এ বছর দেশের বিভিন্নস্থানে সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। অতিবৃষ্টির বদৌলতে আবহাওয়াও অনুকূলে ছিল। পাটের ফলন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন পাট চাষীরা। এখনও পাট ধোয়া ও রোদে শুকানোতে ব্যস্ত তারা। দেশের বিভিন্ন জেলায় এই দৃশ্য চোখে পড়বে। তবে কিছু স্থানে পাটের দাম নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন কৃষকরা। কষ্টের পণ্যটি বিক্রি করে ভালো দাম পাবেন কিনা তা নিয়ে ভাবছেন তারা।
ফরিদপুর
বাজারে ভালো দাম আর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ফরিদপুরে দিন দিনই বাড়ছে সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের চাষাবাদ । পাট ধোয়া ও শুকানোর কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। মৌসুমের শুরুতেই পাট বিক্রি করে ভালো দাম পাচ্ছেন কৃষকরা। জেলার হাট-বাজারে প্রতি মণ পাট ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২ শত টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে লোকসানে পড়া কৃষকদের মুখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটেছে।
ফসলের খেত নদী বা খাঁলের পাড়, রাস্তার ধারে এমনকি কৃষকের বাড়ির উঠান সবখানেই পাট কাটা, ধোয়া, আঁশ ছাড়ানো এবং শুকানোর ব্যস্ততা। ফরিদপুরের প্রতিটি গ্রামেই এখন চিরচেনা এই দৃশ্য চোখে পড়বে। পাট শুকানোর জন্য বেছে নেয়া হয়েছে বাঁশের আঁড় ও বিভিন্ন ব্রিজের রেলিংও।
জেলার সদরপুরের কৃষক ফজর আলী ও শাহাদাৎ হোসেন জানান, মৌসুমের শুরুতেই এ বছর পাটের বাজারে পাইকার,ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের আনাগোঁনা বেশি দেখা যাচ্ছে। তাই পাটের দাম আরও বাড়ার সম্ভবনা রয়েছে।
সালথার খোয়ার গ্রামের কৃষক সেলিম মাতুব্বর, সামচেল ফকির ও আজিজুল মাতুব্বর জানান, বর্তমান সরকার বন্ধ পাটকলগুলো পুনরায় চালু ও এর বহুমুখি ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। তাই বাজারে আবারো এর চাহিদা বেড়েছে। দামও মোটামুটি ভালো।
ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া এলাকার কৃষক করিম শেখ জানান, অতিবৃষ্টি পাটের জন্য আর্শীবাদ। তবে এ কাজে রয়েছে শ্রমিক সংকট। দিনে ৬০০ টাকা দিয়েও একজন শ্রমিক মিলছে না।
ফরিদপুরের কানাইপুর, সালথা বাজার, ময়েনদিয়া ও কৃষ্ণপুর হাটে পাটের সবচেয়ে বড় আড়ৎ। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা আসেন পাট কিনতে।
ফরিদপুর কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশ থাকায় এ বছর পাটের আবাদ ভালো হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. হযরত আলী জানান, পর্যাপ্ত সার, বীজ ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করলে পাট চাষে আরও আগ্রহী হবেন কৃষকরা।

গাইবান্ধা
এই জেলায় এবার আগাম বৃষ্টি না হওয়ায় পাট চাষে আবহাওয়া অনুকূলে ছিল। হয়েছে বাম্পার ফলনও। তবে ভালো ফলন হলেও দাম নিয়ে শঙ্কায় ভুগছেন স্থানীয় কৃষকরা।
করোনা পরিস্থিতি ও সরকারি-বেসরকারি পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সঠিক দাম পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা।
সাদুল্লাপুর উপজেলার উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের পাট চাষীরা বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। তারা বলেন, গত বছর পাটের দাম ভালো পাওয়ায় চলতি মৌসুমের শুরুতেই চাষিরা পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন। অনুকূল আবহাওয়ায় ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি ও পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ বছর দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো.খাজানুর রহমান বলেন, 'উপজেলায় পাটের উৎপাদন লক্ষমাত্রা গতবছরে যা ছিল তার চেয়ে আমাদের ৪০ হেক্টর বেশি। এ বছর আবাদ হয়েছে ২৮০ হেক্টর। এ পর্যন্ত যত শষ্য কর্তন হয়েছে সেখানে ৩ টনের উপরে ফলন পেয়েছি। বিঘা প্রতি ১০ মন প্লাস। আশা করা যাচ্ছে কৃষক লাভবান হবে। এখন বাজার মূল্য ২২০০ টাকা থেকে ২৮০০ টাকা আছে। ১ বিঘা জমিতে পাঠ কাঠিসহ প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আর্থিক মূল্য বিচার করে কৃষক পাবে। যেখানে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকার বেশি খরচ হবে না।'
পাবনা
ফলন কমেও দামে খুশি পাবনার পাট চাষিরা। গত বছর উৎপাদনে দাম কম থাকলেও এবারে পাট দ্বিগুন দাম পাচ্ছেন চাষিরা। কৃষি বিভাগ বলছে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। বাম্পার ফলনের পাশাপাশি আশাতিরিক্ত দাম পাচ্ছেন চাষিরা।
এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় অনাবৃষ্টিতে অধিক খড়া দেখা দেয়। বৃষ্টি না হওয়ায় ইঞ্জিনচালিত স্যালোমেশিন দিয়েও পাট চাষীরা জমিতে পানি দিতে পারেনি। অনেক চাষি ২ বার বীজ বপন করে পাটের আবাদ করতে পারেনি। কিছু বীজ গজালেও তেমন গাছ না হওয়ায় ফলন বেশি হয়নি।
