রোববার দুপুরের পরপরই রাশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য দেখা যায়। ইউক্রেন রাশিয়ার ভূখণ্ডে এ যাবৎকালের সবচেয়ে দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেছে। যেই ঘটনাকে বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। পূর্ব সাইবেরিয়ার ইরকুৎস্ক প্রদেশ থেকে রাশিয়ার সুদূর উত্তরে মুর্মাস্ক পর্যন্ত, চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে এই আক্রমণে লক্ষ্যবস্তু ছিল রাশিয়ার চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিমান ঘাঁটি।
ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা দাবি করছে, এই হামলায় রাশিয়ার যে পরিমাণ যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে তাতে ক্ষতি প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার।
স্থানীয়দের পোস্ট করা ফুটেজে দেখা যায়, ছোট কোয়াডকপ্টার ড্রোনগুলো একটি লরি থেকে বেরিয়ে নিকটবর্তী বিমানঘাঁটির দিকে উড়ে যাচ্ছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিখেছেন, ‘আমি একটি টায়ারের দোকানে কাজ করি। একটি ট্রাক এসে থামল, আর তার ভেতর থেকে ড্রোন উড়ে গেল!’
ইউক্রেনের প্রধান নিরাপত্তা সংস্থা এসবিইউ এই অভিযানের দায় স্বীকার করেছে এবং এর কোড নাম দিয়েছে ‘স্পাইডার ওয়েব’। তারা জানিয়েছে, এই আক্রমণে ৪১টি রুশ বিমান ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে বিরল এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল এ-৫০ আর্লি-ওয়ার্নিং প্লেন (রাশিয়ার এওয়াকস সমতুল্য) এবং টু-২২ এম ৩ ও টু-৯৫ কৌশলগত বোমারু বিমানও রয়েছে। এসবিইউ-এর প্রধান ভাসিলি মাল্যুকের একটি ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘রাশিয়ার কৌশলগত বোমারু বিমানগুলো, সবই মনোরমভাবে পুড়ছে।’
চার বছরের বেশি সময় ধরে চলমান এই যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আঘাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাশিয়ার কৌশলগত বোমারু বিমানের সংখ্যা তুলনামূলক কম–সম্ভবত ৯০ টিরও কম টু-২২, টু-৯৫ এবং নতুন টু-১৬০ বর্তমানে অপারেশনাল রয়েছে। এই বিমানগুলো পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে সক্ষম হলেও, সম্প্রতি ইউক্রেনের লক্ষ্যবস্তুতে প্রচলিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই এগুলো ইউক্রেনীয় সামরিক পরিকল্পনাকারীদের জন্য উচ্চ অগ্রাধিকারের লক্ষ্যবস্তু ছিল। বেশির ভাগ বিমানই পুরোনো এবং এখন আর উৎপাদ করা হয় না। শেষ টু-২২ এম ৩ এবং টু-৯৫ প্রায় ৩০ বছরের বেশি আগে তৈরি, আর সেগুলোর প্রতিস্থাপন, টু-১৬০-এর উৎপাদনও অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে।
রাশিয়ার এত বিপুলসংখ্যক অত্যাধুনিক বিমান দেশের এতটা গভীরে ঢুকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করার সক্ষমতা ইউক্রেনের আক্রমণ কৌশলের উন্নয়ন এবং রাশিয়ার ভেতরে ইউক্রেনের গোপন এজেন্টদের অসাধারণ দক্ষতার প্রমাণ।
ক্রেমলিনের সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে ইউক্রেনের অভিযানগুলোর পরিসর ও নির্ভুলতা ধীরে ধীরে বেড়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের রাশিয়ার গভীরে ঢুকে আক্রমণে কিছু সহায়তা দিয়েছে। গত ২৮ মে জার্মানি ইউক্রেনীয় দূরপাল্লার ড্রোনে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে বেশির ভাগ প্রযুক্তি এবং মিশন পরিকল্পনা ইউক্রেনের নিজস্ব।
১ জুনের এই অভূতপূর্ব ঘটনা পশ্চিমা সশস্ত্র বাহিনীগুলোও ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পশ্চিমা দেশগুলো অর্থ সাশ্রয়ের জন্য বহু বছর ধরে যুদ্ধবিমানগুলো ক্রমশ অল্পসংখ্যক বিমানঘাঁটিতে কেন্দ্রীভূত করছে। তারা বিমানগুলোকে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা করার জন্য কোনো পোতাশ্রয় নির্মাণে বিনিয়োগ করেনি। আমেরিকার নিজস্ব কৌশলগত বোমারু বিমানগুলো স্যাটেলাইট ছবিতে খোলা জায়গায় দৃশ্যমান। ওয়াশিংটনের থিংক-ট্যাংক সিএনএএস-এর টম শুগার্ট লিখেছেন, ‘কল্পনা করুন, খেলার দিনে, রেলইয়ার্ডে, বন্দরে বা উপকূলের চীনা মালিকানাধীন কন্টেইনার জাহাজে, এলোমেলো অবকাঠামোতে পার্ক করা ট্রাকে থাকা কন্টেইনারগুলো... থেকে হাজার হাজার ড্রোন উড়ে আসছে, যা মার্কিন বিমানবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে পারে।’ তিনি সতর্ক করে দেন যে, এটা শুধু কল্পনা নয়, বাস্তবে ঘটতে পারাটা খুবই সম্ভব।