• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফ্রান্স কেন দাঙ্গায় জড়ালো?


আফরিদা ইফরাত
প্রকাশিত: জুলাই ৩, ২০২৩, ০৫:৩০ পিএম
ফ্রান্স কেন দাঙ্গায় জড়ালো?

ফ্রান্সের অবস্থা এখন ছুরির ফলার ওপর দিয়ে হাঁটার মতো। ২৭ জুন প্যারিসের পশ্চিমের শহরতলীতে ১৭ বছর বয়সী আলজেরিয়া বংশোদ্ভূত ফরাসি গাড়িচালককে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা করা হয়। ট্রাফিক স্টপেজে সঠিক সময়ে না থামার অভিযোগে তাকে গুলি করা হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর সারা ফ্রান্সে বিক্ষোভ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ভাঙচুর, লুটপাট চালানোর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতীকের ওপর বিক্ষোভকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা শুরু করেছে। ২০০৫ সালের পর নিহতের পরিবারের প্রতি ফ্রান্সের মানুষের মানুষের আবেগ-অনুভূতির এমন বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়নি। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ নিজেও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

ফ্রান্সজুড়ে ২ জুলাই চতুর্থ রাতের মতো দাঙ্গা শুরু হওয়ার কারণে জার্মানি সফর স্থগিত করেছেন তিনি। পুলিশি হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনাটিকে তিনি ক্ষমার অযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন। অভিযুক্ত পুলিশকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের মামলা করা হয়েছে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য পরিচালনার উপযুক্ত আইনি কাঠামোও কিন্তু নেই। 

হালকা সাঁজোয়া যানসহ ৪৫ হাজার পুলিশ অফিসার মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও শুক্রবার রাতে সহিংস সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। মন্ত্রণালয় টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে জানিয়েছে, গত দুই দিনে ১ হাজার ৩১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে শনিবারের সহিংসতার ‘তীব্রতা’ কম ছিল। ফরাসি আইনমন্ত্রী এরিক ডুপন্ট-মোরেটি বলেছেন, আটকদের মধ্যে ৩০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম। দেশটির অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লে মাইরে বলেছেন, মঙ্গলবার থেকে ৭০০টির বেশি দোকান সুপার মার্কেট, রেস্তোরাঁ এবং ব্যাংকের শাখাগুলোয় লুটপাট চালানো হয়েছে এবং কখনও কখনও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ফ্রান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মার্সেইতে দাঙ্গাকারীরা একটি বন্দুকের দোকান লুট করেছে এবং শিকারের রাইফেল চুরি করেছে। নিহত কিশোর নাহেলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার মায়ের নেতৃত্বে ৬ হাজার মানুষের একটি পদযাত্রা নান্টেল থেকে শুরু হয়। এই পদযাত্রাও এক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। 

প্রশ্ন হচ্ছে, ফ্রান্সের এই অবস্থার জন্য মূলত দায়ী কী? ‘স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব’—ফ্রান্স প্রজাতন্ত্রের এই তিন মূলমন্ত্রই দেশটিকে গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। কিন্তু কাঠামোবদ্ধভাবে তারা বর্ণবাদী আচরণ জিইয়ে রেখেছে। অসংখ্য নাগরিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা নিজেদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। তাদের দাবি-দাওয়াও থাকে উপেক্ষিত। গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে দুর্দশার ঘটনা আর কিই-বা হতে পারে। ফ্রান্সে বর্ণবাদী আচরণ নতুন কিছু নয়। যদি এই হত্যাকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রে হতো তাহলে সংবাদমাধ্যমগুলো তার ধর্মপরিচয়কে সামনে নিয়ে আসতো। কিন্তু ফ্রান্সের আইনি ও সমাজকাঠামোতে বর্ণবাদ সুপ্ত হয়ে আছে। এই বর্ণবাদের বিষয়টি কারোই চোখে পড়েনি। ফলে রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার পরও অভিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ভুলে গেলে চলবে না, ফ্রান্সের অধিকাংশ নাগরিকই অভিবাসী। উত্তর আফ্রিকা অঞ্চল, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ অথবা এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা অভিবাসী হিসেবে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে। তাদের বংশোদ্ভূতরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয় অদ্ভুত বৈষম্য-ভিত্তিক কাঠামোর কারণে। 

