• ঢাকা
  • শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ডা. মুরাদ কি আগেই পতন টের পেয়েছিলেন?


সাইফুর রহমান তপন
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২১, ০৩:৪৮ পিএম
ডা. মুরাদ কি আগেই পতন টের পেয়েছিলেন?

মাত্র কদিন আগেও যিনি ছিলেন হিরো, ৭ ডিসেম্বর তিনি হয়ে গেলেন জিরো। বলা হচ্ছে, সদ্য পদত্যাগকারী তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের কথা, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ৭ ডিসেম্বর প্রতিমন্ত্রীপদ ত্যাগ করেছেন নানা সমালোচনা ও বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে। সম্প্রতি একটা ইউটিউব চ্যানেলে কথা বলার সময় মুরাদ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তাঁর মেয়ে জাইমা রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সেখানকার রোকেয়া ও শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের সম্পর্কে খুব ‘আপত্তিকর’ কিছু কথা বলেন। সামাজিক মাধ্যমে এ ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে চারদিকে ছি ছি পড়ে যায়। নানা মহল থেকে মুরাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।

শুধু তা নয়, আগুনে ঘি পড়ার মতো, এ ঝড়ের মধ্যেই ফাঁস হয় মুরাদ আর চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির ফোনালাপ, যেখানে মুরাদকে মাহির সাথে খুবই বাজে ভাষায় কথা বলতে শোনা যায়। ওই অডিওতে মুরাদ মাহিকে, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তুলে এনে ধর্ষণের হুমকি দেন। এত কিছুর পর সরকার ও সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের চুপ থাকার কথা নয়। তাই খুব দ্রুত মুরাদের গদি উল্টে যায়।

তাঁকে শুধু মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়নি, দলীয় পদও হারাতে হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে।

মুরাদ সাংসদ হয়েছেন বেশ অল্প বয়সে। মন্ত্রিত্ব পেতেও খুব বেশি সময় লাগেনি তাঁর। ফলে তাঁর ভক্তের সংখ্যা কম ছিল না। তবে মুরাদের ভক্তের সংখ্যা, বিশেষ করে দলের মধ্যে, অস্বাভাবিক সংখ্যায় বেড়ে যায় গত আগস্ট থেকে, যখন তিনি জামালপুরে একটা সরকারি অনুদান বিতরণ অনুষ্ঠানের ব্যানারে বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার ছবি না থাকায় খুব কড়া ভাষায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বকাবাদ্য করেন। একটা সরকারি অনুষ্ঠানে একজন মন্ত্রীর এমন আচরণে অনেকে একটু হকচকিয়ে গেলেও নেতৃত্বের প্রতি এমন অনুরাগ দেখে বহু মানুষ, বিশেষ করে যারা আওয়ামী লীগে ‘হাইব্রিড’দের দৌরাত্ম্যে ক্ষুব্ধ ছিলেন, তাকে সাধুবাদ জানান।

এরপর মুরাদকে দেখা গেল, অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো, সংবিধান থেকে ‘যেকোনো মূল্যে’ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিতে। এ বক্তব্য সেক্যুলার ও উদারনৈতিক মানুষদের মধ্যে বেশ সমর্থন পায়, যদিও আওয়ামী-বিরোধী দলগুলো এবং মানুষদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেওয়ার পাশাপাশি তা আওয়ামী লীগেরও অনেক নেতার মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করে। এ নিয়ে মুরাদের পক্ষে-বিপক্ষে তখন সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্যের ঝড় বয়ে যায়। 

একই সময়কালে ডা. মুরাদ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আর কাউকে নেতা না মানার ঘোষণা দেন এবং শেখ হাসিনা ও তাঁর রক্তের উত্তরাধিকারদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে  আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। এটাও আওয়ামী লীগের বিপুল নেতা-কর্মী-সমর্থকের মধ্যে মুরাদকে রীতিমতো হিরো বনিয়ে দেয়, যদিও তাঁর এসব বক্তৃতা প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছিল এলোমেলো।

তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে, বিভিন্ন টিভি ও ইউটিউব চ্যানেল দর্শক বাড়ানোর প্রত্যাশায় রীতিমতো তাঁকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে। আর এ পরিস্থিতিতে তিনি প্রায় আলাপচারিতায় বেসামাল হয়ে ওঠেন। কোথায় কার সঙ্গে কী বলতে হবে, তা যেন ভুলে যান তিনি। সম্প্রতি উপর্যুক্ত ইউটিউব চ্যানেলে তারেক, জাইমা এবং রোকেয়া ও শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীদের বিরুদ্ধে করা তাঁর আপত্তিকর মন্তব্যসমূহ এরই ধারাবাহিকতা মাত্র।

