• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বজনীন পেনশনের উৎসাহে ভাটা ও করণীয়


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০২৩, ০৩:৩০ পিএম
সর্বজনীন পেনশনের উৎসাহে ভাটা ও করণীয়

এক দশকের বেশি সময় ধরে আলাপ‑আলোচনা ও জল্পনা‑কল্পনার পর একরাশ আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হয়েছে প্রায় তিন মাস আগে। এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার‑প্রচারণার ডামাডোলে চারদিকে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ১০ কোটি মানুষকে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে গড়া এই উদ্যোগের মাধ্যমে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে আরও এক ধাপ অগ্রসর হওয়ায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বদরবারে উজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু এখন অনেকে মনে করছেন, সর্বজনীন পেনশনের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের প্রাথমিক স্তরে জনমনে কিছুটা মোহভঙ্গ প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে এবং মনে হচ্ছে, কোথাও যেন কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। এটি অত্যন্ত হতাশাজনক। অনেকে আবার রংচং যোগ নানা বিভ্রান্তিও তৈরি করছেন। কারণ, পেনশনের সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সংখ্যা ক্রমশই কমে আসছে, মানুষের উৎসাহ‑উদ্দীপনায় ভাটা পড়েছে। অপরদিকে বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেহেতু সর্বজনীন পেনশনের মতো যেকোনো জনসম্পৃক্ত ব্যবস্থার প্রবর্তনই কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং কাজ এবং যেহেতু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেহেতু বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষকে এখন অত্যন্ত সতর্কতা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে; উদ্যোক্তা ও উদ্দীষ্টের বোঝাপড়ার মধ্যে যে দূরত্ব অনুভূত হচ্ছে, তা দ্রুত নিরসন করতে হবে। 

জানা গেছে, এ পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ব্যক্তি চাঁদা জমা দিয়েছেন, যাদের মধ্যে বেসরকারি চাকরিজীবীদের সংখ্যাই বেশি; এরপরে আছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবীরা। ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন চালু করার পর ২৩ আগস্ট পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন ৭ হাজার ২০ জন। ঠিক ১ মাসে অর্থাৎ ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাঁদা পরিশোধ করেছিলেন ১২ হাজার ৮৮৯ জন। ঠিক এক মাস পরে অর্থাৎ ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত এ স্কিমে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৮৩১ জন। এখন আবার এই সংখ্যা কমতে কমতে দেড় হাজারের নিচে নেমে চলে গেছে। স্বাধীনতালাভের ৫২ বছর পরে এসে ব্যাপক প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করা সরকারের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা সময়সাপেক্ষ বিষয় নিঃসন্দেহে, কিন্তু আগ্রহ‑উৎসাহে এত দ্রূত ভাটা পড়া কিছুটা তো আশঙ্কার বিষয়ই। কারণ, এই উদ্যোগের সাফল্যের ওপর অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত দেশের মোট শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশ মানুষের প্রবীণ বয়সে গিয়ে অনিশ্চয়তা, সামাজিক অবহেলা ও আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি নির্ভর করছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৫ আগস্ট পর্যন্ত যত ব্যক্তি চাঁদা দিয়েছেন, তার মধ্যে বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রগতি কর্মসূচির আওতায় ৪ হাজার ৩৭১ জন, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সুরক্ষায় ২ হাজার ৭৪১, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর সমতায় ৯১০ এবং প্রবাস কর্মসূচিতে ২০৯ জন। বয়স ও বিভাগওয়ারি তালিকা অনুযায়ী, পেনশন স্কিমে সবচেয়ে বেশি অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ৩১ থেকে ৪০ বছরের মানুষ এবং শীর্ষে ছিল ঢাকা, দ্বিতীয় চট্টগ্রাম। এ পর্যন্ত জমা হওয়া চাঁদার পরিমাণ ১৩ কোটি টাকার কিছু বেশি, যার মধ্যে ১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা প্রাথমিকভাবে ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে গত ২২ অক্টোবর। সে সময় এই বন্ডের বিপরীতে সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য লভ্যাংশের ভিত্তিতে পেনশনারের মাসিক অ্যানুয়াটি হিসাব করে একজন পেনশনারের মাসিক পেনশন প্রদান করা হবে নির্ধারিত মেয়াদের পরে। কিস্তির পরিমাণ ও মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে একজন গ্রাহক মোট চাঁদার চেয়ে আনুমানিক সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৩০ গুণ থেকে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৩১ গুণ বেশি অর্থ পেনশন হিসেবে পাবেন। গ্রাহকদের পেনশন সুবিধা দিতে সরকারের বাড়তি কোনো টাকার প্রয়োজন হবে না এবং তহবিলে জমা হওয়া অর্থ বিনিয়োগ করেই পেনশনের অর্থ জোগান দেওয়া হবে। উন্নয়ন অর্থনীতিতে সর্বজনীন বা ইউনিভার্সাল পেনশন স্কিম বলতে আর্থিক অবদান বিবেচনায় না এনে নাগরিকত্ব ও বয়সের শর্ত পূরণ সাপেক্ষে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রবীণদের অর্থ সুবিধা দেওয়াকে বোঝানো হয়। মূলত বিশ্বের কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রবীণ নাগরিকেরা এই সুবিধা ভোগ করেন। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় সর্বজনীন বা ইউনিভার্সাল পেনশন নামে না হলেও অন্যভাবে প্রবীণদের জন্য রাষ্ট্রের বিশেষ আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা ও সুরক্ষা বরাদ্দ থাকে, সেখানে সরকারের রাজস্ব আয় থেকে এই খাতের জন্য বড় একটি অংশ অর্থায়ন হয়। বাংলাদেশে সদ্যপ্রবর্তিত সর্বজনীন পেনশনে চারটি কর্মসূচির মধ্যে একটির জন্য ৫০০ টাকার বিপরীতে ৫০০ টাকা অর্থায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

