• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

এক যে ছিল সুবীর নন্দী


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: মে ৭, ২০২৩, ০৯:৫৮ এএম
এক যে ছিল সুবীর নন্দী

এখনো বিশ্বাস হয় না সুবীর নন্দী নেই। চার বছর ধরে তিনি নেই—এটাই বাস্তব সত্য। সেদিন রাতে যখন খবরটা দেখেছিলাম, আমার বিশ্বাস হয়নি। আর যা-ই হোক, বাংলাদেশি মিডিয়ার ওপর সব সময় বিশ্বাস রাখা চিন্তাশীল লোকের কাজ নয়। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখলাম মানুষ সমানে তার গান শেয়ার দিচ্ছেন, তকে নিয়ে কথা বলছে। সুতরাং মৃত্যুটাই সত্য। আমার অবশ্য ধারণা ছিল তিনি ফিরে আসবেন, অসুস্থতার হবে অবসান। কারণ, এ রকম প্রাণশক্তিতে প্রাচুর্যময় মানুষ অনেক কিছুকেই পরাজিত করতে পারেন। এ জন্য তাকে নিয়ে তেমন ভাবিনি, জানতাম ফিরে তো আসবেই। কিন্তু ফিরে এলেন মৃত্যুর খবর হয়ে। অবশ্য বিখ্যাত সত্য সাহা অনেক দিন আগেই ওনাকে বলেছিলেন, ‘আজ যে তোমাকে মাইক্রোফোনের সামনে গাইতে ডাকছে, কাল না-ও ডাকতে পারে, হতে পারে এটাই তোমার শেষ গান।’ এ কথাটাকে তিনি আত্মস্থ করে রেখেছিলেন। মিউজিক ডিরেক্টর মকসুদ জামিল মিন্টু বলেছিল সুন্দর কথা, ‘প্রত্যেক সুরকারের নিজস্ব একটা ভাবনা থাকে। সুবীর নন্দী সেই শিল্পী, সুরকার যেমন আশা করে তেমনই গায়।’

ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর আর পড়েননি। নিয়েছিলেন ব্যাংকে চাকরি। ছোট ভাইবোনদের জন্য পরিবারের বোঝা হতে চাননি। গান শিখেছেন ওনার পারিবারিক এক ওস্তাদ ছিলেন, তার কাছে। এখনো ওনার বাড়ির পাশে সেই স্কুলটা আছে। ভালো গাইতেন, কচিকাঁচার আসর থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এর উত্তাল সময়ে গান গেয়েছেন। বটগাছের নিচে স্কুলছাত্রদের এনে গেয়েছেন, সবাই মিলে আমার সোনার বাংলা। মুক্তিযুদ্ধে পালিয়েছেন, আগরতলা এরপর আসাম। সেখানেও গান গেয়েছেন। অসমীয়া লোকজন বুঝত না বাংলা, তাদের গানের মানে বুঝিয়ে দিতেন। সিলেটে ব্যাংকে চাকরি করার সময় তার ম্যানেজার বলেছিলেন, ‘আপনি এত ভালো গান করেন, ঢাকায় না গেলে তো আজীবন এই হবিগঞ্জ-সিলেট করেই কাটাতে হবে।’ সেই ম্যানেজার ভদ্রলোকই ওনাকে ঢাকায় ট্রান্সফার করে দেন।

