প্রয়াণদিবসে আলাউদ্দিন আলীর কথা ভাবতে হয় আমাদের। তার একটা গানের লাইন মনে পড়ল, ‘চোখের কাছে সবই আছে তুমি শুধু নাই।’ আট দশটা আলাউদ্দিন আলীর সুরের মতোই, মেলোডি প্রধান দুঃখগাথা। সাবিনা ইয়াসমীন গেয়েছিলেন গানটা দরদ দিয়ে। গানটা যে জনপ্রিয় সেটা কেউ বলবে না। কিন্তু এত শ্রুতিমধুর সব গান আলাউদ্দিন আলী উঠতে বসতে সুর করতে পারতেন, যা অনেকের জন্য স্বপ্ন।
কথাটা শুনেছিলাম পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্র পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কাছে, কবীর সুমন নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সকালে ফ্রেশ হওয়ার আগেই ঘুম থেকে উঠে কবীর সুমন যে টুকটাক লেখালেখি করে ফেলে দেয় পরিত্যক্ত কাগজ রাখার জায়গায়, সেখানে খুঁজলেও তিন-চারটা ভালো গানের লাইন খুঁজে পাবেন আপনি।’ কবীর সুমন এমনই প্রতিভা খেলাচ্ছলেই কত কী লিখে ফেলতে পারেন। আমার কাছে মনে হয় আলাউদ্দিন আলীর সুরের দিকে সে রকম প্রতিভা। প্রথম জীবনে তিনি পারিবারিকভাবে যন্ত্রানুষঙ্গ সবগুলোই কম বেশি বাজাতে শিখেছেন ও বাজিয়েছেন নানান গানে। তখন থেকেই সুর তার মাথায় সারা দিন খেলা করত। স্নান থেকে বের হয়ে কিংবা রিকশায় গুনগুন করতে করতেই সুর হয়ে যেত। আলাউদ্দিন আলীকে নিয়ে আলাপ করতে গেলে কবীর সুমনের আলাপটা আমি করি। একমাত্র কবীর সুমনই পশ্চিম বাংলার বড় মানুষদের ভেতরে একজন, যিনি আলাউদ্দিন আলীর মৃত্যু নিয়ে লিখেছিলেন ও তার অসুস্থতার সময়ও নানান কথা বলেছেন। তার সুরের গ্রেটনেস নিয়ে আলাপ করতেন। আর কলকাতায় তিনি এত কাজ শিল্পীদের সঙ্গে করেছেন, কেউ তাকে সেভাবে মনে রাখেনি। তিনি মজা করে বলতেন, ‘লতাজি আর আশাজি ছাড়া সবার সঙ্গে কাজ করেছি। আশা ভোঁসলের সঙ্গে ডেট মেলেনি বলে কাজটা করা হয়ে ওঠেনি।’
আলাউদ্দিন আলীর চলে যাওয়ার তিন বছরে আমি অনেক রাতেই শুধু তার সুর করা গান শুনে কাটিয়েছি। গান শোনা ও লেখা ছাড়া বাংলা গানের এই কিংবদন্তির জন্য আর কী করতে পারি। আনোয়ার পারভেজ, সত্য সাহাসহ অনেকের বিখ্যাত সব গানের মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট তার করা। তিনি সংগীত পরিচালনা ও সুরকারের পাশাপাশি অনেক বিখ্যাত মানুষের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। এই যে শাকিলা জাফর ও তপন চৌধুরীর গাওয়া, গাজী মাজহারুল লেখা ও আনোয়ার পারভেজের সুর করা গান ‘পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়’ গানটার গোটা যন্ত্রানুষঙ্গ আলাউদ্দিন আলীর করা। নতুন শিল্পীদের নিয়ে নতুন নায়ক-নায়িকাদের লিপে যাবে গান, এটা তিনি আর আনোয়ার পারভেজ মিলেই রাজি করান। এই গল্পটা শোনার পরে গানটা আমার আরও আপন মনে হয়। আলাউদ্দিন আলী যখন তুমুল ব্যস্ত কাজ করছেন চলচ্চিত্রে তখনো তিনি খুবই সেনসিটিভ একজন মানুষ। স্টুডিওর সবার খাওয়াদাওয়া হলো কিনা অথবা কোনো স্টাফের বিপদে নিজে উজাড় করে সব টাকাপয়সা দিয়ে দেওয়া—এসব তার রোজকার রুটিন। তিনি গানও ভালো গাইতে পারতেন।
আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন গল্পটা, তাকে দিয়ে সিনেমায় গাওয়ানোর গল্প। বাচ্চু খুবই নার্ভাস ছিলেন। কারণ এত ভালো গানটা তুলে দিয়েছিলেন আলী, এ রকমভাবে কীভাবে গাইবেন। বাচ্চুকে সময় দিলেন, আড্ডা দিলেন, খেলেন; তারপর গান রেকর্ড হলো। এটাই ছিল আলাউদ্দিন আলীর প্রসেস। তিনি বাজারি সিনেমায় গানের কারখানা চালাতেন। কিন্তু কোয়ালিটি যেন খারাপ না হয় তাও মাথায় রাখতেন। ফুয়াদ নাসের বাবু বলেছিলেন, ‘আলী ভাই না থাকলে তিনি ফিডব্যাকে কাজ করতে পারতেন না। আলাউদ্দিন আলী তাকে শিখিয়েছেন টাইম ও স্টুডিও ম্যানেজমেন্ট।”
আলাউদ্দিন আলীর কোন গানটার কথা বলব। প্রিয় তো অসংখ্য—‘এমনও তো প্রেম হয়’ কিংবা ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না।’ কত কত গানের কথা বলব। আলাউদ্দিন আলী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশের গানও সুর করেছেন। বিটিভির জন্য গান করেছেন। সিনেমায় প্রচলিত ধারার বাইরে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়েছেন। বিদেশে গেলে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র দেখতেন, বিভিন্ন সুর শুনতেন, সলিল চৌধুরীর অনেক বড় ভক্ত ছিলেন। সেমি ক্লাসিক্যালের প্রতি তার একটা ঝোঁক ছিল সব সময়। রক থেকে পপ—অনেক ধারার সংগীত বুঝতেন। জীবন কিন্তু তার সহজ ছিল না। স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা করিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। নিজেও বারবার অসুস্থ হয়েছেন। তার সে স্ত্রী মারা যান অকালেই। তিনি ক্যাসেট যুগে আঠারো বিশ ঘণ্টা করে কাজ করেছেন। মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান আইএসডি কলে গানের কথা বলতেন, তিনি কলকাতায় বসে সুর ও রেকর্ড করতেন। কুমার শানুর মত দুনিয়ার ব্যস্ত আর্টিস্টরাও এসে বসে থাকতেন আলী ভাইয়ের কাজ বলে। দুটো দেশে স্টুডিও চালানো, গান বানানো যে কত মেহনতের কাজ তা আমরা বুঝব না। সিনেমায় অশ্লীল যুগের সময় তিনি কাজ কমিয়ে দিলেন।
আলাউদ্দিন আলী বিশ্বাস করতেন ভালো সিনেমার জন্য পড়াশোনা ও ভালো চলচ্চিত্র দেখা জরুরি। তিনি নিজেও হুমায়ূন আহমেদ পড়তেন খুব, শামসুর রাহমান ও গুণের কবিতার ভক্ত ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কপিরাইট ও শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মানী নিয়ে দেন দরবার করেছেন। শিল্পীদের কষ্টের জীবন তিনি মেনে নিতে পারতেন না। এসব অনেক ভাবনাই লেখা যায়। আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে আলাউদ্দিন আলীকে মনে পড়ছে ভীষণভাবে।