১৯৭৮ সালের এক আইন অনুসারে কারও ব্যক্তিগত তথ্যে জাতি, বর্ণ, ধর্ম ও অন্যান্য পরিচয় উন্মুক্ত না করার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ রয়েছে। ফরাসি সমাজে বর্ণাবাদী আচরণ অনেকটা অদৃশ্য অবস্থায় রয়েছে। বিষয়টি বোঝানো দরকার। প্রচলিত এই আইন তো বর্ণ, ধর্ম বা জাতির ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহে বাধা দিয়ে আসছে। তাই পিছিয়ে পড়া এই নাগরিকদের সঠিক সংখ্যাও যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কতটুকু বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে এই মানুষদের, তাও আমাদের জানা নেই। এভাবেই ফ্রান্সে বর্ণবাদী আচরণ অনেকটা অদৃশ্য হয়ে আছে। অবশ্য ২০২২ সালে ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল কনসালটেটিভ কমিশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অন্তত ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ফরাসি নাগরিক বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন। ৬৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি দেশে এত বড় সংখ্যার বর্ণবাদী আচরণ সচরাচর ব্যক্তিগত আক্রমণ বলে অভিহিত হয়। কাঠামোবদ্ধভাবে বর্ণবাদের বিষয়টি কখনই সামনে আসে না। প্রমাণ করারই বা সুযোগ কিভাবে পাওয়া যাবে? এসব বিষয় আমাদের একেবারেই অজানা। ফ্রান্সের অভিবাসীদের সিংহভাগই কৃষাঙ্গ কিংবা উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত। সচরাচর তাদের শহরতলি অঞ্চল কিংবা বড় শহরের প্রান্তিক অঞ্চলে ঠাঁই নিতে হয়। সেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা থাকে কম। বর্ণবাদী আচরণের শিকার এই মানুষদের পক্ষে দুর্দশা ও হতাশাচ্ছন্ন হওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। কিন্তু ছাইচাপা আগুনের মতো তাদের বুকেও কাঠামোর প্রতি ক্ষোভ থাকে। বর্ণবাদী আচরণের শিকার তরুণ নাহেলের মৃত্যু ওই আগুন আবার জাগিয়ে তুলেছে। চলমান দাঙ্গা বা সহিংসতা এরই সাক্ষ্যবহ। 

কিন্তু এই সহিংসতা থেকে রাজনৈতিক বা দেশটির পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত কিছু বুঝতে পারি কি? অবশ্যই। ইউরোপে ক্রমেই বাড়ছে উগ্র ডানপন্থিদের প্রভাব। ২০০০ সালে ভিয়েনা থেকে আবার এই উগ্র ডানদের উত্থান। ইতালির সরকার তো উগ্র ডানপন্থীই। জার্মানিতেও সম্প্রতি উগ্র ডানপন্থীদের উত্থান আমাদের আশঙ্কা জাগিয়েছে। এই উগ্র ডানপন্থীদের সঙ্গে নাৎসি অতীত স্পর্শকাতরভাবে জড়িয়ে আছে। ফ্রান্সেও এই উগ্র ডানপন্থীরা এই সহিংসতাকে কাজে লাগিয়ে নানা স্বার্থ হাসিল করতে পারে। বিশেষত নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি বিচারে তারা চাইবে সহিংসতাকে কাজে লাগিয়ে জাতিগত বিভেদের বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক। তাছাড়া জাতীয় আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের বিষয়টি মাথায় রেখে তারা অভিবাসীদের ক্ষেত্রে নির্মম। তাই এই সহিংসতার দুটো দিকই বিবেচনায় রাখতে হবে।

২০১৭ সালে জঙ্গি তৎপরতা বাড়ায়, ফ্রান্সে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি পায়। আর এই আইনই তাদের বর্ণবাদী আচরণের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। শুধু ট্রাফিক স্টপেজে না থামার কারণে তারা এক তরুণকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে এই আইনের বাহানায় অন্তত ১৩ জনকে হত্যা করা হয়। চলতি বছর নাহেল এই আইনের স্বেচ্ছাচারিতার তৃতীয় শিকার। ২০১৭ থেকে এখন পর্যন্ত যত মানুষ এই আইনের আওতায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই কৃষাঙ্গ নাহয় আরব বংশোদ্ভূত। বিগত কয়েকদিনে ফ্রান্সে সহিংসতা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে শহরতলিতে বর্ণবাদী আচরণ কতটা উগ্র রূপলাভ করেছে। মূল বিষয় হলো, ফ্রান্সের পরিস্থিতি এখন নাজুক। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তাদের সুনাম রয়েছে। কিন্তু কাঠামোগতভাবে তারা বর্ণবাদী। এমনকি পুলিশি নির্যাতনের বিষয়েও তাদের এখন কঠোর অবস্থান নিতে হবে। আবার আরেকটি নতুন প্রত্যাশাও এখানে জুড়ে দিতে হয়। এবার অন্তত ফ্রান্সের সচেতন মহল তাদের বর্ণবাদী কাঠামো সম্পর্কে সচেতন হবেন।

লেখক : সংবাদকর্মী।

Link copied!