নারী-পুরুষের অধিকারের সমতা নিয়ে হাজারো আন্দোলন হয়েছে। কালের প্রেক্ষাপটে জোরালো কণ্ঠে বিশ্বজুড়ে নারীর অধিকার নিশ্চিতে দাবিও উঠে এসেছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারী-পুরুষ সমতা নিয়ে বিবেদ রয়েই গেছে।
সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে এখনো নারীরা অবহেলিত, নির্যাতিত। ঘরে কিংবা বাইরে নারীরা শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেই। বিশ্বজুড়ে এখনো নারীরা নিপীড়নের শিকার। নারীদের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে কর্তৃত্ব স্থাপনে এখনো শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে বিশ্বের অনেক স্থানে।
গৃহিণী কিংবা শ্রমিক, যেকোনো রূপেই বারবার নির্যাতনের মুখে পড়ছে নারীরা। সহিংসতা এবং হয়রানির ধারাবাহিকতা অনুভব করে তারা। অবমাননা থেকে শুরু করে গুরুতর শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন, ধমক এবং ভয় দেখানো হয় নারীদের। এসব বিষয়ে সোচ্চার হতেই বিশ্বজুড়ে ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। এই বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ’।
বিশ্বজুড়ে নারীরা বিভিন্নভাবেই নির্যাতনের মুখে পড়ছে। নির্যাতনের চিত্র এখনো ফুটে ওঠে নারী শ্রমিকদের মধ্যে। নারীরা এখনো নিজ দেশে চাকরির অভাব, ঋণ, অর্থনৈতিক কষ্টে থাকে। নারীদের ওপর রোজগারের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং সেই কারণে পছন্দ ছাড়াই অনিশ্চিত কাজের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
কাঠামোগত সমন্বয় নীতি, কঠোরতা ব্যবস্থা, পাবলিক পরিষেবার কারণে নারীদের চাকরির চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে আসা নারীদেরও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিটি পদে পদে।
কম্বোডিয়ায় সাক্ষাৎকার নেওয়া নারীদের ৯০ শতাংশ বলেছেন, তারা একটি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার ঋণ পরিশোধের জন্য গার্মেন্টসে কাজ করছেন।
ব্রাজিলের নারী গার্মেন্টস শ্রমিকরা বলেছেন, বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট অর্থ উপার্জনের জন্য তাদের কর্মক্ষেত্রে আসতে হয়েছে। দৈনিক ১৮ ঘণ্টাও কাজ করতে হচ্ছে। একই কাজ করার জন্য পুরুষদের তুলনায় তাদের বেতনও কম দেওয়া হচ্ছে।
নারী নির্যাতনের এই তালিকায় রয়েছেন গৃহকর্মীরাও। তাদের যৌন সহিংসতার গল্পও শোনা যায়, যা প্রায়ই বাড়িতে বসবাসকারী পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশের এক নারী গৃহকর্মী বলেন, “আমি বাথরুম, রান্নাঘর, ছাদের ওপরে বা বারান্দা যেখানেই থাকি না কেন, ম্যাডামের ছেলে সব সময়ই সেখানে আসত। আমার শরীরের স্পর্শকাতর অংশে স্পর্শ করতেন। আমার কিছু করার ছিল না।”
শুধু তা-ই নয়, যৌন নির্যাতনের পাশাপাশি গৃহকর্মীরা প্রায়ই বাড়িতে কাজের সময় নিম্নমানের জীবনযাপন এবং কাজের পরিবেশের সম্মুখীন হচ্ছেন। এমনকি অপর্যাপ্ত খাবারের শাস্তিও তারা ভোগ করেন। গৃহকর্মীরা এক দিনের ছুটি ছাড়াই সারা সপ্তাহজুড়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও তাদের কাজ চালিয়ে যেতে হয়।
সমাজে নারীর স্থান, তাদের শ্রমের মূল্য এবং সারা জীবন নারীরা যে সহিংসতার শিকার হয় এর কারণ অনেকটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজও রয়েছে। অনেক মতভেদ থাকলেও এটিকে বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনা করা যায় না।
