী দর্শনকে ধারণ করে এগিয়েছে। হিন্দি ভাষায় নাগরিলিপিতে লিখিত বেনারসের কবিরের দোঁহা বেশ পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ ছাড়া দোঁহার সাথে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন দাদু, মালিক মহম্মদ জায়সী, পল্টু দাস. গুরু নানক প্রমুখ। বেনারসের কবির ও তাঁর সঙ্গীরা যে চর্চা করেছেন, তা হলো সমন্বয়বাদী দর্শন-ধারণানির্ভর।

ইউসফ তাঁর দোঁহা-কবিতায় এ ধারা অক্ষুণ্ন রেখেও বাউলসংগীত ও বাউল দর্শনের চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে—

“বাউলের ওই একতারাতে দূরের নাচন,

উঠলো বেজে কোন্ সুজাতার মন

গঙ্গাশালিক সুর বেঁধেছে—সে সুর পোড়ায়

তাহার বাঁশির গহন ও গোপন।”  (পৃ. ৬৯)

 

বিভিন্ন সমাজে যুগ যুগ ধরে অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় গোড়ামী প্রচলিত ছিল। কুসংস্কার ও কুপ্রথার দোহাইও প্রভাবে সমাজের গোত্রে-বর্ণে-জাতি-ধর্মে  ভেদাভেদ ছিল প্রকট। মনুষ্যত্ব বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করেএ ভেদাভেদ। একশ্রেণির মানুষ সৎকর্ম থেকে দূরে সরে স্বার্থসিদ্ধিতে নিমগ্ন থাকে। ফলে সমাজে অশান্তি ও অস্থিতিশীল পরি্বেশ তৈরি হয়। তাই কুসংস্কার ও অজ্ঞতা সম্পর্কে কবি লিখেছেন, 

 

 “ঈশ্বর তোমাকে ছুঁলো, তুমি পাপ ডাকলে আড়ালে

     ফতোয়া শুনিয়ে বুঁদে, আচানক হাত বাড়ালে।” (পৃ. ৩১)

 

কবি নেহাই শব্দ দ্বারা কি বুঝাতে চেয়েছেন? কামারশালায় বড় সাইজের একটি লোহাখণ্ড শক্ত করে মাটিতেপুঁতে রাখা হয়। গনগনে আগুনে লৌহশলাকা বাপাত পুড়িয়ে ঐলৌহখণ্ডের ওপর রেখে তাতে হাতুড়ি চালিয়ে দা, কোদাল,  ছুরি, বটি, কিরিছ ও বিভিন্ন ধাতব যন্ত্র তৈরি করা হয়। এই শক্ত লোহাই মূলত নেহাই। কথিত ধরনের জিনিসপত্র মানুষের নিত্যপ্রয়োজনে লাগে। কিন্তু মানবজীবনের ওপর নানা চাপ বিদ্যমান— যেমন সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈশ্বিক ইত্যাদি। মানুষের জীবনও নেহাই-এর মতো, এসব চাপ এড়িয়ে নড়ার কোনো সুযোগ নেই। মূলত মানুষকে কেন্দ্র করে এ জীবনচক্র। কবি নেহাই-এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার বিকাশও সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করতে চেয়েছেন।  অন্যদিকে চেষ্টা করেছেন সমম্বয়বাদী চেতনার বিকাশ ঘটাতে। দোঁহা দুপঙক্তির কবিতা। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে বা বিষয় ভেদে চার  লাইন ,ছয় লাইন ও বার লাইনের কবিতাও রয়েছে। 

 

“তোমাদের মৌল-কথা-

বারুদের কণা,জাগে হিংসা ও বিদ্বেষী ফণা

প্রেম -ধর্ম-ভালোবাসা

মনের বন্ধনে ঘোচে মানুষের ঐহিক যন্ত্রণা”। (পৃ. ৬৭)

ইউসুফ ও জুলেখার প্রেমকাহিনি ইতিহাসসূত্রে কমবেশি সবার জানা। দাস-মালিকের দূরত্ব কি রকম ছিল, তাও আমাদের জানা রয়েছে। কবি নিজস্ব দর্শন ও কবিতার কারুকাজে কল্পনা শক্তিকে ব্যবহার করেছেন। ভাবনার জগতে কবি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। যাতে সাহিত্যের রস আস্বাদনে আমাদের সহজ হয়ে উঠেছে। কিতফি হলেন মিশরের তখনকার অর্থ ও খাদ্যমন্ত্রী। 

