বেশ কিছুদিন ধরেই ব্রাজিল ফুটবলের ভবিষ্যত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন ব্রাজিলিয়ান তারকা রিচার্লিসন। সার্বিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে জোড়া গোলে সেই প্রমাণও রেখেছেন। সেলেকাওদের এই তরুণ তুর্কির জীবনের শুরু কিংবা ফুটবলের যাত্রাপথের পুরোটাই ছিল বন্ধুর। সেই পথে পাড়ি দিতে একবার মৃত্যু হুমকিও মিলেছিল, শেষ পর্যন্ত সব বাধা পেরিয়ে ব্রাজিলের জয়ের নায়ক টটেনহ্যামের স্ট্রাইকার রিচার্লিসন।
সার্বিয়ার বিপক্ষে প্রথমার্ধে কোনো গোলই করতে পারেনি ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধের ১৫ মিনিটে দারুণ ফুটবলীয় দক্ষতায় সার্বিয়ার রক্ষণদূর্গ ভেঙেছিলেন। এর মিনিট ১২ পর তার বাইসাইকেল কিকে আরও একবার বোকা বনে গেছে সার্বিয়ার রক্ষণ। এরপরেই পুরো বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রিচার্লিসন।
অন্যান্য ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের মতো রিচার্লিসনও এসেছে মাদকের স্বর্গরাজ্য খ্যাত ব্রাজিলের বস্তি থেকে। বাবা ছিলেন দিনমজুর ও মা বিক্রি করতেন আইসক্রিম। স্বল্প আয়ের পরিবার হওয়ায় প্রায়সময়ই অর্ধপেটা থাকতে হতো রিচার্লিসনদের। সেই তাড়না থেকে বয়স ৯ হওয়ার পরই মায়ের সঙ্গে আইসক্রিম বিক্রি করতে যেতেন রিচার্লিসন। অতিরিক্ত আয় হলেও নিয়মিত ভালো খাওয়া দাওয়া হতো না তাদের।
সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রিচার্লিসনের অনেক বন্ধুই বেছে নিয়েছিলেন মাদক চোরাকারবারির মতো কাজ। সেই পথে অবশ্য হাঁটেননি সার্বিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের এই জয়ের নায়ক। সংবাদ মাধ্যম টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রিচার্লিসন বলেন, “আমার বেশিরভাগ বন্ধুই রাস্তায় মাদক বিক্রি করত। কারণ, সেখানে সহজেই প্রচুর টাকা পাওয়া যেত। আমি জানতাম, এটা ভুল পথ তাই চকলেট ও আইসক্রিম বিক্রির পথ বেছে নিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে বড়লোকদের গাড়ি ধোয়ার কাজও করতাম। কারণ, এটা সঠিক পথ। পাশাপাশি মাকেও সাহায্য করতে পারতাম।”
অন্য সব ব্রাজিলিয়ানদের মতো ফুটবলের প্রতি আসক্ত ছিলেন রিচার্লিসনও। তার বাবা তাকে ফুটবল কিনে দেওয়ার পর রাস্তাই হয়ে উঠেছিল রিচার্লিসনের খেলার মাঠ। ব্রাজিলের এসপেরিতো সন্তো প্রদেশের নোভা ভেনিসিয়া শহরের রাস্তায় নিজেকে মেলে ধরছিলেন।
এই রাস্তাই অবশ্য একবার রিচার্লিসনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে ধরেছিল। এক মাদক চোরাকারবারির পিস্তলের সামনে পড়েছিলেন। অবশ্য সেটা ছিল ওই চোরাকারবারির ভুল।
তার দল থেকে রিচার্লিসনের মতো একজন পালিয়ে গিয়েছিল। তার ধারণা ছিল রিচার্লিসনই ওই দলছুট। তাই পিস্তলের সামনে রিচার্লিসনকে দাঁড়া করিয়ে বলেছিলেন, তার সামনে যেন না পড়েন। পিস্তল দিয়ে গুল করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত আর গুলি না করেই ফিরে যান ওই চোরাকারবারি।
