• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬
বিদায় ২০২১

রাজনৈতিক সংকটের ‘ক্যারি ফরোয়ার্ড’


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২১, ০১:৩৭ পিএম
রাজনৈতিক সংকটের ‘ক্যারি ফরোয়ার্ড’

আরও একটি নতুন বছরে পা দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সব গ্লানি মুছে, পুরাতন স্মৃতি ভুলে, বৎসরের আবর্জনা দূর করে আমরা নতুন বছরে পদার্পণ করতে চাই। কিন্তু সব চাওয়া সব সময় পূরণ হয় না। যেমন বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরাজমান দূরত্ব ক্রমশই অনতিক্রম্য হয়ে উঠছে। দীর্ঘদিনের এই দূরত্ব কমার কোনো লক্ষণ ২০২১ সালে দেখা যায়নি, ২০২২ সালে সমস্যা মিটে যাবে, তেমন লক্ষণও নেই।

অনেক দিন ধরেই বিএনপির রাজনীতি খালেদা জিয়ার চিকিৎসাকেন্দ্রিক। দলের নেত্রীর মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতেই কেটেছে বিএনপির রাজনীতি। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়া অনেক দিন ধরেই এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সরকারের অনুকম্পায় বেগম জিয়া বাসায় থেকে এবং দেশে নিজের পছন্দের হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পেলেও অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় বিএনপি তাকে বিদেশে পাঠিয়ে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার বারবার বলে আসছে, একজন দণ্ডিত ব্যক্তির বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ নেই।

তবে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নয়, রাজনীতিকে আরও জটিল করে তোলার ইঙ্গিত নিয়েই শেষ হতে যাচ্ছে বছরটি। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনেই হবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে, তার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কী হবে।

যদি সব দলের আলোচনা এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, তাহলে একটা বড় ঝামেলা মিটে যাবে। নইলে এই জটিলতা আরও বাড়বে, যা পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নিতে হবে আমাদের। নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে, সংবিধানে তা স্পষ্ট করা আছে। সংবিধানের ১১৮(১) বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনও আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ গত ৫০ বছরে অনেক প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় আইন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠনের মতো অতি জরুরি বিষয়ের আইনটি কেউ করেনি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে বলে আওয়ামী লীগের দায় একটু বেশি। তবে দায় নিতে হবে সবাইকেই। বিএনপি ও জাতীয় পার্টিও বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু আইনটি কেউ করেনি।

নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের বিষয়ে নীতিগতভাবে সবাই একমত। কিন্তু আইন করার সময় আর হয় না। তবে দায় নিতে হবে সুশীল সমাজকেও। নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার দাবিটি সামনে আসে ঠিক পাঁচ বছর পরপর। নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষের আগে আগে সবার আইনের কথাটি মনে আসে। তখন সরকার বলে, এবার আর সময় নেই। এর পরেরবার আইনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। যেনতেনভাবে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়ে গেলে পরের পাঁচ বছর সবাই আইনের কথা বেমালুম হয়ে যান।

নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন তো ছিলই না, কোনো আলোচনার রীতিও ছিল না। ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছামতো পছন্দের লোক দিয়ে কমিশন গঠন করা হতো। কিন্তু রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে সংলাপ এবং সার্চ কমিটির মাধ্যমে আগের দুটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। একদম আলোচনা না হওয়ার চেয়ে, আলোচনা-সার্চ কমিটিকে মন্দের ভালো বলা যেত। কিন্তু সমস্যা হলো, সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি কমিশনের অধীনেই ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম খারাপ দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার মানে, সার্চ কমিটি ভালো নির্বাচনের গ্যারান্টি দেয় না। একটা বিষয় পরিষ্কার, সার্চ কমিটি হোক আর আইন হোক; যেভাবেই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হোক না কেন; ক্ষমতাসীন সরকার আন্তরিক না হলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তবে আইন করে হোক আর যেভাবেই হোক, নির্বাচন কমিশন চাইলে একটা ভালো নির্বাচন করতে পারে। কারণ, এমনিতেই নির্বাচন কমিশনের হাতে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, তা-ও তারা প্রয়োগ করে না। কেন করে না, এটা এক অপার রহস্য।

একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জীবনে চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু থাকে না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সব অপচেষ্টা রুখে দিয়ে একটি ভালো নির্বাচন করলে তিনি আজীবন সম্মান পাবেন। কিন্তু আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনাররা কেন যেন শেষ পর্যন্ত দলীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঘৃণা নিয়েই বেঁচে থাকেন। তারা কেন জীবনের শেষ সুযোগটি ঘৃণা কুড়ানোর কাজে ব্যয় করেন, জানি না।

আগের দুবারের মতো এবারও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছেন। সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ ছোট ছোট বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এরই মধ্যে সংলাপে অংশ নিয়েছে। বিএনপি এখনো সংলাপের আমন্ত্রণ পায়নি। তবে পাবে এটা নিশ্চিত। তবে পেলেও তারা তাতে অংশ নেবে, তেমন লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন গঠন নয়, বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল। কিন্তু বাস্তবতা হলো মাঠে বা মাঠের বাইরে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করার মতো কোনো চাপ বিএনপি সৃষ্টি করতে পারেনি। চাপহীন সরকার হয়তো সার্চ কমিটির আড়ালে নিজেদের পছন্দমতো নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। সেই কমিশনের অধীনেই পরবর্তী নির্বাচনের দিকে এগোবে সরকার।

নির্বাচন কমিশন গঠনের সময়ই যদি মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আস্থায় নেওয়া যেত, তাহলে আমরা অনেক নিশ্চিন্তে নতুন বছরে পা রাখতে পারতাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা লক্ষণ, তাতে ২০২১ সালের জটিলতা আমরা ২০২২ সালে টেনে নেব। আর ২০২২ সালে একতরফা নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে, তার জের টানতে হবে ২০২৩, ২৪ বা আরও অনেক দিন ধরে। ‘ক্যারি ফরোয়ার্ড’ করা জটিলতা নিয়েই আমাদের দিন গুজরান করতে হবে।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!