 “কিতফি* বাজার খুঁড়ে কিনে আনে দাস

 দুপুরের রোদ ছাঁকে তুরুপের তাস,

 দাসের সুরত মগ্ন জুলেখার দিল

     নাচে রঙ্গ -রস-জ্বরে, কম্পিত পাঁচিল”। (পৃ. ৮২)

 

কবি দোঁহার মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। সুন্দর ও শৃঙ্খল সমাজ বিনির্মাণের আহ্বান কবির লেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ধর্মে-বর্ণে-জাতিতে-গোত্রে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানবসমাজে অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করা একান্ত প্রয়োজন। কবি নিজেই বয়ান করেছেন এভাবে-

“কেতাবিকলস ঢেলেসুচতুর যে  তোমাকেদেখালো অন্ধের পথ

সে কি দেখেনি কখনো মানুষের লউসিক্ত চৌকাঠের শ্রান্তক্ষত”।

 

                                    অথবা

 

“অন্ধেরও চোখ থাকে  কম-বেশি দেখে!

তারা আঁধারের চেয়ে বেজায় অধম. . .

আফিম খেয়েছে যারা, জাত নিয়ে কথা কয়,

কারে দেবোরমাকান্ত, এলারকসম”।

 

                                    অথবা

 

জন্মকালে তো মানুষ ছিলাম,

নিজেকে হারিয়ে জাতে খুঁজি পরিচয়

রাম ও রহিমে, বুদ্ধ-যিশুতে

ব্যবধান বাড়ে, মানুষেই বরাভয়।

 

 

কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ জল প্রবাহে পদচিহ্ন (১৯৮৮), হাত বাড়ালেই নদী (১৯৮৯), চন্দ্রকান্ত বৃষ্টির নিঃসঙ্গ দোঁহা-১ (২০০২), বিষাদের রেখেছ কী নাম (২০০৩), চন্দ্রকান্ত বৃষ্টির নিঃসঙ্গ দোঁহা-২ (২০০৫), অর্ধেক পুতুল (২০০৭), জানালায় ঘুম (২০১০), দোঁহা - তৃতীয় অংশ (২০১৯) ও নেহাই : দোঁহা- চতুর্থ অংশ (২০২২)।

 

সম্পাদিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে : আবুল ফজল স্মারকগ্রন্থ (১৯৮৫), অ্যালবাম গণ-আন্দোলন (১৯৮২-৯০) (১৯৯৩), সুচরিত চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ (যৌথভাবে সম্পাদিত- ১৯৯৭), অশোক বড়ুয়া রচনা সংগ্রহ -১ (২০০৩) ও অশোক বড়ুয়া রচনা সংগ্রহ -২ (২০২১), কবিতার রূপ কবিতার কথা (২০১০) ও গল্প সাম্প্রতিক। এছাড়া তিনি  ১৯৭৯ সাল থেকে তোলপাড় নামে  একটি সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। এর নয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। সর্বশেষ সংখ্যাটি ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। 

 

কবি রিজোয়ান মাহমুদ ‘নেহাই: দোঁহা চতুর্থ অংশ’ সম্পর্কে লিখেছেন, “ইউসুফের দোঁহা উড়ন্ত সসারের মতো মেঘ ও আরশে গিয়ে বৃষ্টি নামায়। দোঁহার ভাবাবেগ শব্দানুভূতির কাব্যিক নির্যাস যেন ঊর্ধ্ব ও মর্ত্য থেকে আসে। ফলে, রক্ত পানি নয়, পানি-ই রক্ত হয়ে সংরক্ত অনুভূতি গভীর জীবনবোধের রূপান্তরিত সত্য। ভাববাদ-ভক্তিবাদ-মরমিবাদ-প্রেমে গতনিদ্র ইউসুফ কবির দোঁহা আনন্দিত উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি। ভক্তিবাদ যেমন চড়চড়িয়ে ওঠে তেমনি তারই নিরিখে জন্ম নেয়  ধর্ম-বর্ণ-গোত্রহীন অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ।”

আমি  কবি ও কাব্যগ্রন্থটির  সফলতা এবং  ব্যাপক প্রচার-প্রসার কামনা করছি। 

 

ইউসুফ মুহম্মদ, নেহাই :দোঁহা- চতুর্থ অংশ, প্রকাশক : আগামী প্রকাশনী, বইতে প্রকাশিত শিল্পকর্ম ও প্রচ্ছদ : অভিজিৎ মুখার্জি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২২, মূল্য : ৩৫০টাকা, পৃ.১৩২।

 

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Link copied!