বাংলাদেশের একজন অভিবাসী গৃহকর্মী বলেন, “আমার স্বামীর দ্বারা আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি। কিন্তু আমি কীভাবে গিয়ে অভিযোগ করব? সমাজ কী বলবে? যেহেতু আমরা নারী, তাই আমাদের এই ধরনের নির্যাতন সহ্য করতে হবে।”
গুয়াতেমালার এক গার্মেন্টস কর্মী বলেন, “আমাদের বাড়ির পুরুষরা মনে করে নারীদের সবকিছু করতে হবে। কারণ, নারীরা কম উপার্জন করে। মানসিক চাপে থাকলেও এটি চেপে যেতে হয়। কারণ, এটিই স্বাভাবিক।”
শুধু ঘরে নয়, নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক সহিংসতারও শিকার হচ্ছে। দেশে কিংবা বিদেশে কাজ করা বেশির ভাগ নারীরাই তাদের চাকরি হারানোর ভয়ে, আটক ও নির্বাসিত হওয়ার ভয়ে প্রতিনিয়ত শোষণকেও মেনে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক নারী বলেন, “আর্থিক সচ্ছলতা পেতে পরিবারের দুজনই উপার্জন করছি। কিছু ক্ষেত্রে মতামত ও ইচ্ছের কোনো স্বাধীনতা থাকে না। অভিযোগের জায়গাটাও নেই। তাই অনেক কিছু সহ্য করতে হয়।”
এদিকে পুলিশ কর্তৃক হুমকি, গণধর্ষণ, মিথ্যা অভিযোগ এবং চাঁদাবাজির রিপোর্ট করেছে মেক্সিকোতে যৌনকর্মীরা। তারা বলেন, “প্রতিদিন ২০০ টাকা দিতে হয়। যখন আমরা অর্থ প্রদান করি না, তারা আমাদের হেফাজতে নিয়ে যায়। অনেকে সময় তারা আমাদের যে ক্লায়েন্টের সঙ্গে খুঁজে পায় তার কাছ থেকেও অর্থ হাতিয়ে নেয়।”
আর্জেন্টিনার রাস্তার নারী বিক্রেতারাও অভিযোগ করেন। তারা পুলিশ বিরুদ্ধে শারীরিক ও মৌখিক অপব্যবহারের অভিযোগ তুলেন। পুলিশ তাদের পণ্যদ্রব্য সরিয়ে জানিয়ে এক নারী অভিযোগে বলেন, “আমি ও আমার অনেক সহকর্মীর জিনিসপত্র পুলিশ কেড়ে নেয়। কীভাবে অভিযোগ করবেন? তাদের হাতে বন্দুক থাকে। আর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও কেউ শুনবে না।”
এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার ২২টি দেশের ৩০টি সংস্থা এবং ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স এগেইনেস্ট ট্রাফিক ইন উইমেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বিশ্বজুড়ে নারীদের নির্যাতন প্রতিরোধে কয়েকটি সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। বিশ্বের নারী নির্যাতনের ওপর গবেষণার ভিত্তিতে কিছু পরামর্শ দিয়েছে তারা। নারীদের সহিংসতা, হয়রানি এবং শোষণের প্রকৃতি, তারা কীভাবে এটি মোকাবেলা করে এবং পরিবর্তনের জন্য তাদের দাবিগুলো নথিভুক্ত করাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে সংস্থাটি কিছু বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন।
- নারীদের উপযুক্ত কাজ, জীবনযাত্রার মজুরি, সমান মূল্যের কাজের জন্য সমান বেতন, সমষ্টিগতভাবে সংগঠিত ও দর-কষাকষির অধিকার, স্থায়ী চাকরি এবং বেতনের ছুটির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
- নিয়োগ ও অভিবাসন ব্যবস্থার মনিটরিং উন্নত করতে হবে। অভিবাসনের ওপর লিঙ্গ ও বয়স বৈষম্যমূলক বিধিনিষেধের অবসান ঘটাতে হবে।
- প্রান্তিক গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণে রেখে পাবলিক পরিষেবাগুলোর গুণমান, অ্যাক্সেসযোগ্যতা এবং সামর্থ্যকে শক্তিশালী করতে হবে।
- উচ্চ উপার্জনকারীদের প্রগতিশীল করের আওতায় আনতে হবে। জনসেবার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করতে হবে। কর্পোরেটদের জন্য কর প্রণোদনা বাদ দিতে হবে।
সূত্র: গ্লোবাল অ্যালায়েন্স এগেইনেস্ট ট্রাফিক ইন উইমেন