যেকোনো দেশে সরকারি উদ্যোগে এ ধরনের সর্বজনীন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার প্রাথমিক স্তরে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। কারণ, সরকারেরর প্রশাসনিক কার্যক্রমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীর মতো প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত না থাকায় সব নাগরিককে সুশৃঙ্খল কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার স্বশাসিত কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত নাগরিককে হঠাৎ করা বাধ্যবাধকতার মধ্যেও আনাও কঠিন। এই দৃষ্টিতে সর্বজনীন পেনশনে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, প্রশাসনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, অংশগ্রহণকারী বা উদ্দীষ্ট মানুষের দিক থেকে আসা অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ। প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে জনপ্রশাসন ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, জন‑তহবিল ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিসক্ষমতা ও প্রযুক্তি বাস্তবায়নে দক্ষতা ইত্যাদি। অন্যদিকে অংশগ্রহণকারীদের দিকে উদ্ভূত থেকে বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যা, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিপত্য, ব্যক্তি উদ্যোগের অভাব এবং সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারীদের উপলব্ধি, মানসিকতা ও মনোভাব। এসব বিবেচনায় নিয়ে ১৮৮৯ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর ভন বিসমার্ক বিশ্বে প্রথমবারের মতো সরকারের রাজস্ব আয় থেকে ৬৫-ঊর্ধ্ব শ্রমিকদের সবাইকে একই হারে সামাজিক পেনশনের প্রবর্তন করেন। জার্মানির যুগান্তকারী এই উদ্যোগের সাফল্য দেখে ১৮৯১ সালে ডেনমার্ক ও ১৮৯৮ সালে নিউজিল্যান্ডও সামাজিক পেনশন ব্যবস্থা চালু করে। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য এ ধরনের পেনশন সুবিধা চালু হয়। তবে বর্তমানে বিশ্ব দুটি শ্রেণিতে ভাগ করে সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়ন ও ব্যক্তির আয় থেকে নির্দিষ্ট হারে অর্থ কর্তন করে নির্দিষ্ট হারে পেনশন প্রদানের প্রচলন দেখা যায়। আবার অনেক দেশের পেনশন ব্যবস্থায় এ দুয়েরই মিশ্রণ দেখা যায়। আইসল্যান্ডের পেনশন ব্যবস্থাকে ‘থ্রি পিলার অ্যাপ্রোচ’ বলা হয়ে থাকে। প্রথম স্তম্ভে সোশ্যাল সিকিউরিটি সিস্টেমের আওতায় সরকারি-বেসরকারি খাতের ৬৫ ও ৬৭ বছর অতিক্রান্ত ব্যক্তির বসবাসের গড় খরচের ১৫ শতাংশ পেনশন হিসেবে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় স্তম্ভে পেশাভিত্তিক পেনশন দেওয়া হয়। আর তৃতীয় স্তম্ভের মাধ্যমে সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন প্রাইভেট পেনশন স্কিমে পেশাভিত্তিক পেনশনে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ও নিয়োগকৃতদের যৌথ অর্থায়নে প্রবীণ বয়সে বসবাসের গড় খরচের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পেনশন হিসেবে দেওয়া হয়। 

বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান (বিবিএস, ২০২২) অনুযায়ী, বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার এই দেশে ৩০.৮ শতাংশের বয়স ০-১৪ বছর, ৫৩.৭ শতাংশ ১৫-৪৯, ৮.২ শতাংশ ৫০-৫৯ এবং ৮.১ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে। এদের মধ্যে আবার কর্মক্ষম বয়সীর বিপরীতে নির্ভরশীল জনসংখ্যার অনুপাত জাতীয় ৫২:৬৪, পল্লী ৫৬:০৯ এবং শহর ৪৫:৬৩। প্রক্ষেপণে দেখা যায়, ৬০-ঊর্ধ্ব বয়সীর সংখ্যা ২০৩০ সালে দাঁড়াবে প্রায় ১৯ শতাংশ এবং ২০৫০ সালে হবে প্রায় ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২০৫০ সালে প্রতি ৫ জনের ১ জনের বেশি হবেন প্রবীণ নাগরিক। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬ কোটি ৮৪ লাখ ১২ হাজার ৬৭৮ জন মানুষ কর্মবাজারে নিয়োজিত এবং জিডিপির ৫৭ শতাংশ আসে আনুষ্ঠানিক খাত থেকে, যেখানে নিয়োজিত আছেন মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ। অন্যদিকে মোট জিডিপির বাকি ৪৩ শতাংশ আসে অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে, যেখানে নিয়োজিত রয়েছেন ৮৭ শতাংশ। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি পেনশন স্কিম ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের অধীনে সরকারি খাতের মাত্র ৫ শতাংশ ও বেসরকারি খাতের ৯ শতাংশ নাগরিক প্রবীণ বয়সের জন্য সুরক্ষিত আছেন। জনসংখ্যার বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২৩ কোটিতে। এই ২৩ কোটি মানুষের মধ্যে ৬০-ঊর্ধ্ব হবেন প্রায় ৬ কোটি। অন্যদিকে চালু করা পেনশন কর্মসূচিতে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা। সংখ্যায় তারা যতই হোন কেন, যে ধারা ও গতিতে কার্যক্রম এগোচ্ছে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায়, ২০৫০ সালে প্রাক্কলিত জনসংখ্যার সিংহভাগ অংশই সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রমের বাইরে থেকে যাবেন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব বিবেচনা করলে, তখন প্রবীণ নাগরিকদের অন্য কোনোভাবে সামাজিক সুরক্ষা‑সুবিধা প্রদান করতে হবে, যা রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের চাপ তৈরি করবে। এসব বিবেচনায় নিলে সর্বজনীন পেনশনের সফলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

