• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

যে শহরে এখনও ‘জীবিত’ ম্যারাডোনা


পার্থ প্রতীম রায়
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২২, ১২:৫৬ পিএম
যে শহরে এখনও ‘জীবিত’ ম্যারাডোনা

ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা! মাঠের বাইরের ঘটনার জন্য তাকে ঘৃণা করতে পারেন, তিনিই আবার ভালোবাসতে বাধ্য করেন মাঠের উজ্জ্বল পারফর্মেন্সের জেরে। তার পায়ের জাদুতে এতোটাই মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল তাতে ঘৃণার চেয়ে বড় হয়েছিল ভালোবাসা। তাই তো ওপারে পাড়ি জমানোর পরও তাকে মনে রেখেছে সবাই। ৮০-৯০’র দশকের ফুটবল প্রেমীরা এখনো স্বস্তি খুঁজে নেন ম্যারাডোনার পায়ের জাদুতে। তাদের চেয়ে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে ম্যারাডোনার জন্ম শহর ভিলা ফিওরিতোর লোকজন। সেখানে কান পাতলে এখনো শোনা যায় ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনার নাম আর স্তুতি। মনে হবে, এখনও জীবিত আছেন ম্যারাডোনা।

ল্যাতিন ফুটবলারদের বেশিরভাগেরই জীবনের শুরুর গল্পটা কুখ্যাত মাদক ও সন্ত্রাসী ভরপুর বস্তি থেকে। যেখানে তাদের বাঁচার একমাত্র উপকরণ ফুটবল। ম্যারাডোনাও এসেছিলেন ঠিক তেমনই এক পরিবেশ থেকে। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আইরেসের পাশের শহর ভিলা ফিওরিতোতে জন্ম আর শৈশবের শুরু ম্যারাডোনার।

শহরটিতে মূলত শ্রমিকদের বাস। বিদ্যুতহীন-যত্রতত্র আবর্জনা পড়ে থাকার একটি শহর। অস্বাস্থ্যকর এই শহরের একটি স্কুলেই শুরু ম্যারাডোনার শৈশব। শ্রমিক এলাকার স্কুল হওয়ায় প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার হিসেবে ম্যারাডোনা ও তার স্কুল সঙ্গীদের প্রত্যেকের জন্য বরাদ্ধ ছিল একটি করে কমলা লেবু।

ম্যারাডোনা কমলা লেবুটি খাওয়ার জন্য নয়, পছন্দ করতেন ফুটবল হিসেবে। স্কুল শেষে ফিওরিতোর রাস্তায় নিজের ফুটবল প্রতিভার প্রদর্শনী করতেন ওই কমলা লেবু দিয়ে। এতেই এলাকার স্থানীয় ফুটবল ক্লাবের নজরে পড়েন ম্যারাডোনা। সেখান থেকেই আর্জেন্টিনোস জুনিয়র থেকে বোকা জুনিয়র হয়ে ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন ফুটবলের মহাতারকা।

শৈশবে ম্যারাডোনার ফুটবলে হাতেখড়ি হওয়া ইস্ট্রেলাস রোজাস ক্লাবের নাম পরিবর্তিত হয়ে পরিচিত হয়ে উঠেছে ইস্ট্রেলাস ইউনিদাস নামে। তবে যেই নামেই পরিচিত হোক না কেন, ক্লাবের সবচেয়ে বড় পরিচয় শৈশবে ক্লাবটির হয়ে মাঠ মাতিয়েছিলেন ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনা।

শুরুর দিকে ক্লাব ঘরহীন ইস্ট্রেলাসের শুরুটা হয়েছিল ম্যারাডোনার পাশের বাড়ির রান্নাঘর থেকে। ক্লাব ঘরহীন ক্লাবটিতে এখন আছে ক্লাব হাউজ, তাও ম্যারাডোনার বাড়ির ঠিক পাশেই। তবুও ক্লাবটির পরিচিত এখনও ওই ম্যারাডোনাই।

৩০ অক্টোবর, ম্যারাডোনার জন্মদিনে ফিওরিতো অঞ্চলে থাকে উৎসবের আমেজ। ম্যারাডোনার ছোট সময়ে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এখনো লোকজনকে স্মরণ করিয়ে দেয় ফুটবল ঈশ্বরের উপস্থিতি । আর্জেন্টাইন এই কিংবদন্তি যেই রাস্তা ধরে ফুটবল খেলে বেড়ে উঠেছিলেন, তার পুরোটারই নামকরণ হয়েছে ম্যারাডোনার নামে। তাই নয়, শহরজুড়ে যেদিকে চোখ দেওয়া যায় সেদিকেই দেখা মিলবে ম্যারাডোনার ম্যুরাল। ফুটপাতের ধারের দেয়ালে হরহামেশাই দেখা মিলবে ম্যারাডোনার ছবির নানা চিকামারা। এই শহরে কাজে যেতে কিংবা ফিরতে, সব সময়ই চোখে পড়বে ম্যারাডোনাকে। শহরের মানুষ প্রতিমুহূর্তেই ধারণ করছে ফুটবলের এই কিংবদন্তিকে।