১৪ বছর বয়সী রিচার্লিসন যখন মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন ওই সময়ই তাকে দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান এক ব্যবসায়ী। খেলায় মুগ্ধ হয়ে রিচার্লিসনকে কিনে দেন একজোড়া বুট। ওই বুট পড়েই প্রথম ফুটবল খেলার স্বাদ পান এই ব্রাজিলিয়ান তারকা ফুটবলার।
বাবা চাইলেও রিচার্লিসনের ফুটবলার হওয়ার পথে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বুট কিনে দেওয়া ওই ব্যবসায়ী। কারণ, তিনিই প্রথম আমেরিকা মিনেইরো নামের দ্বিতীয় বিভাগের একটি ক্লাবে রিচার্লিসনকে নিয়ে যান। সেখানেই স্কাউটদের নজর কেড়ে পেশাদার ফুটবলার হওয়ার পথে এগিয়ে যান।
আমেরিকা মিনেইরোতে খেলাকালীনই রিচার্লিসনের ডাক আসে ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব ফ্লুমিনেস থেকে। দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব আমেরিকা মিনেইরোতে খেলেন মাত্র এক বছর। এরপর আর কখনই পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রিচার্লিসনকে।
ব্রাজিল থেকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে আসেন ক্লাব ওয়াটফোর্ডের মাধ্যমে। সেখান থেকে রিচার্লিসনের বর্তমান ঠিকানা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের আরেক ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পার।
রিচার্লিসনের বাবার চাওয়া ছিল ফুটবলার হয়ে উঠুক। আর্থিক অভাব অনটন থাকলেও ছেলেকে কিনে দিয়েছিলেন ১০ টি ফুটবল। সেখান থেকেই শুরু হয় ব্রাজিলের এই তারকার ফুটবলার হওয়ার যাত্রা।
এই বিষয়ে রিচার্লিসনের ভাষ্য, “যখন আমার বয়স মাত্র সাত, তখন বাবা আমার জন্য ১০ টি ফুটবল কিনে এনেছিলেন। তার পক্ষে এতোগুলো বল কেনা প্রায় অসম্ভব ছিল। তবুও তার চাওয়া ছিল আমি যেন ফুটবলার হই। বেশিরভাগ সময় বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তাতেই ফুটবল খেলতাম। আর স্যান্ডেল দিয়ে ফুটবলের গোলপোস্ট বানাতাম।”
প্রতিভা থাকলেও ফুটবলার হওয়ার পথে বাধার মুখোমুখিও হয়েছিলেন রিচার্লিসন। ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব বোলো হরিজোন্তো থেকে হয়েছিলেন প্রত্যাখ্যাত। যদিও তাকে দলে ভিড়িয়ে সেই ভুলে মাশুল দিয়েছে ফ্লুমিনেন্স। হরিজোন্তো থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ফুটবলটাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বাবার চাওয়াতেই ফুটবল খেলাটা ধরে রেখেছিলেন এই তারকা ফুটবলার।
ফুটবল মাঠে দারুণ পারফর্মেন্সের জন্য আলোচিত হওয়া রিচার্লিসন মাঠের বাইরের নানা ঘটনার জন্য হয়েছেন সমালচিতও। গোল উদযাপণে নিষিদ্ধ ফায়ারওয়ার্কস ব্যবহার করার জন্য নিষিদ্ধ হতে হয়েছে তাকে।
মাঠের ফুটবলে দারুন রিচার্লিসন সমর্থকদের কাছে শিকার হয়েছে বর্ণ বৈষম্যের। চলতি বছরের অক্টোবরে তিউনিসিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ চলাকালীন তাকে উদ্দেশ্যে করে ছুড়ে কলা ছুড়ে মারা হয়েছিল। এইসব বিষয় উপেক্ষা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াতেই মনযোগ ধরে রেখেছেন রিচার্লিসন। হয়ে উঠেছেন ব্রাজিলের জয়ের নায়ক।
আপনার মতামত লিখুন :