ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়। গত কয়েক দশক ধরে আরব দেশগুলোতে হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যে এক ‘অজেয়’ ও ‘অপ্রতিরোধ্য’ হিসেরেব নিজেদের গড়ে তোলে ইসরায়েলিরা। এবার ভিন্ন পরিস্থিতি। ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে ভয়াবহ হামলা চালায় ইরান। আর এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ইসরায়েলিরা।
২০ মাস ধরে গাজায় টানা বোমা ফেলা হচ্ছে। পুরো গাজা অবরোধ করে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। এখন ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানো মানুষকেও গুলি করে মারা হচ্ছে। তারপরও ফিলিস্তিনিরা দাঁতে দাঁত চেপে গাজা আঁকড়ে আছেন।
অন্যদিকে ইরানের পাল্টা আঘাতে ইসরায়েলে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনার পর ইসরায়েলি ইহুদিদের আরেক দফা দেশত্যাগ শুরু হয়েছে।
ইসরায়েলি নাগরিক, দ্বৈত নাগরিক ও পর্যটকেরা ইসরায়েল ছেড়ে পালাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অনেক ইসরায়েলি ‘রেসকিউ ফ্লাইট’ বা ‘পালানোর জাহাজ’ ধরে দেশ ছাড়তে চাইছেন। কিন্তু সরকার তাদের চলে যেতে দিচ্ছে না; বাধা দিচ্ছে।
এর আগেও দেখা গেছে, বহু ইসরায়েলি ইহুদি অন্য দেশে চলে যেতে চেয়েছেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইসরায়েলি পত্রিকা মারিভ-এ বলা হয়, ‘চলো দেশ ছাড়ি একসঙ্গে’ নামের একটি নতুন গ্রুপ তৈরি হয়েছে, যারা ইসরায়েলি ইহুদিদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে চায়।
তারা প্রথম ধাপে ১০ হাজার ইহুদিকে পাঠাতে চেয়েছিল। এই গ্রুপের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন নেতানিয়াহুবিরোধী কর্মী ইয়ানিভ গোরেলিক ও ইসরায়েলি-মার্কিন ব্যবসায়ী মোর্দিখাই কাহানা।
মোর্দিখাই কাহানা বলেন, ‘অনেকেই রোমানিয়া বা গ্রিসে যেতে চাইছেন। কিন্তু আমি বলি, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া সহজ। আমার নিউ জার্সিতে একটা বড় খামার আছে, চাইলে সবাই মিলে সেখানে কিবুতজ (একধরনের কমিউন) বানিয়ে থাকতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের এ সরকারের অধীন থাকা কঠিন। তাই যাঁরা ডাক্তার বা পাইলট—এ ধরনের পেশাজীবী, তাঁদের যুক্তরাষ্ট্র ঢুকতে দেওয়া উচিত।
আসলে বহু বছর ধরেই অনেক ইসরায়েলি ইহুদি মনে করছেন, ইসরায়েল টেকসই কোনো দেশ নয়। এখানে ইহুদিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়তো এক দিন থাকবে না।
রাজনীতি, সমাজ—সবই বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। তাই তাঁরা নিরাপদ ও ভালো ভবিষ্যতের জন্য অন্য দেশে যেতে চাইছেন।
সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় যারা বিদেশে আটকা পড়েছিলেন, তাঁরা যদিও ফিরে এসেছেন। তবে ইসরায়েলি ইহুদিদের এ দেশত্যাগ এখনো অব্যাহত আছে। আসলে এটা বিগত কয়েক বছরের সেই বিস্তৃত প্রবণতার অংশ, যেখানে অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন।
ইসরায়েলি সরকারের হিসাবে দেখা যায়, ২০০৩ সালের শেষ নাগাদ সাড়ে সাত লাখ ইসরায়েলি স্থায়ীভাবে দেশের বাইরে বসবাস করছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগই বাস করছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।
তাদের মধ্যে ২ লাখ ৩০ হাজার ছিলেন ইসরায়েলে জন্ম নেওয়া ইহুদি। মানে, তাঁদের মা–বাবা ইসরায়েলি দখলদার সেটলার।
ইসরায়েলি সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৭ লাখ ২০ হাজার ইসরায়েলি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁরা আর কখনোই ফিরে আসেননি।
২০১৬ সালের মধ্যে দেখা যায়, ফ্রান্স থেকে যাঁরা ইসরায়েলে অভিবাসী হয়ে এসেছিলেন, তাঁদের প্রায় ৩০ শতাংশ পরে আবার ফ্রান্সে ফিরে গেছেন। যদিও ইসরায়েল সরকার ও বিভিন্ন জায়নবাদী সংগঠন তাদের ধরে রাখার জন্য বহু চেষ্টা করেছিল।
২০১১ সালে ইসরায়েলের অভিবাসনবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করেছিল। সেটির উদ্দেশ্য ছিল, বিদেশে থাকা ইসরায়েলিদের মনে অপরাধবোধ তৈরি করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা।
বহু ইসরায়েলি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাচ্ছেন দেখে ২০১৭ সালেই ইসরায়েল সরকার দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তাই যাঁরা দেশে ফিরতে চান, তাদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়।
এই ইহুদি দেশত্যাগ ঠেকাতে ইসরায়েল সরকার সম্প্রতি কঠোর হয়েছে। তারা নিয়ম করেছে, কেউ দেশ ছাড়তে চাইলে একটি সরকারি ‘বিচারবহির্ভূত কমিটির’ অনুমতি লাগবে।
সরকারি নির্দেশে এয়ারলাইনসগুলো ইসরায়েলি নাগরিকদের টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেয়। তারপরও হাজার হাজার মানুষ পালাতে চাইছেন।
এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অনেক সংগঠন প্রতিবাদ করেছে। তারা বলছে, এটা দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করছে। তাদের দাবি, যারা দেশ ছাড়তে চান, তাদের যেতে দেওয়া উচিত। ১৯৭০ সালে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে আটকা পড়া ইহুদিদের জন্য ‘আমাদের মানুষদের ছেড়ে দাও’ বলে দাবি করেছিল। আজকে ইসরায়েলের ভেতরেই হাজার হাজার ইহুদি যেন একই দাবি করছেন, ‘নেতানিয়াহু, আমাদের যেতে দাও।’
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ২০ জুনের আগেই ২৫ হাজারের বেশি আমেরিকান (অনেকেই দ্বৈত নাগরিক) ইসরায়েল, পশ্চিম তীর ও ইরান ছাড়তে চেয়ে যোগাযোগ করেছেন।
শুধু এক দিনেই ১০ হাজার মানুষ চলে যাওয়ার আবেদন করেছেন। কানাডাও ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইসরায়েল থেকে ছয় হাজার নাগরিক ফিরিয়ে আনবে।