প্রায় শৈশবেই ফিওরিতো ছাড়লেও শহরের মানুষের মতে এখনও তদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে যুক্ত আছেন ম্যারাডোনা। ওপারে পাড়ি জমালেও এখনো প্রতি মুহূর্তেই ফুটবল ঈশ্বরকে স্মরণে রাখে শহরটির লোকজনের। এমনকি তাদের ধারণা, শহরের প্রত্যেকের মধ্যেই সুপ্তভাবে আছেন ম্যারাডোনা। আবারও হয়তো কারো না কারো মাধ্যমে শহরটিতেই ফিরে আসবেন।

ফিওরিতো সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কাজ করা বুসটোস বলেন, “আমার মনে হয়, এখানকার সবার মধ্যেই ম্যারাডোনা আছে। কারো না কারো মধ্যে নতুন করে বেড়ে উঠছে। হয়তো এখন অনেক কষ্ট করছে। শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কষ্ট অনেক কঠিন। হয়তো আবারও কোনো একদিন ফিরে আসবেন তিনি।”

যেই শহরের রাস্তায় একসময় কমলা লেবু দিয়ে ফুটবল খেলতেন ম্যারাডোনা সেই শহরের চেহারা বদলেছে। ফিওরিতোতে এখন আছে বিদ্যুত, রাস্তাঘাট, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প। আগে যেখানে শহরের লোকজন ময়লা আবর্জনা ফেলতো তা পাল্টে গেছে। এখন পরিণত হয়েছে সুন্দর ফুটপাতে। পরিবর্তনের রেশ থাকলেও শহরটিতে এখনও অনেকেই আছেন দারিদ্রতার বৃত্তে বন্দি।

শহরের পাশাপাশি তার প্রাথমিক স্কুলেও এসেছে পরিবর্তন। স্কুলের মাঠে যেখানে ফুটবল খেলার সূচনা ম্যারাডোনার শোভা পায় ম্যুরাল। সেখান থেকে স্কুলের নতুন কুড়িরা শিক্ষা নেয় ম্যারাডোনার মতো ফুটবলার হবার।

অবশ্য স্কুলটি ম্যারাডোনার পরিবারের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ম্যারাডোনা স্কুলটিতে পড়লেও এখানে চাকুরি করতে তার দাদি ও দাদির মা। ১৯৯৮ সাল থেকে স্কুলটিতে কাজ করা লরা ফ্লেইটাস বলেন, “এখানে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ যে এটা ম্যারাডোনার প্রাথমিক স্কুল। তার দাদি ও দাদির মা এখানে কাজ করতেন। তার দাদি স্কুলটির রাধুনি ছিলেন। শহরের সবাই তাকে দারুণ একজন রাধুনি হিসেবে চিনতো।”

ম্যারাডোনা ফুটবল মাঠের পায়ের জাদুর পর নেতিবাচক ঘটনাতেও হয়েছিলেন খবরের শিরোনাম। তবুও তার খ্যাতি কিংবা ভালোবাসা কমেনি একচুলও। পুরো বিশ্ব যেখানে টলেনি তাতে ব্যতিক্রম হতে পারেনি ফিওরিতোও।

মাদক কাণ্ড কিংবা অন্যান্য নেতিবাচক ঘটনার পরও তার প্রতি ভালোবাসায় কমতি নেই। শহরের বাসিন্দা ৩৯ বছর বয়সী গুস্তাভো হোরাসিও বলেন, “ডিয়েগো (ম্যারাডোনা) একজন জাদুকর। যদিও সে এমন কিছু করেছে যা আমাদের আশায় ছিল না।  কিন্তু বাস্তবতা হল, সে পায়ের জাদুতে যা করেছে তাতে সবাই তা ভুলে যায়।”

এতেই বোঝা যায় এখনো ফিওরিতো শহরে কতটা প্রভাবশালী ফুটবল কিংবদন্তি ম্যারাডোনা। শৈশবেই শহর ছাড়লেও এখনো অক্ষত আছে ম্যারাডোনার শৈশবের ওই বাড়ি। যেখানে বাবা-মা ও পাঁচ ভাইবোনের সাথে থাকতেন।

কিছুদিন আগে ফিওরিতোতে থাকা ম্যারাডোনার শৈশবের ওই বাড়িকে ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করে আর্জেন্টিনা সরকার। এরপর থেকেই বাড়ির সামনে প্রতিনিয়তই কেউ না কেউ উড়িয়ে দেয় আর্জেন্টিনার পতাকা। শুধু তাই নয়, বাড়ির সামনে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ রেখে যায় অগণিত ফুলের তোড়া। যদিও ওই বাড়িতে এখনো বসবাস করেন ম্যারাডোনা পরিবারের অন্য সদস্যরা।

Link copied!