• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ৫ জ্বিলকদ ১৪৪৫

আদিবাসীদের খাদ্যাভ্যাস কেমন হয় ?


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২৩, ০১:২৬ পিএম
আদিবাসীদের খাদ্যাভ্যাস কেমন হয়  ?

আদিবাসীদের সংস্কৃতি, চলা-ফেরা, খাবার-দাবার, পোশাক, ভাষা সবকিছুতেই পার্থক্য রয়েছে আমাদের সঙ্গে। তাদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ কমবেশি সবারই থাকে। বিশেষ করে আদিবাসী খাবারের প্রতি সবার আকর্ষণ একটু বেশি। স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয় এসব বিচিত্র খাবার সহজেই মন কেড়ে নেয়। শুধু তাই নয়, এসব খাবারে স্বাস্থ্য উপকারিতাও রয়েছে অনেক। চলুন জেনে নেওয়া যাক আমাদের দেশের কয়েকটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে-

চাকমা
চাকমারা খাবারে তেল ও মশলার একেবারে সামান্য পরিমাণে ব্যবহার করে থাকে। তাদের রান্নার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এটি। তবে তারা সেদ্ধ ঝাল তরকারি বেশি পছন্দ করে। এ গোষ্ঠির প্রধান খাদ্য ভাত। শাক বা সেদ্ধ সবজি মরিচ ভর্তা দিয়ে মিশিয়ে খাওয়া হয়। চাকমাদের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম ‘সিদল’। এটি শুটকি জাতীয় খাবার, যা অনেক মাছের শুটকি একসঙ্গে মিশিয়ে বানানো হয়। তারা তাদের বেশিরভাগ তরকারি সিদল দিয়ে রান্না করে থাকে। সিদল দিয়ে বানানো আরেকটি বহুল প্রচলিত খাবার হচ্ছে ‘হোরবো’। চাকমারা অনেক আগে বাঁশের ভেতরে মাছ মাংস রান্না করতো, যা ‘সুমো তোন’ নামে পরিচিত। তবে বর্তমানে এটির প্রচলন কমে এসেছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার শুটকি মাছ দিয়ে রান্না করা একটি খাবার হচ্ছে ‘হেবাং’, যেটাকে ‘সুগুনি হেবাং’ বলা হয়ে থাকে। চাকমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম ‘পাচন তোন’। চৈত্র সংক্রান্তির উত্সব ‘বিঝু’-তে বাড়িতে বাড়িতে পাচন রান্না করে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। চাকমা সমাজে বয়স্কদের মধ্যে তামাক খাওয়ার প্রচলন আছে। তাদের তৈরি নিজস্ব হুঁক্কার মাধ্যমে তামাক সেবন করা হয়। এই হুঁক্কাকে চাকমা ভাষায় দাবা বলে।

ত্রিপুরা
ত্রিপুরাদের প্রধান খাদ্য ভাত। প্রতিবেলায় ভাতের সঙ্গে থাকে সেদ্ধ সবজি, মরিচ ও ভুট্টা। তাদের শাক-সবজি সেদ্ধ মানেই মরিচ ও ভুট্টা থাকবেই। তারা বাঁশ কোড়লকে চাখৈ, মৈতুরু, বাংসোং, কেসক, লাকসু, বাজি প্রভৃতি বিভিন্ন উপায়ে খেয়ে থাকে। সবজি হিসেবে ঢেড়স, কলাগাছ, মাসরুম ঝিঙ্গা, হলুদ ফুল, আদা ফুলকে তারা সেদ্ধ এবং গুদাক (বিশেষ এক প্রক্রিয়া) করে খায়। ত্রিপুরারা মাছকে রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়ে খেতে পছন্দ করে। তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘বৈসুক’ উত্সবে মাংস রান্নার প্রচলন রয়েছে। এছাড়া এদিন নারীরা বিন্নি চালের পিঠা ও চোলাই মদ তৈরি করে। বৈসুকে পিঠা বেশ প্রসিদ্ধ।