নাগরিকদের আগ্রহে ভাটা পড়ার বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথমেই মনে হয়, এ ধরনের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে যে ধরনের সমীক্ষা, গবেষণা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়, তার ব্যবস্থা না করেই কার্যক্রম শুরু করে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে সপ্তাহে ১০ হাজার অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা ৩ মাস পরে মাসে ২ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। ধারণা করা যায়, প্রথম সপ্তাহের ধারা অব্যাহত থাকলে ১ বছরে সংখ্যাটি দাঁড়াত প্রায় ১০ লাখ। সর্বজনীন পেনশন প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে জনপ্রশাসন ব্যবস্থাপনায় যে সরকারি পক্ষ থেকে কোনো ঘাটতি নেই, সে কথা সত্যি। সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হওয়ায় আর্থিক সুরক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন তোলাও অবান্তর। কিন্তু সুশাসন, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, জন‑তহবিল ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি সক্ষমতা ও প্রযুক্তি বাস্তবায়নে দক্ষতায় ঘাটতির বিষয়টি বিদ্যমান পরিকাঠামোতে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। যেমন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের প্রধান কবিরুল ইজদানী খান বলেছেন, ‘পেনশন হচ্ছে সুরক্ষা, এটি সম্পত্তি নয়।... জমিজমা কিংবা অন্য কোনো সম্পদের সঙ্গে এর তুলনা করা ঠিক হবে না।’ তাঁর এই বক্তব্য যথেষ্ট সত্যি ও যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এটি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ও অল্প শিক্ষানির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘অ’ জানেন না, এমন মানুষজনের কাছে ভুল বার্তাও দিতে পারে। কারণ, ৩০ বছর বয়সী অত্যন্ত নিম্ন আয় উপার্জনকারী ব্যক্তির কাছে তার রক্ত পানি করা ৫০০ টাকা সম্পদ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি দেশের দিন আনা দিন খাওয়া বড় একটি অংশের মানুষের মাথায় ৬০‑৬৫ বছর বয়সের ভাবনা না থাকাটাও যৌক্তিক। এখানেই উদীষ্ট মানুষের দিক থেকে আসা চ্যালেঞ্জের বিষয়টি বোঝা যায়। এই প্রসঙ্গটি এসেছে সম্ভবত এ কারণে যে একজন ব্যক্তি যদি প্রতি মাসে ১০০০ করে ১০ বছর টাকা জমা দেন এবং কোনো কারণে তহবিলে যদি তিনি আর টাকা জমা না দিতে পারেন, তাহলে কী হবে? তিনি কি সেই টাকা এফডিআরএর মতো তুলে নিতে পারবেন, কিংবা সেই টাকার কী ব্যবস্থা হবে? কর্তৃপক্ষ বলছেন, তহবিল জোগানদাতা ব্যক্তির ৬০ বছর পূর্ণ হলে পেনশনের নিয়মে সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমরা কঠিন একটি কর্মযজ্ঞের প্রাথমিক স্তরে রয়েছি। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সরকারি পেনশন ব্যবস্থার চাকরির বয়স ৬ বছর হলে, মূল বেতনের ২৪ শতাংশ, ৭ হলে শতাংশ ২৭, ৮ হলে ৩০ শতাংশ, ৯ হলে ৩৩ শতাংশ এবং ১০ বছর পূর্ণ হলে ৩৬ শতাংশ প্রভৃতি হারে আনুতোষিক পাওয়ার বিধানটি যুক্ত করতে পারেন। কিংবা নির্দিষ্ট একটি অংশ এককালীন তুলে নেওয়ার বিধান চালু করতে পারেন। কেননা, টাকা জমা দেওয়া ব্যক্তি বেঁচে না থাকলে তার নমিনি যেন সুবিধাপ্রাপ্ত হন, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। এ ধরনের সমস্যায় সুবিধা পেতে হলে ২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে, এই চিন্তাটাই তো উদ্দীষ্ট মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে যথেষ্ট। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নারীদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেশি পুরুষ অপেক্ষা এবং কর্মবাজারে পুরুষের তুলনায় নারীরা সংখ্যাও অত্যন্ত কম। আর এখানে অবদানকৃত ও অনুদানকৃত কর্মসূচির প্রসঙ্গটিও সামনে চলে আসে। 

সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রমের মতো একটি মহাযজ্ঞ বাস্তবায়নের প্রাথমিক স্তরে সঙ্গত কারণেই নানা বিষয় ও সংকট চলে আসবে, যা কর্তৃপক্ষকে সরকারি‑বেসরকারি জ্ঞানাভিজ্ঞ মহলকে সঙ্গে নিয়েই সমাধা করতে হবে। এখানে হতাশার কিছু নেই, অযৌক্তিক প্রশ্ন তোলাও অবান্তর। তবে সর্বাগ্রে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও পুঁজিবাজারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার তীব্র সংকট রয়েছে। এ কারণে বন্ডে বিনিয়োগ করাটাই সবচেয়ে নিরাপদ হবে। এতে নির্দিষ্ট সময়ে রিটার্নের টাকা পাওয়া যাবে, যা দিয়ে মানুষের পেনশন দেওয়া যাবে। তা না‑হলে একসময় রাজস্ব থেকে পরিশোধ করতে হবে, যা কর ব্যবস্থার ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করবে এবং মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করা একটি প্রকল্প রাষ্ট্রের জন্য দায়সম হয়ে উঠবে।

ড. মো. আইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

Link copied!