রেডিওতেও তখন এক খেয়াল চেপেছিল, যারা নতুন শিল্পী তাদের প্রতিষ্ঠিত বাইরের সুরকার গীতিকার দিয়ে গান করানো হবে। সবার গানই প্রচার হবে, দেখা যাক কারটা ভালো হয়। সেই থেকে সুবীর নন্দীর অগ্রযাত্রা শুরু। রেডিওতে তার গান শুনে সংগীত পরিচালক আলী হোসেন ভাবলেন, এই ছেলেকে দিয়ে ট্রাই করা যায়। তিনি ভাবছিলেন গজল ধরনের একটা বাংলা গান সিনেমায় দেবেন। নার্ভাস ছিলেন প্রথমে শুনে, কিন্তু ঠিকই কাজটা সঠিকভাবে করেছেন। রেডিওতে, টিভিতে সবখানেই তিনি গেয়ে চলেছেন সমানতালে। গান তাকে বিত্তশালী বানায়নি। কিন্তু গান গেয়ে গেয়ে তিনি পেয়েছেন এই দেশের মানুষের ভালোবাসা। জগন্নাথ হলের এক রুমে থাকতেন, সব টাকা বাড়িতেই দিতে হতো। ওনার পকেট ফাঁকা। ক্যান্টিন মালিক ওনাকে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার দিতেন আর বলতেন, ‘মিয়া খায়া লন, না খাইলে গলায় আওয়াজ পাইবেন কেমতে?’ এই যে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা, এটা উনি আজীবন পেয়েছেন এবং লালন করেছেন। ছোট একটা ঘটনা বলেছিলেন এক অনুষ্ঠানে, তিনি খুব পান খেতেন। তাতে জিহ্বা ভারী হয়ে যেত, গান গাইতে সমস্যা হতো। শুধু গানের জন্যই পান খাওয়া ছেড়ে দেন। ওস্তাদ আল্লাহরাখা খান, ওস্তাদ আকবর আলী খান, পণ্ডিত রবিশঙ্করের মতো লোকেরা তার গান শুনে তারিফ করেছেন। ভারতেও অনেক লোক তাকে চিনে, একটা সময় আসামে গিয়ে হোটেল না পেলে ওনার নাম বললে ব্যবস্থা হয়ে যেত।

এই জাতির কাছে তাৎক্ষণিকতার মূল্য নেই। অথচ অনেক ভালো কাজের আসল ব্যাপার হলো স্পন্টেনিয়াস চিন্তাভাবনা। যেমন ধরুন সবাই শুনেছেন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমার খুব জনপ্রিয় গান, এক যে ছিল সোনার কন্যা। এই গান হুমায়ূন আহমেদ লিখে দিয়েছিল মকসুদ জামিল মিন্টুর কাছে। মিন্টু প্যান্টের পকেটে রেখে কাগজটা রেখে ভুলে গিয়েছিলেন। কিছুদিন পর এক সকালে স্টুডিও থেকে ফোন আসে, ‘স্যার এসে বসে আছে, আপনি কই?’ মিন্টু জিজ্ঞেস করে ‘কোন স্যার?’ বলে, হুমায়ূন আহমেদ স্যার আর সুবীর নন্দী স্যার। তড়িঘড়ি করে উঠে ভাবছিলেন, আজকেই মনে হয় তার সুর সাধনার শেষ দিন। স্টুডিওতে সুবীর নন্দী জিজ্ঞেস করে সুর কই? উনি বলে আপনি রেকর্ডিং মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ান, আমি এক লাইন এক লাইন করে সুর গেয়ে দিচ্ছি। সুবীর নন্দী বলে, ‘এভাবে তো কখনো গান গাইনি।’ মিন্টু হাসতে হাসতে বলেন, ‘আজকে খালি গান।’ এভাবেই রেকর্ডিং হলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ও জনপ্রিয় গান, ‘এক যে ছিল সোনার কন্যা!’ তবে কথা হলো মকসুদ জামিল মিন্টু প্রতিভাবান বলে এমন করতে পেরেছেন হয়তো। আবার ধীরে ধীরে কাজ করারও গল্প আছে। কবি জাহিদুল হকের সঙ্গে সুবীর নন্দীকে পরিচয় করিয়ে দেন সুরকার ও পরিচালক শেখ সাদী খান। জাহিদুল হককে সুবীর নন্দী বলেন অন্য রকম গান লিখেন একটা আমার জন্য। কবি মানুষ আস্তে ধীরে একটা গান লিখেন সময় নিয়ে। রেডিওর জন্যই গানটি আয়োজন, ‘আমার এ দুটি চোখ’। শেখ সাদী সুর করেন। গানটা বেতারে প্রচারের পর থেকেই খুবই জনপ্রিয় হয়। শ্রোতারা বারবার শুনতে চিঠি পাঠান। টিভিতেও যায়। পরে বুলবুল আহমেদ তার ছবির জন্য গানটা নেন। চল্লিশ বছর ধরে গানটা এখনো কি ভীষণভাবে জনপ্রিয়।