মারমা
আদিবাসী মারমা সম্প্রদায়ে আঠালো ভাতের সঙ্গে ‘নাপ্পি’ (শুটকি) খাওয়া হয়। কখনো কখনো তাদের খাবারে ভাতের সঙ্গে ‘লাসৌ’ও বিভিন্ন মিশ্রণের ভর্তা থাকে। এছাড়া তারা বিন্নি চালের সঙ্গে নারকেল ও চিনি যোগ করে স্যুপের মতো আঠালো করে এক প্রকার খাদ্য খেতেও পছন্দ করে। ‘সাংগ্রাই’ উৎসবে মারমারা বিভিন্ন সবজি ও শুটকি দিয়ে ‘হাংরো’ তৈরি করে, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার। মারমাদের অন্যতম পছন্দের আরেকটি খাবার হচ্ছে কচি বাঁশ সেদ্ধ, যা সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে এটি বাঁশ কোড়ল নামে পরিচিত। মারমারা বিকেলের নাস্তায় ‘মুন্ডি’র আয়োজন করে। মুন্ডি দেখতে অনেকটা নুডলসের মতো, যার ওপরে শুটকির গুঁড়া ও গরম পানি দিয়ে পরিবেশন করা হয়।

গারো
গারো সমাজে আগে জুমচাষ প্রচলিত ছিল। সে সময় পাহাড়ে জুম পদ্ধতিতে যেসব শাক-সবজি চাষ করা হতো তা দিয়েই তারা জীবন ধারণ করতো। গারোদের খাবারে তেল ও মশলার ব্যবহার নেই। অধিকাংশ খাবারের সঙ্গেই শুটকি ও খাবার সোডা ব্যবহৃত হয়। তাদের বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে শূকরের মাংস প্রধান খাদ্য হিসেবে থাকে। এ মাংসের সঙ্গে চালের গুঁড়া, আদা, রসুন, পেঁয়াজ ও মরিচ দিয়ে তৈরি করা হয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘ওয়াক ঘুরা’। ছোট মাছ কলা পাতায় মুড়িয়ে আগুনে পুড়িয়ে বানানো ‘হিথোপ্পা’ তাদের বেশ সুস্বাদু একটি খাবার।

মণিপুরী
চাকমাদের মতো মণিপুরীরাও খাবারে তেল ও মশলার ব্যবহার করে না বললেই চলে। প্রাত্যাহিক জীবনে মণিপুরীরা আঠালো ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ সবজি এবং বিভিন্ন রকমের ডাল দিয়ে তৈরি ‘খার’ খায়। খার তৈরিতে ডালের সঙ্গে আদা পাতা, হলুদ পাতা, লেবু পাতা দেওয়া হয়। এরপর তাতে কলাগাছ পুড়িয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে ছাই দেওয়া হয়, যা খারে ব্যতিক্রমধর্মী এক ফ্লেভার যোগ করে। তাদের প্রতিবেলা ভাতের সঙ্গে থাকা আরেকটি সবজি তরকারি হচ্ছে ‘পালটৈ’। মণিপুরীদের খাদ্য তালিকায় মাংস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল। 
পরবর্তীতে চৈতন্যের আদর্শে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণের পর থেকে তারা তা পরিহার করে। মণিপুরীদের যেকোনো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই খাওয়া-দাওয়ার একটি পর্ব থাকে। যাকে ‘বান্দারা’ বলে। বান্দারায় মণিপুরীদের বিশেষ সালাদ ‘চিনচু’ বেশ সমাদৃত। এছাড়াও ভর্তা ও ডাল জাতীয় খাবার এদের বিশেষ পছন্দের। বিভিন্ন উত্সবে মণিপুরীরা এক বিশেষ মাছের তরকারি রান্না করে, যা ‘নাগা’ বলে পরিচিত।

সাঁওতাল
অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সাঁনতাল বা সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য ভাত। তবে তাদের রান্না পদ্ধতি ভিন্ন। ভাত রান্নায় তারা পানি পুরোপুরি শুকায় না। সেদ্ধ গরম পানি থাকা অবস্থাতেই তা পরিবেশন করা হয়। তারা মাছ, কাঁকড়া, শূকর, খরগোশ ও পাখির মাংস পছন্দ করে। মুন্ডা, রাজবংশী, খাসিয়া, টিপরা, প্যাংখো, হাজং, তনচঙ্গা, ওরাও, রাখাইন, কোচ, বুনা, চাক প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও সিদল, নাপ্পি, বাঁশ কোড়ল ও তেল মশলা ছাড়া তাদের নিজস্ব কায়দায় রান্না করা বিভিন্ন সেদ্ধ সবজি ঐতিহ্যগতভাবে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।

Link copied!