মুরাদের দাম্ভিক, বেসামাল ও অশালীন মন্তব্যগুলো শুধু সরকারবিরোধী মহলকে ক্ষুব্ধ করেনি, ছাত্রলীগের বহু নেতাকর্মী, বিশেষ করে সংগঠনটির ঢাবির রোকেয়া ও শামসুন্নাহার হলের নেতা-কর্মীদেরকে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হতে উৎসাহিত করে। এ অবস্থায় যেসব উদারমনা মানুষ মুরাদের ধর্ম ব্যবসায় ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বক্তব্য শুনে তাঁর সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা পড়ে যান বেকায়দায়। তাঁদের মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, তবে কি মুরাদের এর আগে করা উদার ও অসাম্প্রদায়িক বক্তব্যগুলো ছিল কেমোফ্লেজ? মাহির সাথে তাঁর ফোনালাপ শুনে তাঁরা এ প্রশ্নটাও ভাবতে থাকেন, মুরাদ কি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর পতন আসন্ন? আর তা ঠেকাতেই কি তিনি ওই কেমোফ্লেজের আশ্রয় নিয়েছিলেন?

এ প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক, কারণ ডা. মুরাদ এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সেই ২০০৯ সাল থেকে। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে না সংসদে না সংসদের বাইরে, তাঁকে বঙ্গবন্ধু পরিবার বা শেখ হাসিনার বন্দনা এতটা করতে শোনা যায়নি, যতটা সম্প্রতি দেখা গেছে। মন্ত্রী হিসেবেও এত দিন তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি বা এর শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এতটা আগ্রাসী মনোভাব দেখাতে দেখা যায়নি।

আর মাহির সাথে মুরাদের ফোনালাপ ফাঁসের বিষয়টিও খুব তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ জাইমা বিষয়ে ডা. মুরাদ যা বলেছেন তাতেও অন্তত আওয়ামী লীগারদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা অটুট থাকত, যদি না ওই ফোনালাপের ক্লিপটি ফাঁস হতো। এই ক্লিপ প্রচারিত হওয়ার পরই সবাই বুঝতে পারেন যে, মুরাদ কেবল ক্ষমতার অপব্যবহারকারীই নন, একজন নিপীড়কও বটে।

মুরাদের পদত্যাগের পর তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ২০১৯ সাল থেকে তাঁরা যৌথভাবে মন্ত্রণালয়টি সামলেছেন। কোনো সমস্য হয়নি। কিন্তু গত তিন মাস ধরে তিনি ডা. মুরাদের মধ্যে একধরনের পরিবর্তন লক্ষ করেন। তথ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যটিও ইঙ্গিতবহ।

মাহির সাথে মুরাদের ফোনালাপ ঘটেছে দুই বছর আগে। এত দিন পর সে কথপোকথন কে ফাঁস করল? কেনই-বা তা করা হলো?

এ ধরনের ফোনালাপ কারা টেপ করে এবং কারা ফাঁস করে, তা একপ্রকার ওপেন সিক্রেট। অনেকের ধারণা, মুরাদ ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছিলেন যে, তাঁর অপকর্মগুলো রেকর্ড করা হচ্ছে এবং এ জন্য তাঁকে খেসারত দিতে হতে পারে। আর তা থেকে বাঁচতেই তিনি ওই কেমোফ্লেজ ধরেছিলেন।

সরকারি দলের মধ্যে একাধিক ক্ষমতাবলয় কাজ করছে, বেশ কয়েক বছর ধরে এমন আলাপ আমরা জনপরিসরে শুনতে পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীকে কোনো কোনো বিষয়ে প্রভাবিত করা বা এমনকি চাপে ফেলে সিদ্ধান্ত তাদের অনুকূলে নেওয়ার ক্ষমতা নাকি এরা রাখে। এ রকমই এক ক্ষমতাবলয়ের আশীর্বাদে অন্য অনেক অল্পবয়স্ক মন্ত্রী-সাংসদের মতো উত্থান ঘটেছিল ডা. মুরাদের। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সদ্যবহিষ্কৃত মেয়র জাহাঙ্গীরও নাকি এদেরই আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন।

কিন্তু বাঘের ওপরও টাগ থাকে। এ কথাটি আবারও প্রমাণিত হল মুরাদের প্রপাতধরনীতল হওয়ার মধ্য দিয়ে। তার এ পতন সরকারি দলের ক্ষমতার অপব্যবহার করে এখনো যারা জনগণের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন তাদের প্রতি নিশ্চয় একটি সতর্কবার্তা। কিন্তু সেসব খলনায়কেরা কি তা অনুধাবন করতে পারছেন? সময়ই এ প্রশ্নের উত্তর দেবে।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!