কী গান তিনি গেয়েছেন, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘তুমি এমনি জাল পেতেছো সংসারে’, ‘আমার এ দুটি চোখ’। সংগীত তাকে সব দিয়েছে, মানুষের ভালোবাসা, পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আর একুশে পদক। আর তিনি আমাদের দিয়েছেন, শিল্পীর বিনয় আর নতুনদের শেখানোর চেষ্টা। আমার প্রিয় ভাই গৌতমদা বলেছিলেন গল্পটা, ডাক্তারের সহকারী সিরিয়াল আসার আগেই খাতির করে তাকে ভেতরে যেতে বললেন। তিনি বিনয়ের সঙ্গে না করে দিলেন। অপেক্ষারত রোগীরাও বললেন তিনি আগে গেলে তাদের কোনো অসুবিধা হবে না। তিনি আবারও বিনয়ের সঙ্গে বললেন, তার অসুখ ইমার্জেন্সি নয়, তিনি অপেক্ষা করতে পারবেন। নিজের সিরিয়াল যখন এলো, তখনই তিনি ডাক্তারের কক্ষে গেলেন। ততক্ষণে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। দাদা অবাক হয়ে জানাচ্ছেন, অনেক দিন তিনি ব্যাপারটা মনে করে আনন্দ পেয়েছেন। আসলে ভালো গানের সঙ্গে ভালো মানুষের কম্বিনেশন যখন আমরা পাই তখন তার গানকে আরও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। অনেক টেলিভিশন রিয়েলিটি শোতে তিনি কাজ করেছেন, গান তোলা শিখিয়েছেন প্রতিযোগীদের, মেন্টর ছিলেন। আমি বিরক্ত হতাম, ওনার মতো মানুষের এসব কাজ না করলেই কি নয়। এখন বুঝি কেন করতেন। একটা সুবীর নন্দী চলে গেলে আর কোনো দিন আরেকটা পাওয়া যাবে না। তাই নিজেকে সব সময় উজাড় করে দেওয়া। শুধু যদি তিনি সুরকার হতেন তা-ও তিনি অমর হয়ে যেতেন। শাকিলা জাফরের জন্য উনি কিছু সুর করেছেন কি দারুণ। ওনার সুর করা একটা অজনপ্রিয় গানের কথাই ধরি, ‘এ কোন ফাগুন হৃদয়ে আমার বিরহের আগুনে পোড়ে নিশিদিন’। আহ! কী বানী কী সুর। মান্না দে ইচ্ছে থাকা পরেও স্ত্রীর অনুরোধে গানটা গাননি। সেই গানটা ছিল, ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণ যাত্রা যেদিন যাবে’। পরে কিশোর কুমার গেয়েছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য এখন এটাই, আমাদের সামনে দিয়ে আমাদের প্রিয় সব মানুষেরা চলে যাচ্ছে। বাংলা গানের এমনিতেই দুঃসময়, সুবীর নন্দীর মতো মানুষদের না থাকা আমাদের আরও পিছিয়ে দেয়। আমাকে আরও মনে করায় আমার ছোট মামার কথা। যিনি বছর দেড়েক আগে চলে গেছেন, তার প্রিয় শিল্পী ছিল সুবীর নন্দী। এইবার বাড়ি ভিজিট শেষে মা যখন গল্প করছিল, তখন মনে মনে মামার কথা ভাবলাম, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে/ কার বা এমন সাধ্য আছে এ মায়াজাল ছিঁড়ে যেতে পারে।’ শিল্পীরা এভাবেই থেকে যান আমাদের জীবনে।
 

Link copied!