পাট চাষীরা বলছেন, অনাবৃষ্টি হওয়ায় এবার পাট ছোট ছোট আকৃতি হয়েছে, যার কারণে বিঘা প্রতি ১০ মনের জায়গায় ৫ থেকে ৬ মন করে পাট পাচ্ছি। চলমান হাটে ২৬ শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা দরে হাট-বাজারে পাট বিক্রি হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত বছরের অর্জিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার কয়েকশ হেক্টর কম জমিতে পাট চাষ হয়েছে। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশী পাটের আবাদ হয়েছে সাঁথিয়া উপজেলায়।
দামও গত বছর থেকে এ বছর বেশি। গত বছর প্রতিমণ পাট বিক্রি হয়েছে ১৫শ’ থেকে ১৬শ’ টাকায়। বিঘা প্রতি ফলন হয়েছিল ৮ থেকে ১০ মণ।
সরেজমিনে পাবনার টেবুনিয়া, দুবলিয়া, সাঁথিয়ার বোয়াইলমারী ও আতাইকুলা হাটে গিয়ে দেখা যায়, এ বছর মান ভেদে পাট বিক্রি হচ্ছে ২৬শ’ থেকে ৩৪শ’ টাকা দরে।
আটঘরিয়ার তারাপাশা গ্রামের পাট চাষিরা জানান, প্রতি বিঘায় ফলন হয়েছে ৭ থেকে সর্বোচ্চ ১০ মণ। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা।
পাবনা শহরতলীর আরিফপুর হাজিরহাটে আসা সাদুল্লাপুর গ্রামের জালাল প্রামানিক জানান, আমি এ বছর ৭ বিঘা জমিতে পাট আবাদ করে ভাল ফলন না পেলে দামে মুটামুটি পুষিয়ে যাচ্ছে।
দুবলিয়া অঞ্চলের আসলাম মিয়া জানান, আমি এ বছর ৪ বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। তবে ২ বিঘাতে ভাল ফলন হলেও অন্য ২ বিঘাতে পানি থাকায় পাট বড় হতে পারে নাই।
সাঁথিয়ার ভবানীপুর গ্রামের মনতাজ আলী ও পৌর সদরের দৌলতপুর গ্রামের ছোহরাব শেখ জানান, আঁশ তেমন মোটা না হওয়ায় ফলন একটু কম হয়েছে। যেখানে ১০ মণ হওয়ার কথা সেখানে ৮ মণ হয়েছে। তবে দাম ভালো পেয়েছি।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপপরিচালক আব্দুল কাদের বলেন, ' দাম বেশি থাকলে অবশ্যই পাট চাষিরা আগ্রহী হয়ে উঠবেন। চাষিদের সব ধরণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

জামালপুর
জামালপুরেও পাটের দাম বেশি। কৃষকের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটেছে। পাটে বাম্পার ফলন পেয়েছে চাষীরা। তবে পানি সঙ্কটে এখনো পাট পঁচাতে বিপাকে পরেছেন অনেক কৃষক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ নিতাই চন্দ্র বণিক জানান, অনুকূল পরিবেশ আর বীজের সহজ লভ্যতার কারনে এবার জামালপুর সদর, ইসলামপুর, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ি, মাদারগঞ্জ, বকশীগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ৩০ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে দেশি, তোষা, কেনাফ ও মেস্তা জাতের পাটের চাষ হয়েছে।
সরেজমিনে জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ঝালুরচর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দেওয়ানগঞ্জ শহর থেকে ঝালুরচর বাজারের পাট হাটে যেতে সড়কের দুই পাশে ডোবা নালায় চোখে পড়ে পাট গাছের জাগ। সড়কের দুই পাশে নারী ও পুরুষকে পাট শুকানোর কাজ করছে। একই চিত্র জেলার সরিষাবাড়ি, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, ইসলামপুর, বকশীগঞ্জ ও জামালপুর সদর উপজেলায়।
পাট চাষীরা জানান, তিন মাসের মধ্য পাট ঘরে তোলা যায়। কম সময়ে, কম পরিশ্রমের ফসল পাট। প্রতি বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ১০-১২ মণ পাট উৎপাদন হয়। এবার বাজারে পাটের মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। এবার বন্যা না হওয়ায় পাটের কোনো ক্ষতি হয়নি। পাট চাষের খরচ বাদ দিলে ভাল লাভ পেয়েছেন পাট চাষিরা।
হাট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার অর্থাৎ সপ্তাহে দুই দিন ঝালুরচর বাজারে হাট বসে। এ হাটে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ও গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন এলাকার পাট চাষীরা পাট বিক্রি করতে আসেন। প্রায় ৫ শতাধিক পাট চাষী এখানে আসেন। প্রতি হাটে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মণ পাট বিক্রি হয়। মানভেদে ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় পাট বিক্রি হয়।
গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার হরিচন্ডী এলাকার পাট চাষী হাফেজ মিজানুর রহমান জানান, তিনি ২ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। ২ বিঘা জমিতে প্রায় ২৪ মণ পাট হয়েছে। প্রতি মণ পাট ২ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের দপরপাড়া এলাকার পাট চাষী আবুল কাশেম জানান, সোয়া ২ বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে তার খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। ওই জমিতে ১৮ মন পাট হয়েছে। প্রতি মন ২ হাজার ৯০০ টাকা দরে বিক্রি করছে।





































